উল্লসিত: কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে গোল করার পরে সতীর্থদের সঙ্গে ওসাকো (মাঝখানে)। মঙ্গলবার মার্দোভিয়া এরিনায়। ছবি: এএফপি
জাপান ২ : কলম্বিয়া ১
প্রচণ্ড আতঙ্কের মধ্যে সারা দিন কাটিয়েছি। চব্বিশ ঘণ্টা আগেই ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল জাপানের ওসাকা। সরকারি হিসেব চার জন মারা গিয়েছেন। আহতের সংখ্যা তিনশোরও বেশি। আমি থাকি এহিমে শহরে। ওসাকা থেকে দূরত্ব প্রায় ৩২৫ কিলোমিটার। আমার শহরে ভূমিকম্পের প্রভাব না পড়লেও উৎকণ্ঠার মধ্যেই ছিলাম। মঙ্গলবার বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে দুরন্ত জয়ের পরে আতঙ্ক কাটিয়ে উঠেছি।
কলম্বিয়ার ফিফা র্যাঙ্কিং ১৬। তার উপর হামেস রদ্রিগেস, রাদামেল ফালকাওয়ের মতো তারকারা রয়েছেন। ফিফা র্যাঙ্কিংয়ে জাপানের স্থান ৬১ নম্বরে। তাই আমরা কেউ আশা করিনি, বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে শক্তিশালী কলম্বিয়াকে হারিয়ে দেবেন শিনজি কাগাওয়ারা। এই কারণেই এই ম্যাচ নিয়ে শহরে সে রকম উন্মাদনা চোখে পড়েনি। তা ছাড়া এহিমে এখন বর্ষাও শুরু হয়ে গিয়েছে। আমি স্ত্রীর সঙ্গে বাড়িতে বসেই ম্যাচটা দেখেছি। তবে জানতাম শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে জাপানের ফুটবলাররা। কারণ, ফুটবল বিশ্বে জাপান এখন আর শিশু নয়। জাপান এখন অনেক পরিণত।
আমাদের কাজটা আরও সহজ হয়েছিল ৩ মিনিটের মধ্যে হ্যান্ডবল করার পরে লাল কার্ড দেখে কলম্বিয়ার কার্লোস স্যাঞ্চেস মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ায়। কলম্বিয়া দশ জন হয়ে পড়ায় জাপানের সুবিধেই হয়েছে। পেনাল্টি থেকে গোল করতে ভুল করেননি কাগাওয়া।
আমার মতে এই গোলটাই ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট। কারণ, এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও জাপান কখনও রক্ষণাত্মক খেলার চেষ্টা করেনি। গোলের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়েছে। অনেকের ধারণা, শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দুর্বল দল মাঠে নামে রক্ষণাত্মক রণনীতি নিয়ে। জাপানের ফুটবল দর্শনটা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। ব্রাজিলের মতো আমরাও মাঠে নামি যত বেশি সম্ভব গোল করার লক্ষ্য নয়। অবশ্য এর নেপথ্যে সব চেয়ে বেশি অবদান ব্রাজিলের এক কিংবদন্তির। তিনি— জ়িকো। জাপান ফুটবলের সংস্কৃতি যিনি একাই বদলে দিয়েছেন।
নব্বইয়ের দশকে কাশিমা আন্তোরাসের হয়ে ‘জে’ লিগ খেলতে জাপানে আসেন জিকো। পাঁচ বছর খেলার পরে কোচ হন। তার পরে জাপানের জাতীয় দলেরও কোচ ছিলেন চার বছর। আমার অনেক বন্ধু জ়িকোর কোচিংয়ে খেলেছে। ওদের কাছে শুনেছি ব্রাজিল কিংবদন্তির কোচিংয়ের কাহিনি। জ়িকো ওদের বলতেন, ‘‘সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ফুটবলকে উপভোগ করা। খেলে যদি আনন্দ না পাও, তা হলে লাভ নেই। ম্যাচে জয়-পরাজয় থাকবেই। কিন্তু সেটাই সব নয়। আসল হচ্ছে, খেলার পরে তৃপ্তি নিয়ে তোমরা মাঠ ছাড়তে পারছ কি না, সেটা।’’ শুধু তাই নয়। জ়িকো জাপানের ফুটবলারদের বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিলেন যে, তাঁরা কারও চেয়ে কম নন। এ বারের জাপানে দলটার দিকে তাকান। অধিকাংশই ইউরোপের বিভিন্ন শক্তিশালী লিগে খেলছেন। ফলে প্রত্যেকেরই সর্বোচ্চ স্তরে খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে। কলম্বিয়া ম্যাচেই তা প্রমাণিত।
২০০২ সালে জ়িকোর কোচিংয়েই আমরা প্রথম বার বিশ্বকাপের শেষ ষোলোয় উঠেছিলাম। গোটা বিশ্ব জেনেছিল, জাপান মানেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, আগ্নেয়গিরি, সুমো বা ভূমিকম্পের দেশ নয়। ফুটবল মাঠেও জাপান প্রতিপক্ষের ঘুম কেড়ে নিতে পারে। অনেকেই অবশ্য বলে থাকেন, ২০০২ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে যৌথ ভাবে বিশ্বকাপের আয়োজন করেছিল বলেই মূলপর্বে খেলতে পেরেছে জাপান। না হলে যোগ্যতা অর্জন করতে পারত না। বিশ্বকাপে কিন্তু আমরা প্রথম খেলি ১৯৯৮ সালে। সে বার আয়োজক ছিল ফ্রান্স। আমরা যোগ্যতা অর্জন করেই মূলপর্বে খেলার ছাড়পত্র পেয়েছিলাম। তার পর থেকে আমরা সব বিশ্বকাপের মূলপর্বে খেলছি। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে ফের শেষ ষোলোয় উঠেছিলাম।
২০০৬ সালে জ়িকো জাপানের জাতীয় দলের দায়িত্ব ছাড়েন। কিন্তু ওঁর দেখানো পথেই হাঁটছেন কোচ নিশিনো আকিরা। এ বছরই দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। জ়িকোর মতো তাঁরও প্রধান অস্ত্র আক্রমণাত্মক ফুটবল। কাগাওয়ার গোলের ৩৩ মিনিটের মধ্যে সমতা ফেরান কলম্বিয়ার খুয়ান কিনতেরো। আমার মনে হচ্ছিল, জয়ের স্বপ্ন হয়তো অধরাই থেকে যাবে। কিন্তু ইউইয়া ওসাকো ৭৩ মিনিটে ২-১ করার পরে জয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যাই।
অপেক্ষা করুন, বিশ্বকাপে আরও চমক দেবে জাপান।
(লেখক ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের প্রাক্তন তারকা)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy