জয়: নায়ক রশিদ খান। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
যেখানে আকাশে মৃত্যুর ডঙ্কা বাজে। যেখানে বাতাসে বারুদের গন্ধ। তিনি যে সেখান থেকে উঠে এসেছেন। ক্রিকেট মাঠের বাইশ গজের চাপ তার সামনে কী? তিনি রশিদ খান আরমান। তিনি আধুনিক ক্রিকেটের বিস্ময়। বিশ্ব ক্রিকেটকে তিনি দেখিয়ে দিচ্ছেন, দেশজ সীমান্ত কখনও সত্যিকারের প্রতিভাকে আটকে রাখতে পারে না।
শুক্র-রাতের মায়াবী ইডেনে এ বারের মতো থেমে গেল কলকাতা নাইট রাইডার্সের আইপিএল দৌড়। সানরাইজার্স হায়দরাবাদের ১৭৪ রান তাড়া করতে নেমে ১৬০-৯ স্কোরে আটকে গিয়ে।
ভুল লিখলাম। হায়দরাবাদের কাছে কোথায় হারল কেকেআর? হারল তো ওই বছর কুড়ির আফগান ছেলেটার কাছে। যে ছেলেটা ১০ বলে ৩৪ করলেন। চার ওভারে ১৯ রান দিয়ে তিন উইকেট নিলেন। বাউন্ডারি লাইন থেকে তাঁর থ্রোয়ে রান আউট হলেন নীতীশ রানা আর প্রচণ্ড টেনশনের মুখে আউটফিল্ডে নিলেন দু’টো ক্যাচ। ইডেন কি কোনও দিন এ রকম পরিপূর্ণ পারফরম্যান্স দেখেছে আইপিএলে? সন্দেহ আছে। রশিদ খান যে সব দলে থাকেন না!
বয়স তখন কত হবে। বারো কী তেরো। বাবার কড়া নজরদারি এড়িয়ে কী ভাবে ক্রিকেট খেলা যায়, এই ভেবেই ছেলেটার ঘুম ছুটে যেত। কোনও মতে জানলা দিয়ে ক্রিকেট সরঞ্জাম ভাই বা বন্ধুর হাতে গলিয়ে দিয়ে দে ছুট। কিন্তু মাঠে পৌঁছে আবার এক সমস্যা। ব্যাট করবে না বল। ছেলেটা প্রথমে ব্যাট করাই পছন্দ করত। স্থানীয় ক্লাবের হয়ে গোটা তিনেক ম্যাচে ওপেন করার পরে দেখা গেল, বাচ্চাটার ব্যাটে যা রান এসেছে, তার চেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছে। ফলে ক্লাবের ক্যাপ্টেন সোজা বলে দিলেন, ওহে, অনেক হয়েছে ব্যাটিং। এ বার বল করো। কিন্তু লেগস্পিন করার পাশাপাশি রশিদ যে ব্যাট করতেও ভালবাসতেন!
শুক্রবার কেকেআর ম্যাচের প্রথম ১৭ ওভার যে ক্রিকেটটা খেলল, তাকে প্রায় নিখুঁত বলা ছাড়া উপায় নেই। টস জিতে ফিল্ডিং। প্রথম ছ’ওভারে উইকেট ফেলতে না পারলেও বিপক্ষকে মাত্র ৪৫ রানে আটকে রাখা। এর পর কুলদীপ যাদবের এক ওভারে শত্রু শিবিরের সেরা দুই অস্ত্রের ফিরে যাওয়া। শিখর ধওয়ন একটা সোজা বলে সুইপ করতে গিয়ে এলবিডব্লিউ। কেন উইলিয়ামসন গুগলিটা বুঝতে না পেরে উইকেটের পিছনে খোঁচা। ইডেন গর্জন করছে— কেকেআর, কেকেআর!
১৭ ওভারের শেষে হায়দরাবাদের রান পাঁচ উইকেটে ১২৪। একটু পরেই কার্লোস ব্রাথওয়েট রান আউট, ইউসুফ পাঠান ফিরলেন ক্যাচ দিয়ে। তখন মনে হচ্ছিল, দেড়শোর আগেই বোধ হয় শেষ হয়ে যাবে হায়দরাবাদের ইনিংস। কিন্তু রশিদ যে তখনই নামলেন। আফগানিস্তানের জালালাবাদে বাড়ি। এই সে দিন যেখানে ক্রিকেট মাঠে ভয়ঙ্কর এক বিস্ফোরণে শেষ হয়ে গিয়েছিল অনেকগুলি তাজা প্রাণ। যার মধ্যে ছিলেন রশিদের অন্যতম প্রিয় বন্ধুও। যার মৃত্যুর যন্ত্রণা বুকে নিয়েই খেলে চলেছেন এই বিস্ময় ক্রিকেটার।
প্রথম বল থেকেই আক্রমণে চলে যান রশিদ। তাঁর অপরাজিত ইনিংসে রয়েছে দু’টি চার, চারটে ছয়। প্রায় সাড়ে তিনশোর কাছে স্ট্রাইক রেট। রশিদ ব্যাট করতে নামার পরে শিবম মাভি এবং প্রসিদ্ধ কৃষ্ণের করা শেষ তিন ওভারে যথাক্রমে উঠল ১৪, ১২, ২৪। মোট ৫০। ওখানেই লড়াই করার প্রথম রশদটা পেয়ে যায় হায়দরাবাদ।
যেখান থেকে অসাধারণ বোলিংয়ে দলকে ফাইনালে তুলে দিলেন এই লেগস্পিনার। তাঁর একটা গুগলিতে সুইপ করতে গিয়ে এলবিডব্লিউ হলেন ক্রিস লিন (৪৮)। রশিদের গুগলি এখন মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মতো ক্রিকেটারও বুঝতে পারছেন না। কব্জির বদলে আঙুলের মোচড়়ে মাঝে মাঝে এই গুগলি করছেন রশিদ। সঙ্গে দ্রুত অ্যাকশন এবং বলের গতি ব্যাটসম্যানদের কাজটা আরও কঠিন করছে। এর ঠিক পরেই শাকিব-আল-হাসানের বলে আন্দ্রে রাসেলের ক্যাচ ছাড়লেন ঋদ্ধিমান সাহা। ইডেন আবার গর্জে উঠল। কোনও উপায় না দেখে তখনই রশিদের চতুর্থ ওভার করানোর সিদ্ধান্ত নিলেন কেন উইলিয়ামসন।
স্লিপ তো ছিলই। রাসেলকে চাপে ফেলতে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগও নিয়ে এলেন হায়দরাবাদ অধিনায়ক। কিন্তু রশিদের বলটা মিডল লেগ স্টাম্পের ওপরে পড়ল না। তাঁর হাত থেকে বেরোল একটা গুগলি, অফস্টাম্পের ওপর। রাসেলের কাট চলে গেল স্লিপে। বক্সিংয়ের ভাষায় একে বলা হয় ‘ডাবল ব্লাফ’। ডান হাতের ওয়ান-টু পাঞ্চটা বিপক্ষকে লক্ষ্য করে মারলেও বাঁ হাতটাই তখন হয়ে ওঠে আসল অস্ত্র। ডান হাতের ওপর যখন নজর প্রতিপক্ষের, বাঁ হাতের পাঞ্চটা শুইয়ে দেয় শত্রুকে। রশিদের ‘বাঁ হাতটা’ যে মাথায় রাখেননি রাসেল (৩)। এর পরে শুভমন গিল (২০ বলে ৩০) যে লড়াইটা করলেন, তা ভবিষ্যতের সম্পদ হয়ে থাকবে। কিন্তু ম্যাচ জেতানোর বারুদ হল না।
এই ম্যাচ হারার পরে কেকেআর ময়নাতদন্তে বসলে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে। কেন রশিদকে ওই রিভার্স সুইপটা মারলেন রবিন উথাপ্পা? বিশেষ করে দিন কয়েক আগেই যখন আনন্দবাজারকে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি এখন ঝুঁকি নিয়ে শট খেলা ছেড়ে দিয়েছি। দলের স্বার্থই সবার আগে।’’ দেখা যাচ্ছে, রিভার্স সুইপের ভূত যাচ্ছেই না ইডেন থেকে।
আফগানিস্তানের এক ক্রিকেটারের সঙ্গে ইডেনের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল। যাঁকে পাগলের মতো ভালবাসত ক্রিকেটের নন্দনকানন। শুক্রবার আর এক আফগান ক্রিকেটার শোকে ডুবিয়ে দিয়ে গেলেন ইডেনকে। দ্বিতীয় জন যে রশিদ খান, তা বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
আর প্রথম জন? সেলিম দুরানি! আফগানিস্তানে জন্মানো ভারতের একমাত্র ক্রিকেটার!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy