Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
নীরব যোদ্ধা

কাকতালীয়, ঋদ্ধির টেস্ট জীবনের সেরা ইনিংসটি এল ধোনির শহরেই

কোনও বাড়তি উচ্ছ্বাস নেই। হাত দু’টো আকাশের দিকে তুলে খুব নিয়ন্ত্রিত ভঙ্গিতে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। হেলমেট খুলে তেরঙ্গায় চুম্বন। মাথায় বানদানা জড়ানো এক ভারতীয় উইকেটকিপারের এই ছবি সারা জীবনের জন্য বাঙালির ক্রিকেট রূপকথায় ঢুকে পড়ল রবিবার।

সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০১৭ ০৪:৫৮
Share: Save:

কোনও বাড়তি উচ্ছ্বাস নেই। হাত দু’টো আকাশের দিকে তুলে খুব নিয়ন্ত্রিত ভঙ্গিতে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। হেলমেট খুলে তেরঙ্গায় চুম্বন। মাথায় বানদানা জড়ানো এক ভারতীয় উইকেটকিপারের এই ছবি সারা জীবনের জন্য বাঙালির ক্রিকেট রূপকথায় ঢুকে পড়ল রবিবার।

কী অসম্ভব গর্বিত দেখাচ্ছিল তখন আমাদের ঋদ্ধিমান সাহা-কে!

কলকাতার ময়দানে দস্তানা হাতে বড় হয়েছি একটা গল্প শুনতে শুনতে যে, খোকনদা (প্রবীর সেন) স্টাম্প করেছিলেন ডন ব্র্যাডম্যান-কে। বাঙালি উইকেটকিপারের বীরত্বের অ্যালবামে এত দিন ধরে সেটাই ছিল সম্ভবত সেরা মুহূর্ত। সেই গ্রহে ঢুকে পড়ল ঋদ্ধির সাফল্যের ছবি। ব্র্যাডম্যানের দেশের সঙ্গেই যেটা এল!

বাঙালি ক্রিকেটারের খেলা সেরা ইনিংসের সংগ্রহশালাতেও কি ঢুকে পড়ল না রবিবারের রাঁচী? পঙ্কজদার (পঙ্কজ রায়) মোট পাঁচটি টেস্ট সেঞ্চুরি আছে। বিনু মাঁকড়ের সঙ্গে সেই ঐতিহাসিক ৪১৩ রানের ওপেনিং পার্টনারশিপের ইনিংস রূপকথার অঙ্গ। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচে পঙ্কজদা করেছিলেন ১৭৩। লর্ডসে সৌরভের অভিষেক টেস্টের সেঞ্চুরি বাঙালির খুব প্রিয় এবং গর্বের মুহূর্ত। একটুও অতিরঞ্জিত করা হবে না যদি বাঙালির সেরা টেস্ট ইনিংসের তালিকায় ঋদ্ধির ১১৭-কেও রাখি।

চেতেশ্বর পূজারার সঙ্গে ঋদ্ধির পার্টনারশিপটা দেখতে দেখতে ২০০১ মার্চের ইডেনও মনে পড়ে যাচ্ছিল। সে দিন ভিভিএস লক্ষ্মণ আর রাহুল দ্রাবিড় সারা দিন ধরে ব্যাট করে অকল্পনীয় জয়ের রাস্তা তৈরি করেছিল। রবিবার পূজারা-ঋদ্ধি দু’টো সেশন অপরাজিত থেকে এই ম্যাচটাও ঘুরিয়ে দিল।

পূজারার ডাবল সেঞ্চুরিকে ছোট না করে বলছি, ঋদ্ধির ইনিংসটা গেমচেঞ্জার হয়ে থাকল। প্যাট কামিন্স ঘণ্টায় ১৪৫-১৪৮ কিলোমিটার গতিবেগে বল করছিল। ঋদ্ধি অসম্ভব সাহসিকতা আর দুরন্ত স্কিল দিয়ে কামিন্সের আগুন সামলালো। দুর্দান্ত কয়েকটা কভার ড্রাইভ মারল। বাইরের বল খুব ভাল ছাড়ল। তেমনই স্পিনারদের খেলল দারুণ ফুটওয়ার্ক ব্যবহার করে। অসাধারণ মনঃসংযোগও দেখাল।

নিজে উইকেটকিপার ছিলাম বলে জানি, আমাদের জীবনটা গোলকিপারের মতোই অনেক ক্ষেত্রে ‘থ্যাঙ্কলেস জব’। এই কিপিং গ্লাভস পরে সারা দিন দুর্গ সামলে উঠলে তো পরক্ষণেই ছোটো ব্যাট হাতে দলকে রক্ষা করতে। অস্ট্রেলিয়ার ৪৫১ রানে ১৩৭.৩ ওভার কিপিং করেছে ঋদ্ধি। তার পর ব্যাট হাতে দলের অন্যতম রক্ষাকর্তা হয়ে ২৩৩ বলে ১১৭। এই ইনিংস সেরার সংগ্রহশালায় ঢুকবে না তো কোনটা ঢুকবে! ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কে এল রাহুলের পরে ঋদ্ধির স্ট্রাইক রেটই সবচেয়ে ভাল ছিল। ডাবল সেঞ্চুরিতে চেতেশ্বরের স্ট্রাইক রেট ৩৮.৪৭। ঋদ্ধির ৫০.২১। যেটা প্রমাণ করছে যে, ও অস্ট্রেলীয় বোলারদের পাল্টা আক্রমণ করেছিল।

কাকতালীয় হয়তো যে, ঋদ্ধির টেস্ট জীবনের সেরা ইনিংসটি এল মহেন্দ্র সিংহ ধোনির শহরে। এর মধ্যে বাংলা বনাম ধোনির লড়াই বাধিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি না একেবারেই। এটা অর্থবহ লাগছে অন্য কারণে। ধোনির উপস্থিতির জন্য সাত বছরের ওপর ওকে ভারতীয় দলের বাইরে থাকতে হয়েছে। দেশের অনেক উইকেটকিপার এই সময়টাতে হতাশ হয়ে হারিয়েই গিয়েছে। ঋদ্ধি কিন্তু স্বপ্ন ছাড়েনি। নিজেকে ফিট রেখেছে।

ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফর্ম করে গিয়েছে। তারই সুফল পাচ্ছে এখন। কত অসামান্য, লড়াকু ইনিংস ও খেলেছে বাংলার হয়ে। একটা ইনিংস খুব মনে পড়ছে। ইনদওরে মধ্যপ্রদেশের বিরুদ্ধে খেলা। সেই ম্যাচটা হেরে গেলে আমরা রঞ্জিতে প্লেট গ্রুপে নেমে যাই। ঋদ্ধি একা রুখে দাঁড়িয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। দিল্লিতে ধোনিদের হারিয়ে বাংলা বিজয় হজারের ফাইনাল খেলতে নামছে আজ, সোমবার। তার আগের দিন ঋদ্ধির এমন অসাধারণ সেঞ্চুরি। সব মিলিয়ে বঙ্গ ক্রিকেটের জন্যই খুব ভাল একটা সময় যাচ্ছে মনে হয়।

ঋদ্ধির হার-না-মানা মনোভাবটা আমাকে বরাবর মুগ্ধ করেছে। নীরব যোদ্ধার মতো দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে যাবে। উইকেটকিপার হিসেবে বিরল ব্যতিক্রমী এক চরিত্র। আমি নিজে উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে খুব ভালবাসতাম। স্লেজ করে অনেক ব্যাটসম্যানের উইকেট নিয়েছি। কিন্তু ঋদ্ধিকে দিয়ে এটা কেউ করাতে পারল না। ওর ছোটবেলার কোচ জয়ন্ত ভৌমিক আমার খুব ভাল বন্ধু। রবিবার রাঁচীর সেঞ্চুরিটা হওয়ার পরেই ঋদ্ধির বাবা আর কোচের সঙ্গে কথা বলছিলাম। জয়ন্ত আর আমি বলাবলিও করছিলাম, মুখচোরা ছেলেটা সেই মুখচোরাই থেকে গেল।

আবার পরে মনে হচ্ছিল, কী দরকার পাল্টানোর? এই চরিত্রটার মধ্যেও একটা অন্য রোম্যান্টিকতা আছে। পুরনো আমলের সেই জেন্টলম্যান ক্রিকেটারের মতো। মুখে খারাপ কথা আওড়ায় না। বাইরেটা শান্ত কিন্তু ভিতরে আগুন আছে। নীরবে প্রতিপক্ষকে পু়ড়িয়ে দিতে পারে অন্তরের সেই আগুন।

ধোনির শহরে সেঞ্চুরিটা হল বলে তুলনা শুরু করে দিয়েছে অনেকে। আমি বলব, উইকেটের পিছনে বরাবরই ঋদ্ধি এগিয়ে ছিল। তবে উইকেটের সামনে ধোনিই সম্ভবত সর্বকালের সেরা। ব্যাট হাতে আর কোনও ভারতীয় উইকেটকিপার ধোনির মতো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। তবে রাঁচীতে ঋদ্ধি দেখিয়ে দিয়েছে ব্যাট হাতেও ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। কয়েক দিন আগেও পার্থিব পটেল ভাল ব্যাট করে দেওয়ায় অযথা ঋদ্ধিকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। কেউ মনে রাখেনি, ঋদ্ধির চোট ছিল বলেই পার্থিবকে আনা হয়েছিল। ঋদ্ধি খারাপ তো খেলেনি। তবু ওর ফেরা নিয়ে অহেতুক জলঘোলা হয়েছিল।

রাঁচীর এই ইনিংস সে দিক দিয়ে সিদ্ধিলাভ ঘটিয়ে দিল। মনে হয় না, এর পর আর ঋদ্ধির ব্যাটিং দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ওকে অসম্মান করার সাহস পাবে কেউ। বরং আমার মনে হচ্ছে, অশ্বিনকে ছয় নম্বর থেকে সরিয়ে ফের ঋদ্ধিকে ওপরে তুলে নিয়ে আসা হবে কি না, সেই আলোচনা শুরু হয়ে যাবে এ বার।

শাবাশ ঋদ্ধি, শাবাশ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Wriddhiman Saha Bengal Cricket India Record
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE