শেষ ওভারে ইংল্যান্ড অধিনায়ককে ফিরিয়ে জাডেজাদের গর্জন। ছবি: পিটিআই
চা বিরতির পরে মাঠে নামার আগে টিম হাডল ডাকলেন বিরাট কোহালি। তিনিই সেখানে বক্তা। বাকিরা বাধ্য শ্রোতা।
বেশ উত্তেজিত ভাবে কয়েক মিনিট কিছু বলতে দেখা গেল বিরাটকে। বিরাটের একপাশে ঋদ্ধিমান সাহা। অন্য দিকে অজিঙ্ক রাহানে। কথা শেষ করে এই দু’জনের পিঠ চাপড়ে ‘চল ফির’ বলে মাঠে নেমে পড়েন বিরাট। তাঁর চোয়াল শক্ত।
এর অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ কিছু না জেনে দৃশ্যটা দেখলে মনে হতেই পারে, জয়ের শপথ নিয়ে মাঠে নামার আগে বিরাটদের এই হাডল। লক্ষ্য হয়তো আর বেশি দূরে নেই। কয়েকটা উইকেট মাত্র। তার পরেই আসবে কাঙ্খিত মুহূর্ত।
বাস্তবের ক্যানভাসটা কিন্তু তখন অন্য রকম। সেখানে এত রং নেই। বরং ফিকে হয়ে আসা কতগুলো দুর্বোধ্য আঁকিবুকি। সেগুলো দিয়ে যে শেষ পর্যন্ত কী ছবি দাঁড়াবে, তার কোনও স্থিরতা নেই। সে জন্যই তো সতীর্থদের এই ভাবে তাতানো বিরাটের। ইনিংসের প্রথম দু’ঘণ্টায় ইংরেজ ওপেনারদের উপর তাঁর বোলাররা একটুও থাবা বসাতে পারছেন না দেখেই চিন্তিত বিরাটের ওই টিম হাডল ডাকা।
ভারত যে তখন ক্রমশ খাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সংকল্পের আর এক ঝান্ডা নিয়ে মাঠের মাঝের বাইশ গজ দখল করে বসে তখন দুই ব্রিটিশ সিংহ। অ্যালিস্টার কুক ও হাসিব হামিদ। মাঠে নামার আগে মস্তিষ্কে যেন ডাউনলোড করে নিয়েছিলেন ওই প্রবাদটা— স্লো বাট স্টেডি, উইনস দ্য রেস।
অশ্বিন, জাডেজার হাতে বল দিয়ে উইকেটকিপার ও চার ফিল্ডারকে দিয়ে কুক, হামিদকে ঘিরে ধরেও কিছু লাভ হচ্ছিল না। পোড়খাওয়া ক্যাপ্টেন কুক ও আনকোরা হাসিব হামিদকে দেখে তখন বোঝার উপায় নেই, তাঁরাও প্রবল চাপে। কুককে ফেরানোর চেষ্টায় দু-দু’খানা রেফারেলের কোটাও অশ্বিনরা শেষ করে ফেলেন।
অবশেষে সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত এল। এল শেষ দশ ওভারে। প্রথমে হামিদ আর দিনের শেষ বলে কুক। যাঁরা প্রথম ৫০ ওভারে দলকে ৭৫ রান দেওয়ার সঙ্গে ভারতকেও ক্রমশ দেওয়ালের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলেন, তাঁদের ফেরাতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ল ভারতীয় শিবিরে।
হামিদকে এলবিডব্লিউ করার পর অশ্বিনের উল্লাসের বহর দেখেই বোঝা গেল কতটা চাপে ছিলেন। দিনের শেষ বলে কুককে এলবি-র ফাঁদে ফেলেন জাডেজা। রেফারেল নিয়েও নিজেকে বাঁচাতে পারলেন না ইংরেজ ক্যাপ্টেন।
সোমবার, ম্যাচের শেষ দিন ভারতের চাই আট উইকেট আর ইংল্যান্ডের ৩১৮ রান। রুট আর কুক শেষ দিন তাজা হয়ে নামলে হয়তো চাপ বাড়ত ভারতের। স্বস্তি সে জন্যই। যদিও জো রুট আছেন উইকেটে। ড্রেসিংরুমে মইন, স্টোকস, বেয়ারস্টো। তাঁরাও কুকদের মতো ইস্পাতকঠিন হওয়ার আদর্শ নিয়েই নামবেন। কিন্তু এই উইকেটে শেষ দিন টিকে থেকে নিদেনপক্ষে ম্যাচ বাঁচাতে পারলেও সেটা হবে অঘটন।
কুকের ডিফেন্সে আটকে বিরাট। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
বছরখানেক আগে ফিরোজ শাহ কোটলায় কী হয়েছিল মনে নেই? ঠিক এ রকমই পরিস্থিতিতে চতুর্থ ইনিংসে ৪৮১-র টার্গেট নিয়ে ব্যাট করতে নামে দক্ষিণ আফ্রিকা। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছিলেন এবি ডেভিলিয়ার্স ও হাসিম আমলা। এবি-র ২৯৭ বলে ৪৩ ও আমলার ২৪৪ বলে ২৫ ভারতীয় বোলারদের পাগল করে দিয়েছিল। কিন্তু এত করেও শেষ পর্যন্ত ম্যাচ বাঁচাতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। ১৪৩ রানে অল আউট হয়ে যায়। বরাবরের মতো সে বারও পাঁচ উইকেট নিয়ে দলকে জিতিয়েছিলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। এ বার তাঁর দিকেই তাকিয়ে সারা দেশ।
তা ছাড়া ভারতের মাটিতে চতুর্থ ইনিংসে সবচেয়ে বড় রান তুলে জয়ের স্কোর ৩৮৭। আট বছর আগে যা করেছিল ভারতই। এই ইংল্যান্ডেরই বিরুদ্ধে, চেন্নাইয়ে। কুকদের সামনে তো এই টেস্টে ৪০৫-এর টার্গেট। এই রান তাড়া করে জেতা বিশাখাপত্তনমে এসে তাজমহল দেখার মতোই অলীক, অবাস্তব।
আর এই নিয়েই দিনের শেষে দুই শিবিরের মধ্যে লেগে গেল তরজা। চেতেশ্বর পূজারা বলে দিয়ে গেলেন, ‘‘এই উইকেটে ব্যাটসম্যানদের যেমন ধৈর্য ধরতে হবে, তেমন বোলার, ফিল্ডারদেরও পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলতে হবে। তবে রানটা এতটাই বড় যে, ওদের পক্ষে এখানে ম্যাচ বাঁচানো সম্ভব নয়।’’
স্টুয়ার্ট ব্রড তাই শুনে পাল্টা হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘‘কেন সম্ভব নয়? কুক আর হামিদের মতো কাল যদি আমাদের আর দু-তিনজন ব্যাটসম্যান খেলে দেয়, তা হলেই আমরা ম্যাচ বাঁচিয়ে দিতে পারব। উইকেটের যা অবস্থা, তাতে পড়ে থেকে ব্যাট করা যায়। আমাদের সেটাই করতে হবে। সকালের দেড় ঘণ্টা আমাদের উইকেটে টিকে যেতে দিন না। তা হলেই দেখবেন ভারত কেমন চাপে পড়ে যায়।’’
সকালের সেশনে চাপে অবশ্য নিজেদেরই ফেলে দিয়েছিলেন ভারতীয়রা। যখন রবিবার ছুটির বিশাখাপত্তনম স্টেডিয়ামমুখো হয়ে উঠেছিল ভারতীয় ব্যাটিং দেখবে বলে। কোহালি যখন তাঁর আগের দিনের ৫৬-র পর থেকে ব্যাটিং শুরু করেন, তখন নয় নয় করে আঠাশ হাজারি গ্যালারির অর্ধেক আসন ভর্তি। টেস্ট ক্রিকেটে এটাই এখন ‘বিগ ক্রাউড’। আর ক্রিজে যখন ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ক্রাউডপুলার, তখন তো সবাই ছুটে আসবেই।
কিন্তু তাদের হৃদয় ভাঙল, যখন কোহালি ৮১ রানে আদিল রশিদের ফ্লাইটেড লেগব্রেকে ড্রাইভ করতে গিয়ে স্লিপে বেন স্টোকসের হাতে ধরা পড়ে যান। ডান দিকে ঝাঁপিয়ে যে অসাধারণ ক্যাচটা নিলেন স্টোকস, তা কোহালির মত ‘প্রাইজড’ উইকেটের সঙ্গেই মানিয়ে যায়। কোহালি আউট হয়ে গিয়ে তাঁর ভক্তদের দুঃখ দিয়ে গেলেন বটে, তবে স্টোকসের ক্যাচটা ক্রিকেটভক্তদের মনে থাকবে।
কিন্তু বিরাট আউট হতেই বাকিরা লাইন লাগালেন কেন, সেটা বোঝা গেল না। ১১৭-৩ থেকে ভারত ২০৪-এ শেষ! ৮৭ রানে সাত উইকেট পড়ল দিনের প্রথম দু’ঘণ্টার মধ্যেই! শেষ উইকেটে মহম্মদ শামি আর জয়ন্ত যাদবের ৪২ রানের পার্টনারশিপটা না হলে ইংল্যান্ডের সামনে চারশোর টার্গেটও খাড়া করতে পারত না ভারত। দ্বিতীয় ইনিংসে কোহালির পর ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সর্বোচ্চ রান যাঁর, তিনি জয়ন্ত, ২৭। আর রাহানে ২৬। শামি আবার পরপর দুটো ছয় হাঁকিয়ে ইনিংস শেষ করেন।
ভারতীয় ব্যাটিংয়ে কি বিরাট কোহালি ছাড়া আর কোনও নাম নেই, যার উপর ভরসা করা যায়?
ভারত টেস্ট জিতলেও এই প্রশ্নটা কিন্তু রয়েই যাবে।
স্কোর:
ভারত প্রথম ইনিংস: ৪৫৫
ইংল্যান্ড প্রথম ইনিংস: ২৫৫
ভারত দ্বিতীয় ইনিংস (আগের দিন ৯৮-৩): কোহালি ক স্টোকস বো রশিদ ৮১, রাহানে ক কুক বো ব্রড ২৬, অশ্বিন ক বেয়ারস্টো বো ব্রড ৭, ঋদ্ধিমান এলবিডব্লিউ রশিদ ২, জাডেজা ক মইন বো রশিদ ১৪, জয়ন্ত ন.আ. ২৭, উমেশ ক বেয়ারস্টো বো রশিদ ০, শামি স্টাঃ বেয়ারস্টো বো মইন ১৯, অতিরিক্ত ১৪, মোট ২০৪। পতন: ১৬, ১৭, ৪০, ১১৭, ১২৭, ১৩০, ১৫১, ১৬২, ১৬২। বোলিং: অ্যান্ডারসন ১৫-৩-৩৩-১, ব্রড ১৪-৫-৩৩-৪, রশিদ ২৪-৩-৮২-৪, স্টোকস ৭-০-৩৪-০, মইন ৩.১-১-৯-১।
ইংল্যান্ড দ্বিতীয় ইনিংস: কুক এলবিডব্লিউ জাডেজা ৫৪, হামিদ এলবিডব্লিউ অশ্বিন ২৫, রুট ন.আ. ৫, অতিরিক্ত ৩, মোট ৮৭-২। পতন: ৭৫, ৮৭। বোলিং: শামি ৯-২-১৬-০, উমেশ ৮-৩-৮-০, অশ্বিন ১৬-৫-২৮-১, জাডেজা ২২.২-৮-২৫-১, জয়ন্ত ৪-১-৭-০।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy