Advertisement
E-Paper

সনি মাঠ ছাড়তেই অন্ধকার নেমে এল সঞ্জয়ের বাগানে

‘‘যে দল তিন গোল দিয়ে তিন গোল খায়, তাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কোনও যোগ্যতাই নেই। সব দোষ আমার। রক্ষণটা হয়তো আমি-ই ঠিক করতে পারিনি। কিংশুকের জায়গায় বালমুচুকে নামালাম সে-ও তো ডোবাল,’’ ক্ষোভ আর হতাশার মিশেল হয়ে যেন ঝরে পড়ল বাগান কোচের কথাগুলো।

রতন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:৫৩
চোটের জন্য আটকে গেলেন সনি নর্ডি। আটকে গেল মোহনবাগানও। শনিবার বারাসতে। -ছবি-শঙ্কর নাগ দাস

চোটের জন্য আটকে গেলেন সনি নর্ডি। আটকে গেল মোহনবাগানও। শনিবার বারাসতে। -ছবি-শঙ্কর নাগ দাস

মোহনবাগান-৩ : শিবাজিয়ান্স ৩
(কর্নেল ২, সনি) (জুয়ান ২, ডিপান্ডা)

পায়ে বরফ বেঁধে খোঁড়াতে খোঁড়াতে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেলেন সনি নর্ডি। তীব্র যন্ত্রণাবিদ্ধ মুখ নিয়ে।

ম্যাচ সেরার পুরস্কারটা নেওয়ার সময় কর্নেল গ্লেনকে দেখে মনে হল বিষ গিলছেন!

কাতসুমি-প্রণয়-জেজেরা এমন মুখ নিয়ে ড্রেসিংরুমে ঢুকছিলেন দেখে মনে হচ্ছিল শববাহী যাত্রী। সদ্য কোনও আত্মীয় বিয়োগ হয়েছে যেন।

তাঁর ব্রিগেডের প্রায় সবাই যখন ফিরে গিয়েছেন, তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে সঞ্জয় সেন। আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাঁকিয়ে তিনি। মুখটা রাগে যেন আরও লাল।

মিডিয়া রুমে এসে একইসঙ্গে তার বিস্ফোরণ এবং আত্মশুদ্ধি ঘটল।

‘‘যে দল তিন গোল দিয়ে তিন গোল খায়, তাদের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কোনও যোগ্যতাই নেই। সব দোষ আমার। রক্ষণটা হয়তো আমি-ই ঠিক করতে পারিনি। কিংশুকের জায়গায় বালমুচুকে নামালাম সে-ও তো ডোবাল,’’ ক্ষোভ আর হতাশার মিশেল হয়ে যেন ঝরে পড়ল বাগান কোচের কথাগুলো। ডার্বি ম্যাচের হারের পরেও যে গলায় ছিল আগুন, শিলং ম্যাচে ড্র করার পরও ছিল আশার বাণী, সেই মুখেই অমাবস্যা নামল এর পর। ‘‘না আর কোনও আশা নেই। সব শেষ। নিজেরাই সব শেষ করে দিলাম।’’

বাগান নামক অশ্বমেধের ঘোড়ার শেষ ল্যাপে এসে এ ভাবে অপমৃত্যু হবে, এটা মনে হয় বাগান সমর্থকদের মতো স্বপ্নেও ভাবেননি তাঁদের কোচও। আইজলের পাহাড় থেকে বারাসতের কৃত্রিম ঘাসের মাঠ— চার ম্যাচে দশ পয়েন্ট নষ্ট। প্রথম এগারো ম্যাচে সাত গোল খাওয়া বাগান রক্ষণ, শেষ চার ম্যাচে খেল নয় গোল। ভাবা যায়! এখনও লিগ টেবলের শীর্ষে। তবুও কার্যত আই লিগ থেকে বিদায়ঘণ্টা বেজে গেল গত বারের চ্যাম্পিয়নদের। সেরা টিমের মুকুট গড়িয়ে পড়ল রাস্তায়।

চৈত্র সেলের ভরা বাজার এবং বিধানসভা নির্বাচনের উত্তাপ। সঙ্গে তীব্র আর্দ্রতা আর গরম। তা সত্ত্বেও য হাজার দশেক বাগান সমর্থক ঢাক-ঢোল আর পতাকা বুকে নিয়ে মাঠে এসেছিলেন। ম্যাচের পর তাঁদের দেখলাম টিম বাসে ঘিরে ফুটবলারদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানাচ্ছেন। কেউ কেঁদে। কেউ হাতে ব্লেড দিয়ে কাটা রক্ত দেখিয়ে। ‘‘আমাদের আবেগের কোনও দাম নেই? কত কষ্ট করে খেলা দেখতে এসেছি জানেন। জেতা ম্যাচ হেরে গেলেন। কোনও দায়বদ্ধতা নেই।’’ আর তখনই স্টেডিয়াম ছেড়ে বেরোলেন সনি। ঘিরে ধরল মিডিয়া। ‘‘আমার পায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।’’ বাগানেরও সত্যি বলার মতো কিছু নেই। প্রতিবার সব দল চ্যাম্পিয়ন হয় না ঠিক। কিন্তু এ ভাবে বিদায়! দু’বার এগিয়ে গিয়েও ড্র। পরের বেঙ্গালুরু ম্যাচের তো কার্যত কোনও দামই থাকল না আর।

চোট পেয়ে ষাট মিনিটে যখন সনি বেরিয়ে গেলেন তখনও বাগান এগিয়ে ৩-২। হাইতি স্ট্রাইকার বসে গেলেন, সঞ্জয়ের টিমের বসন্তও সেই সঙ্গে উধাও হয়ে গেল। শুরু হয়ে গেল ডেরেক পেরেরার টিমের দৌরাত্ম্য। কিন্ত তা সত্ত্বেও তো জেতার সুযোগ ছিল বাগানের। ধনচন্দ্রের শট ক্রস পিসে লাগল। কর্নেল নষ্ট করলেন সহজতম সুযোগ।

ম্যাচটা কিন্তু স্কোরবোর্ডের প্রতীকী হয়ে রইল। হাড্ডাহাড্ডি, রক্তক্ষয়ী। বিরতির আগেই পাঁচ-পাঁচটা গোল। এ বারের আই লিগে সম্ভবত কোনও ম্যাচে হয়নি। কী অসাধারণ বক্স টু বক্স ফুটবল! কোচেদের ঝুলি থেকে অঙ্ক কষে বিপক্ষকে পিষে ফেলার ধারালো অস্ত্র বের হচ্ছিল বারবার। বাগানের সঞ্জয় এবং শিবাজিয়ান্সের ডেরেক—দু’জনেই তো ভারতীয় ফুটবলের নতুন প্রজন্মের দুই শিক্ষিত কোচ। ফলে তাঁদের মগজাস্ত্রের যুদ্ধ মাঠে প্রভাব ফেলবে জানাই ছিল। কিন্তু তা বলে এ ভাবে? বাগানের কাছে এটা ছিল আই লিগের সেমিফাইনাল। খেতাবের যুদ্ধের লাইফ লাইন। ফলে জেতার জন্য মরিয়া সঞ্জয় শুরু থেকেই গ্লেন-সনিকে সামনে রেখে ঝাপটা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। গোল হচ্ছে না দেখে কিছুক্ষণের মধ্যেই অনূর্ধ্ব ২২ আজহারউদ্দিনকে বসিয়ে জেজেকেও নামিয়ে দিলেন। আর তাতেই বাগান-আক্রমণের ঢেউ তুলল। বাগান ১-০ এগোল। সঙ্গে শুরু হল যেন চৈত্রের কালবৈশাখীও। সেই সময় পুণের টিমটাকে দেখে মনে হচ্ছিল, কলকাতা লিগের কোনও ছোট ক্লাব। বড় দলের সামনে যাঁরা শুধুই রুখে যায়। সাত-আট জন মিলে দাঁড়িয়ে থাকে নিজেদের গোলের সামনে। বালেওয়াড়ি স্টেডিয়াম— যেটা ডিএসকে শিবাজিয়ান্সের হোম গ্রাউন্ড, সেখানে একটা বিশাল ছত্রপতি শিবাজির মূর্তি আছে, তার পাশ দিয়ে প্রতিদিন অনুশীলন করতে যান সুব্রত পাল-সন্দেশ ঝিঙ্গানরা। তা সত্ত্বেও সেই টিমটায় শিবাজির মতো কোনও মহাসাহসী নেই? যিনি একার হাতে সব বদলে দিতে পারেন। আর এটা ভাবতে ভাবতেই একটা ‘শিবাজি’ বেরোল ডেরেকের টিম থেকে। জুয়ান কায়রো বারেসো। স্পেনের এই মিডিও রিয়াল মাদ্রিদ অ্যাকাডেমির ফসল। তিন বছর খেলেছেন লা লিগায়। ছোট্টখাট্টো চেহারা কিন্তু কী ছটফটানি! তাঁর নিখুঁত দু’টো প্লেসিং ম্যাচটা জমিয়ে দিল পুরো বারাসত স্টেডিয়ামকে স্তব্ধ করে। জুয়ানের জোড়া গোলে ২-১ করল শিবাজিয়ান্স। সেটা অবশ্য ৩-২ হল কর্নেল আর সনির দু’টো অসাধারণ গোলে। বাগানের দুই বিদেশির মধ্যে কোনটা সেরা তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। তেমনই বিতর্ক হতে পারে, সনির ভাসিয়ে দেওয়া বল শিবাজিয়ান্সের কিপার সুব্রত পাল ধরে গোল লাইন টপকে ভিতরে ঢুকে গিয়েছিলেন কি না, তা নিয়েও। প্রেসবক্স থেকে মনে হল বলটা গোলে ঢুকেছিল। টিভি রিপ্লেও দেখিয়েছে সে রকমই। বাগানের গ্লেন বা কাতসুমি দৌড়ে গিয়েছিলেন সহকারী রেফারির দিকে, গোলের দাবিতে। লাভ হয়নি। রেফারির হাতে ততক্ষণে বাগান ক্রুশবিদ্ধ। গোল লাইন টেকনোলজির দাবি উঠেছে ম্যাচের শেষে। যা প্রতিবারই হয়। ফেডারেশন শুনে ঘুমোয়।

বাগানে অন্ধকার নেমেছে শনিবাসরীয় রাতে। আজ বাংলার আর এক টিমের বেঙ্গালুরুতে আলো জ্বালানোর পালা। দেখার, তারা কী করে? বাজারে অবশ্য জোর গুজব, ফেডারেশন কর্তারা অ্যাশলে ওয়েস্টউডের টিমকে খেতাব দিতে মরিয়া। রেফারির বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, কোচ-ফুটবলারদের সাসপেনশন এ সব নাকি সেই ইচ্ছের জের। কী যে হচ্ছে কে জানে!

মোহনবাগান: দেবজিৎ, প্রবীর, সঞ্জয়, লুসিয়ানো, ধনচন্দ্র, কাতসুমি, প্রণয়, লেনি (বিক্রমজিৎ), আজহার (জেজে), সনি (কেন ), কর্নেল।

i league mohan bagan sony norde
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy