Advertisement
০৪ মে ২০২৪

মুরগি ফেরি করে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন পূর্ব রাজপুরের ব্রুস লির

পরের দিন বড় ম্যাচ যে! ‘ন্যাশনাল ক্যারাটে চ্যাম্পিয়নশিপ’-এর চূড়ান্ত পর্বে প্রহ্লাদ সর্দারের প্রতিপক্ষ পঞ্জাব। সে বার ‘কাতা’-য় (ক্যারাটের বিভিন্ন কসরতের একক উপস্থাপনা) প্রথম হয়েছিলেন প্রহ্লাদ।

প্রহ্লাদ সর্দার। —নিজস্ব চিত্র

প্রহ্লাদ সর্দার। —নিজস্ব চিত্র

নীলোৎপল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৮ ০২:৩০
Share: Save:

রাতের পাড়া। রাস্তা প্রায় শুনশান। রাত সাড়ে ১২টার পরে সেই ফাঁকা রাস্তাতেই শুরু হল তাঁর অনুশীলন! টালির চালের ঘরে জায়গার অভাব। তাই বাড়ির সামনের রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোতেই একে একে ‘গিয়াকু জুকি’, ‘মাওয়াশি গেরি’, ‘মায় গেরি’ — ক্যারাটের নানা রকম প্যাঁচ ঝালিয়ে নেওয়া।

পরের দিন বড় ম্যাচ যে! ‘ন্যাশনাল ক্যারাটে চ্যাম্পিয়নশিপ’-এর চূড়ান্ত পর্বে প্রহ্লাদ সর্দারের প্রতিপক্ষ পঞ্জাব। সে বার ‘কাতা’-য় (ক্যারাটের বিভিন্ন কসরতের একক উপস্থাপনা) প্রথম হয়েছিলেন প্রহ্লাদ। পঞ্জাবকে হারিয়ে সোনা জিতেছিল বাংলা। তবে অল্পের জন্য সোনা হাতছাড়া হয়েছিল ‘কুমিতে’-তে (দু’জনের মধ্যে লড়াই)। তাই একটি সোনা এবং একটি রুপো নিয়ে ফিরেছিলেন পাড়ার ‘ব্রুস লি’। তার পরে গত ডিসেম্বরের রাজ্য চ্যাম্পিয়নশিপেও সোনা এবং রুপো জয়।

আপাতত ওখানেই আটকে রয়েছে বছর কুড়ির ওই যুবকের স্বপ্ন। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর আর্থিক অবস্থা। ক্যারাটে অনুশীলন চালিয়ে যেতে মাংসের দোকানে দোকানে মুরগি ফেরি করছেন তিনি। তার মধ্যেও অবশ্য চলছে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের প্রস্তুতি।

ইএম বাইপাসের পূর্ব রাজপুরে প্রহ্লাদের টালির বাড়িতে দারিদ্রের ছাপ স্পষ্ট। বাবা সুবল সর্দার এক কালে রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। বহুতল থেকে ইট পড়ে আহত হয়ে আপাতত বাড়িতেই, কর্মহীন। সংসার চালাতে পরিচারিকার কাজ করেন প্রহ্লাদের মা সবিতা। মায়ের পাশে দাঁড়াতে এক সময় আখের রসের ব্যবসা শুরু করেন প্রহ্লাদ। তবে সেই ব্যবসা টেকেনি। জানালেন, হঠাৎ করেই আখ থেকে রস বার করার যন্ত্র খারাপ হয়ে যায়। টাকার অভাবে তা আর ঠিক করা হয়নি। এর পর সাইকেলে করে মাংসের দোকানে মুরগি পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেন তিনি। আপাতত সেটাই ভরসা।

প্রহ্লাদ জানালেন, টাকার অভাবেই নবম শ্রেণির পরে আর পড়াশোনা চালাতে পারেননি। এর মধ্যেই ২০১৩ সালে ক্যারাটে শিখতে শুরু করেন। কাকা নিধিরামকে দেখেই এই খেলার প্রতি আকর্ষণ। ‘বেঙ্গল স্পোর্টস ক্যারাটে অ্যাসোসিয়েশন’-এ এখন তিনিই প্রহ্লাদের শিক্ষক। জানালেন, ২০১৩ সালে যাদবপুরের কিশোরভারতী ক্রীড়াঙ্গনে প্রশিক্ষণ দিতেন ক্যারাটে প্রশিক্ষক প্রবীর হালদার। তাঁর কাছে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে চেয়েছিলেন প্রহ্লাদ। তবে প্রহ্লাদ জানান, তাঁর শারীরিক গঠন দেখে শেখাতে রাজি হননি প্রবীরবাবু। প্রহ্লাদকে বলা হয়েছিল, কিশোরভারতী মাঠে ১৫ পাক দৌড়তে হবে। পারলে শেখানো হবে। ১৩ পাক শেষ করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন কিশোর প্রহ্লাদ। পরের দিন থেকে তাঁকে প্রশিক্ষণ দিতে রাজি হয়ে যান প্রবীরবাবু। সেই শুরু, তার পর একে একে বেশ কিছু প্রতিযোগিতায় জিতেছেন প্রহ্লাদ। পেয়েছেন প্রচুর মেডেল এবং সার্টিফিকেট।

ঘরের নোনাধরা দেওয়ালে ছেলের সেই সব সাফল্য সাজিয়ে রেখেছেন সবিতাদেবী। সেগুলো দেখিয়ে বললেন, ‘‘খুব গর্ব হয়। ক্যারাটে চালিয়ে যেতে ছেলেটা অনেক কষ্ট করছে। কিন্তু, এ ভাবে আর ক’দিন! একটা চাকরির দরকার।’’ সুবলবাবু বলেন, ‘‘ছেলে চায় পুলিশ হতে। কিন্তু, শুধু পরীক্ষায় পাশ করলেই কি হয়? এ রকম চললে ক্যারাটে ছে়ড়ে হয়তো কাজেই মন দিতে হবে ওকে।’’

আর প্রহ্লাদ?

তাঁর জীবন ক্যারাটেই। বললেন, ‘‘পুলিশ না হতে পারলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু, ক্যারাটে ছা়ড়তে পারব না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE