Advertisement
০৪ মে ২০২৪

টিটিতে এখন টাকা দিলেই বাংলা দলে

আপনার ছেলে বা মেয়েকে সর্বভারতীয় টেবল টেনিস প্রতিযোগিতায় নামাতে চান, তা হলে এখনই এটিএমে লাইন দিন। অথবা দাঁড়িয়ে পড়ুন ব্যাঙ্কের কাউন্টারে। কুড়ি হাজার, দশ হাজার, ছয় হাজার বা পাঁচ হাজার টাকা ডোনেশন দিলেই মিলে যাবে পৌলমী ঘটক-মৌমা দাসদের সঙ্গে জাতীয় টিটি-তে খেলার সুযোগ।

রতন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৬ ০২:৪২
Share: Save:

আপনার ছেলে বা মেয়েকে সর্বভারতীয় টেবল টেনিস প্রতিযোগিতায় নামাতে চান, তা হলে এখনই এটিএমে লাইন দিন। অথবা দাঁড়িয়ে পড়ুন ব্যাঙ্কের কাউন্টারে ।

কুড়ি হাজার, দশ হাজার, ছয় হাজার বা পাঁচ হাজার টাকা ডোনেশন দিলেই মিলে যাবে পৌলমী ঘটক-মৌমা দাসদের সঙ্গে জাতীয় টিটি-তে খেলার সুযোগ। পাওয়া যাবে বাংলার জার্সি। মিলবে চাকরি বা স্কুলে ভর্তির সার্টিফিকেট।

প্রকাশ্যে এ রকম বিজ্ঞাপন না দিলেও রাজ্য টেবল টেনিস সংস্থা গোপনে এই নিয়ম চালু করে দিয়েছে খেলোয়াড়দের জন্য। কার্যত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, টাকা না দিলে এন্ট্রি পাঠানো হবে না।

যেমন গত বছর সিনিয়র জাতীয় টিটি প্রতিযোগিতায় নামার জন্য দুই খেলোয়াড়ের জন্য ধার্য করা হয়েছিল তিরিশ হাজার টাকা। পয়লা ডিসেম্বর থেকে ক্যাডেট এবং সাব জুনিয়র ন্যাশনাল হচ্ছে শিলিগুড়িতে। ওই প্রতিযোগিতায় নামার জন্য কোয়েল চক্রবর্তী, তিয়াসা মাইতি, রত্নাবলী পাঠক, স্নেহা পালদের বাবা-মাকে জোগাড় করতে হবে এন্ট্রি ফি চার হাজার টাকার বাইরেও ডোনেশনের আরও পাঁচ হাজার টাকা। অর্থাৎ মোট নয় হাজার টাকা।

অবাক ব্যাপার হল, নজিরবিহীন এবং নিয়ম বহির্ভূত এই নিয়ম যে সংস্থা চালু করেছে তার মাথায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে রয়েছেন লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার ও সাংসদ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়।

বেসরকারি স্কুল কলেজে ডোনেশন প্রথা চালু আছে ভর্তির জন্য। গ্রামে-গঞ্জে চেয়ার বা বেঞ্চ দিলে স্কুলের টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করা ছাত্র-ছাত্রীকে উত্তীর্ণ করে দেওয়া হয়েছে, এ রকম খবর মাঝেমধ্যে শিরোনাম হয়। কিন্তু রীতিমতো টাকার অঙ্ক বেঁধে দিয়ে ‘অযোগ্য’ খেলোয়াড়কে রাজ্যের জার্সি দেওয়ার কথা ময়দানে কখনও শোনা যায়নি।

টেবল টেনিসের নিয়মানুযায়ী যে কোনও জাতীয় প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন বিভাগে বাংলা দলের জার্সি গায়ে খেলার জন্য প্রথম আট জন বাছাই হয় র‌্যাঙ্কিং মেনে। এর পর আরও যে চার জনকে বাছাই করা হচ্ছে প্রতি বিভাগে, তাদের থেকেই নেওয়া হচ্ছে টাকা। যেমন এ বার শিলিগুড়ির অনূর্ধ্ব ১২ এবং ১৪-র চারটে গ্রুপের জন্য মোট ১৬ জনের কাছ থেকে মাথাপিছু চাওয়া হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। গতবার যা ছিল ছয় হাজার।

টাকার বিনিময়ে বাংলার জার্সি দেওয়া হয়? প্রেসিডেন্ট সোমনাথবাবুকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে তাঁর জামাতা রাজ্য টিটি সংস্থার সচিব দেবীপ্রসাদ বসু স্বীকার করেন, ‘‘টাকা আমরা নিই এবং জেলার মাধ্যমে চেকে টাকা নিই। জেলা সংস্থা কার থেকে কত টাকা নিচ্ছে জানি না। তবে আমরা কোনও টাকার অঙ্ক ঠিক করে দিই না।’’ কিন্তু যোগ্যতার বদলে ডোনেশনের টাকাকেই কেন প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে ছেলে-মেয়েদের নির্বাচনে? শুনে দেবীবাবুর মন্তব্য, ‘‘অনেকের বাবা-মা এসে ধরেন। জাতীয় প্রতিযোগিতায় খেলার সার্টিফিকেট পেলে চাকরি পেতে সুবিধে হয়, এ জন্যই তাঁরা আসেন আমাদের কাছে। কেউ বলেন, স্কুলে ভর্তি করতে সুবিধে হবে। তাই পাঠাই।’’ কিন্তু এটা তো চূড়ান্ত বেআইনি? নক্কারজনক ব্যাপার? এতে তো যোগ্যরা বঞ্চিত হয়? শুনে রাজ্য সচিব আমতা আমতা করেন। ‘‘টিমে সুযোগ পাওয়ার সঙ্গে টাকা দেওয়ার ব্যাপারটা এক করবেন না। ওরা ভালবেসে, সংস্থার স্বার্থে টাকা দিয়ে সাহায্য করেন আমাদের।’’ যা শুনে হাসেন অরূপ বসাক, মান্তু ঘোষ, পৌলমী ঘটক, মৌমা দাসদের খেলাটার অনেক কর্তাই। বারবার এর প্রতিবাদ করেও ফল পাননি এ রকম এক জেলা কর্তা বললেন, ‘‘দেবীবাবুরা দু’বছর আগে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই বেনিয়ম চলছে। টাকা দিলেই বাংলার জার্সি। ভয়ে কেউ এগুলো প্রকাশ্যে বলে না। ক্ষতির ভয়ে।’’ আর ক্যাডেট বিভাগের এক ছাত্রী-খেলোয়াড়ের বাবা বললেন, ‘‘র‌্যাঙ্কিংয়ে ঢুকতে না পেরে আমার মেয়েটা খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এখন পিছনের দরজা দিয়ে চেষ্টা করছি। ধার করে নয় হাজার টাকা জোগাড় করেছি। টাকার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় মেয়ের নাম পাঠিয়েছে রাজ্য সংস্থা।’’

রাজ্য টিটি সংস্থা সূত্রেরই খবর, গত বছর বাংলার সিনিয়র দলে সুযোগ পেতে পূর্ব কলকাতার সৌরভ বসু (১০ হাজার) এবং হুগলির তমোজিৎ নাথকে (২০ হাজার) ডোনেশন দিতে হয়। ক্যাডেট ও সাব জুনিয়রদের থেকে ডোনেশন বাবদ উঠেছিল এক লাখ পঁচিশ হাজার টাকার মতো।

এক সময় যে খেলায় বাংলা ছিল ভারতে এক নম্বর, সোনা-সহ বহু পদক আসত, সেখানে এখন শুধুই অন্ধকার। কর্তাদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে তিনটে সংস্থা কাজ করছে বাংলায়। দুই অলিম্পিয়ান সৌম্যদীপ ঘোষ এবং অঙ্কিতা দাস কয়েক দিন আগে রাজ্য ছেড়ে চলে গেলেন হরিয়ানায়। আর এক নামী খেলোয়াড় সৌরভ সাহাও তাঁদের সঙ্গী। সেখানে খেললে যে অনেক পুরস্কার মূল্য। বাংলায় অবশ্য উলটপুরাণ। বাংলা দলে সুযোগ পেতেই তো দিতে হচ্ছে ডোনেশন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Table tennis Bribe Bengal TT Team
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE