প্র্যাকটিসে খোশমেজাজে পস্টিগারা। যুদ্ধের আগে ফুরফুরে কাতসুমিদের শিবিরও। ছবি: উৎপল সরকার।
দেবজিৎ মজুমদারের প্রভাব এই মুহূর্তে ঠিক কতখানি জোসে মলিনার টিমে?
মালুদার মতো বিশ্বকাপারের পেনাল্টি শট রুখে দিল্লিতে টিমের হার বাঁচানোর পর বঙ্গসন্তান কিপারকে নিয়ে আটলেটিকো দে কলকাতার কোচ উচ্ছ্বাসের ঢেউয়ে ভাসেননি। ছিলেন সংযত। জন আব্রাহামের টিমের বিরুদ্ধে খেলতে নামার আগের দিন অবশ্য মলিনা সামান্য হলেও আগল কিছুটা খুললেন। এবং সেটা কিছুটা বাধ্য হয়েই। কারণ তাঁর রক্ষণের ব্যর্থতা নিয়ে যে ভাবে গোলা-গুলি ছোড়া হচ্ছিল সাংবাদিক সম্মেলনে, তাতে টিমের লাস্ট ডিফেন্স নিয়ে কিছু তাঁকে বলতেই হত। ‘‘কিপার পজিশনে সেরা ফুটবলার না থাকলে সেই টিম সেরা হয় না। আমরা এখন কিন্তু প্রথম চারের মধ্যেই আছি। নর্থইস্টের বিরুদ্ধে খেলার পরও সেখানেই থাকতে চাই,’’ বলে দিলেন কলকাতার স্প্যানিশ কোচ।
নিজে ফুটবলার জীবনে গোলের নীচে দাঁড়াতেন। জানেন, একটা ম্যাচ, একটা খারাপ দিন কী ভাবে একজন কিপারের সব কৃতিত্ব মুছে দিতে পারে। মুহূর্তের ভুল আকাশ থেকে আছড়ে ফেলতে পারে মাটিতে। সব সাফল্য নিমেষে কালিমালিপ্ত হয়ে যেতে পারে একটা ভুলে। সে জন্যই সম্ভবত নিজের টিমের কিপারকে নিয়ে সতর্ক সূচক প্রশংসা-ই বেরিয়ে এল হিউমদের কোচের মুখ থেকে।
জোসে মলিনার সঙ্গে আন্তোনিও হাবাসের বহিরঙ্গের যে অমিলই থাক, একটা বিষয়ে দু’ই স্প্যানিশ-ই একই রাস্তায় হাঁটতে পছন্দ করেন। তা হল, সাফল্যের তুঙ্গে উঠলেও কোনও ফুটবলারকে নিয়ে তাঁরা যেমন অতি-উচ্ছ্বাসে ভাসেন না, তেমনই আবার কোনও তারকা ফুটবলার বাইরে থাকলে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতেও বসেন না। যেমন এ দিন চোটের জন্য মাঠের বাইরে চলে যাওয়া টিমের ‘পিভট’ সমীঘ দ্যুতিকে নিয়ে মলিনা বলেন, ‘‘ওর না থাকাটা ক্ষতি। কিন্তু দ্যুতির বিকল্প আমার হাতে আছে।’’
নেলো ভিনগাদার টিমের বিরুদ্ধে খেলতে নামার আগে লিগ টেবলে এটিকে-র অবস্থা যা তাতে বাকি পাঁচ ম্যাচে ছয় পয়েন্ট পেলেই শেষ চারের পা রাখা নিশ্চিত। শুধু তাই নয়, বৃহস্পতিবারের ম্যাচ জিতলে হেল্ডার পস্টিগারা চলে যেতে পারেন দুই বা তিনে। এবং নর্থইস্টের যা অবস্থা তাতে মলিনার দল আগের দিল্লি ম্যাচের ফর্মে থাকলেই দুমড়ে-মুচড়ে দিতে পারে প্রতিপক্ষকে। কারণ টুর্নামেন্টের শুরুতে যে কাতসুমিদের দেখে মনে হচ্ছিল, ঝকঝকে একটা টাট্টু ঘোড়া, মাঝপর্বে এসে তারাই হয়ে গিয়েছে ছ্যাকড়া গাড়ি। পর পর চার ম্যাচে হার। গোয়া, মুম্বই—যে পারছে হারিয়ে দিচ্ছে।
‘‘কী ভাবে যে কোথা দিয়ে কী হয়ে গেল। লাকি, আনলাকির কথা ছেড়ে দিন। আমার হাতে একটাই টোটকা আছে তা হল জেতার জন্য ছেলেদের মানসিকভাবে তৈরি করা। নতুন জন্ম চাইছি কাল। নতুন জীবন,’’ হতাশা আর আশা, দু’টো যেন মিলে মিশে একাকার নেলো ভিনগাদার গলায়। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করার আগেই কার্লোস কুইরোজের একসময়ের সহকারী নিজেই মাইক টেনে তাঁর আশা আর আশঙ্কার কথা বলে ফেললেন। ‘‘এখনও আশা আছে। এখনও। আমরা শেষ চারে যেতেই পারি। কাল তাই জিততে চাই।’’
যে পাহাড়ি টিমটা শেষ কবে জিতেছে, তা নিজেরাই হয়তো ভুলে গিয়েছে, তাদের কোচ হঠাৎ এ রকম আশা করছেন কোন সোনার কাঠির ছোঁয়ায়? ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর দেশের এক সময়ের জাতীয় কোচ বলেই কী! কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামে নর্থইস্টের অনুশীলনে পাওয়া গেল উত্তরটা। চোট সারিয়ে ফিরেছেন দলের গোল মেশিন এমিলিয়ানো আলফারো। এক সময় ফোরলানের সঙ্গে উরুগুয়ের জাতীয় দলে খেলা স্ট্রাইকার এই মুহূর্তে আইএসএলের যুগ্ম সর্বোচ্চ গোলদাতা। দিল্লির মার্সেলিনহোর সঙ্গে। চোট সারিয়ে ফিরেছেন আইভরি কোস্টের রোমারিকও। আশাবাদী হতেই পারেন ভিনগাদা। তবে তাঁর হাতের তুরুপের আর এক তাস টিমের অভিজ্ঞ কিপার সুব্রত পালকে সম্ভবত পাচ্ছেন না তিনি। চোটের জন্য দেবজিৎ বনাম সুব্রত—দুই বঙ্গসন্তান কিপারের ডুয়েল দেখা থেকে হয়তো বঞ্চিত হতে চলেছেন শহরের ফুটবলপ্রেমীরা। বুধবার বিকেলে সোদপুরের মিষ্টুকে দেখা গেল দলের ফিজিও-র সঙ্গে হাঁটতে, কলকাতার সমীঘ দ্যুতির মতোই।
এমনিতে এ বারের আইএসএল এখনও তেমন জমে ওঠেনি। কলকাতা জিতছে, শেষ আটে ওঠার দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। তা সত্ত্বেও টিকিটের সেই হাহাকার নেই। গুয়াহাটি আর কোচি ছাড়া কোথাও মাঠ ভর্তি হচ্ছে না। কেন জামকালো এই টুনার্মেন্টের আকর্ষণ মাত্র তিন বছরের মধ্যেই কমতে শুরু করল, তা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে সংগঠকদের অন্দরমহলে। কোথায় খামতি হচ্ছে, তার খোঁজ নেওয়া হচ্ছে মিডিয়া থেকে টিম মালিক— সবার কাছে।
ফোরলান ছাড়া বড় তারকা নেই। বেশির ভাগ টিমের মার্কি ফুটবলারের খেলা দেখে মন ভরছে না দর্শকদের। অনেকেরই মত, খেলার মানও আই লিগের চেয়ে উচ্চতায় উঠছে না। তাই রাত জেগে টিভিতে ইপিএল, লা লিগা দেখা চোখ আসছে না আইএসএলের গ্যালারিতে। আইএমজিআরের লোকজন অবশ্য দাবি করছেন, গ্যালারি না ভরলেও টিভি দর্শক রয়েছে আগের মতোই। টিআরপি না কি একটুও নামেনি।
ঘটনা যাই হোক, আজ কিন্তু মলিনা বনাম ভিনগাদার মগজাস্ত্রের লড়াই অন্য মাত্রা দিতে পারে ম্যাচের, জানাচ্ছে পরিসংখ্যান। যা মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় টেনে এনেছেন দুই কোচই। এ দিন মলিনাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনার টিম এত রক্ষণাত্মক কেন? শুনে মনে হল, বেশ চটেছেন শান্ত চেহারার এটিকে কোচ। ‘‘কে বলল আমরা অ্যাগ্রেসিভ নই। আইএসএলের পরিসংখ্যান দেখুন। গোল কম করলেও, গোলে শট মারায় আমরা দিল্লির পরেই আছি।’’ তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করা হল, কিন্তু ১১ গোল দিয়ে ১০ গোল খেয়েছে আপনার টিম। রক্ষণ তো ফুটিফাটা! শুনে পস্টিগার কোচের উত্তর, ‘‘ওটা হতেই পারে। যা সব সারপ্রাইজ পেনাল্টি দেওয়া হচ্ছে। রেফারির বিরুদ্ধে আর কিছু বলার নেই।’’ টিমের রক্ষণ এখনও খেলেছে নয়টি ম্যাচ। তা সত্ত্বেও তিরি-অর্ণবরা থিতু না হলেও, মলিনা জানেন পাহাড় টপকাতে পোস্টের নিচে দেবজিৎ আর সামনে পস্টিগা তাঁর বড় ভরসা।
উল্টো দিকে নামতে নামতে লাস্ট বয় হয়ে যাওয়া নর্থইস্ট কোচও তাঁর টিমের গুণগান করতে গিয়ে বলে ফেলেছেন, ‘‘হার-জিত আছে বলেই ফুটবলে আনন্দ আছে। পরিসংখ্যান দেখুন আমরাই কিন্তু সবথেকে বেশি সঠিক পাস খেলেছি।’’ সাত গোল দিয়ে আট গোল হজম। তাতেও টিমের পাস নিয়ে ভিনগাদার গর্বিত হয়ে কথা বলার ভঙ্গির সঙ্গে এটিএমে দু’ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করা সেই লোকটার বলে যাওয়া মন্তব্যের মিল পাওয়া গেল। যিনি অনন্ত অপেক্ষার পর টাকা না পেয়েও বলে ফেললেন, ‘‘আমি আজ টাকা পেলাম না। সমস্যায় পড়েছি ঠিক। তবে তাতে কী? আমার টাকা তো আমার ব্যাঙ্কেই থাকবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy