গোল পোস্টকে লক্ষ করে পায়ের ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে অথবা ২২ গজের যুদ্ধ জয়ের প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ে চোট পাননি এমন খেলোয়াড়ের খোঁজ পাওয়া মুশকিল। যোদ্ধা দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হোন বা সবে সবুজ ঘাসের যুদ্ধক্ষেত্রে পা দিয়েছেন এমন নবাগত, ঘায়েল হওয়ার অভিজ্ঞতা সকলেরই কম-বেশি আছে।
কলকাতার সবুজ ঘাসের রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের অবশ্য চোট পেলে নাজেহাল হতে হয় একটু বেশি। সরকারি তো দূর, বেসরকারি হাসপাতালেও আধুনিক পদ্ধতি ও প্রযুক্তির সাহায্যে খেলোয়ারদের চিকিৎসার আলাদা বিভাগ নেই। খেলোয়াড়দের জন্য কোনও উন্নত স্পোর্টস মেডিসিনের বিভাগ নেই।
কী থাকে একটি উন্নত স্পোর্টস মেডিসিন বিভাগে? সেখানে চিকিৎসক প্রথমে গেট অ্যান মোশন অ্যানালিসিস ল্যাবরেটরিতে চোট পাওয়া খেলোয়াড়কে প্র্যাকটিস করতে বলেন। প্র্যাকটিসের সময়ে ক্যামেরা ও ত্রিমাত্রিক এফেক্টের সাহায্যে চিহ্নিত করা হয় খেলোয়াড়ের কোথায় সমস্যা হচ্ছে। সমস্যা বুঝে শুরু হয় চিকিৎসা। যাঁরা লাফ দেওয়ার সময়ে দু’পা একসঙ্গে মাটিতে ফেলতে পারেন না, তাঁদের জন্য রয়েছে ব্যালেন্স অ্যাসেসমেন্টের ব্যবস্থা। অ্যাকোয়াটিক ট্রেডমিলে হাঁটুর অস্ত্রোপচারের পরে বুক পর্যন্ত জলে দাঁড়িয়ে পায়ের ব্যায়াম করান প্রশিক্ষিত কর্মীরা। চিকিৎসকেরা বলছেন, খেলোয়াড়েরা বারবার হাঁটুতে চোট পান। অস্ত্রোপচারের পরে স্বাভাবিক ভাবে হাঁটাতে সময় লাগে। কিন্তু অ্যাকোয়া ট্রেডমিলে নিয়মিত ব্যায়ামে দ্রুত সুস্থ হওয়া সম্ভব। অস্থিবিশেষজ্ঞ ও স্নায়ুশল্য চিকিৎসকদের পরামর্শের পাশাপাশি খেলোয়াড়দের সুস্থ জীবনের জন্য এই প্রযুক্তি কাজে লাগানো হয়।
কলকাতায় এই সব প্রযুক্তি স্বপ্নের মতো হলেও সাগরপাড়ের শহরে এই সব বাস্তব। মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন ধীরুভাই অম্বানি হাসপাতালে খেলোয়াড়দের জন্য আধুনিক চিকিৎসা পরিষেবা রয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, খেলোয়াড়েরা যেন একই ছাদের তলায় সব রকম পরিষেবা পান। সেই উদ্দেশেই এই বিভাগ। চিকিৎসক রাম নারায়ণ বলেন, ‘‘খেলোয়াড়দের প্র্যাকটিসের সময়ে নানা শারীরিক সমস্যা হয়। সেই সব সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্যই এই পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে।’’
চিকিৎসকদের একাংশ মনে করছেন, সরকারি ও বেসরকারি স্তরে খেলোয়াড়দের চিকিৎসা পরিকাঠামো নিয়ে চিন্তাভাবনা কম। এক ছাদের তলায় এই ধরনের আধুনিক প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ স্পোর্টস মেডিসিন সেন্টার গড়ে তুলতে যা ব্যয় হবে তা সামলানোর সামর্থ্য কলকাতার সরকারি হাসপাতাল তো দূর, বেসরকারি হাসপাতালেও নেই। বেসরকারি সংস্থাগুলি স্পোর্টস মেডিসিনে পুঁজি লগ্নি করতেও শঙ্কিত হয়। কারণ কলকাতায় এই ধরনের পরিষেবা কতটা জনপ্রিয় হবে, তা নিয়ে অনেকের সন্দেহ রয়েছে। তবে সব থেকে বড় সমস্যা হল, এই প্রযুক্তি পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী কলকাতায় পর্যাপ্ত নেই। স্পোটর্স মেডিসিনের চিকিৎসক পুষ্পকেতু কোনারের মন্তব্য, ‘‘কলকাতা যে খেলাধুলোর পরিকাঠামো নিয়ে বিশেষ ভাবে না, সেটি এই অলিম্পিকের সময়ে ভাল বোঝা গিয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি চাইলে মানসিকতার বদল সব থেকে জরুরি।’’ অর্থোপেডিক সার্জেন চিকিৎসক রামেন্দু হোমচৌধুরী বলেন, ‘‘এই ধরনের উন্নত প্রযুক্তি কলকাতায় খুব দরকার। পেশাদার খেলোয়াড় ছাড়াও খেলতে গিয়ে ছোটরাও অনেক রকম চোট ঠিক মতো বোঝা যায় না বলেই সেগুলি নিয়ে দীর্ঘদিন ভুগতে হয়।’’ তাঁর সঙ্গে সহমত চিকিৎসক মৌলিমাধব ঘটক। তাঁর কথায়, ‘‘পেশাদার খেলোয়াড় গড়ে তুলতে এমন পরিষেবা খুব জরুরি। এর দ্বারা খেলোয়াড়দের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও উপকৃত হবেন।’’
কলকাতার খেলোয়াড়েরা চাইছেন পরিস্থিতির বদলাক। উন্নত স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর সুবিধা পাক শহরে সবুজ মাঠের তারারা। ফুটবলার ভাস্কর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমাদের সময়ে যে কোনও চোটের জন্য অস্থিবিশেষজ্ঞদের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হত। এখন চিকিৎসা পরিষেবা অনেক উন্নত হয়েছে। তবে খেলোয়াড়দের জন্য কলকাতার চিকিৎসা পরিষেবায় আরও অনেক উন্নতি দরকার।’’ মুম্বাইয়ের হাসপাতালের পরিষেবার কথা শুনে ক্রিকেটার সৌরাশিস লাহিড়ী বলেন, ‘‘বারবার চোট পেয়েছি, কিন্তু তার থেকে রেহাই পেতে তাকিয়ে থাকতে হয়েছে ফিজিও থেরাপিস্টদের দিকে। তাঁদের দক্ষতার জন্যই সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়েছি। শহরে উন্নত পরিকাঠামো না থাকায় ভুগতে হয়েছে অনেক। এক জন ভাল খেলোড়ার শুধু মাঠে নেমে খেলেই তৈরি হন না, তাঁর শারীরিক সুস্থতার দিকটা দেখাও খুব দরকার। সেই সব পরিকাঠামো ঠিক মতো তৈরি না হলে খেলোয়াড়ের ভাল পারফরমেন্স পাওয়া মুশকিল। তবে বিজ্ঞানের ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে। আশা রাখছি, আমাদের পরের প্রজন্ম কলকাতাতেই এই সব পরিষেবা পাবে।’’ একই আশা টেবিল টেনিস খেলোয়াড় পৌলোমী ঘটকের। বলেন, ‘‘খেলোয়াড়ের স্বাস্থ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতায় এক ছাদের তলায় এই রকম পরিষেবা কখনও পাইনি। নিজেরা সমস্যা চিহ্নিত করতে পারলে তবেই বিশেষজ্ঞদের কাছে যেতাম ও সমস্যার সমাধান পেতাম। কলকাতাতেও এমন আধুনিক পরিকাঠামো গড়ে উঠুক।’’
রাজ্যের যুব কল্যাণ ও ক্রীড়া মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বলেন, ‘‘রাজ্যের স্পোর্টস মেডিসিনের পরিকাঠামো কেন উন্নত নয়, সেই বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখছি। ক্রীড়া দফতরের এই বিষয়ে কিছু করার থাকলে অবশ্যই তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy