Advertisement
০২ মে ২০২৪

বিরাট জিত, ইতিহাসের মেলবোর্নে দর্পচূর্ণ অস্ট্রেলিয়ার

স্টেডিয়াম জুড়ে নানা কিংবদন্তির মূর্তি। ডন ব্র্যাডম্যান থেকে বিল পন্সফোর্ড, নিল হার্ভি থেকে ডেনিস লিলি— কে নেই সেখানে! পাশেই রেল স্টেশন। আর তার ঠিক পিছনেই রড লেভার এরিনা। যেখানে আর কয়েক দিন পরেই অস্ট্রেলীয় ওপেন খেলতে আসছেন রজার ফেডেরার।

হুঙ্কার: মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়াকে দুরমুশ করে উল্লাস বিরাট কোহালির। এএফপি

হুঙ্কার: মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়াকে দুরমুশ করে উল্লাস বিরাট কোহালির। এএফপি

সুমিত ঘোষ
মেলবোর্ন শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:০০
Share: Save:

অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের আত্মা মানা হয় মেলবোর্নকে। কেউ কেউ বলেন, দেশের খেলাধুলোর রাজধানী। কে জানত, স্পিনের দেশ ভারতের গতির আগুনে পুড়ে সেখানেই দর্পচূর্ণ হবে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের!

স্টেডিয়াম জুড়ে নানা কিংবদন্তির মূর্তি। ডন ব্র্যাডম্যান থেকে বিল পন্সফোর্ড, নিল হার্ভি থেকে ডেনিস লিলি— কে নেই সেখানে! পাশেই রেল স্টেশন। আর তার ঠিক পিছনেই রড লেভার এরিনা। যেখানে আর কয়েক দিন পরেই অস্ট্রেলীয় ওপেন খেলতে আসছেন রজার ফেডেরার।

চার দিকে একটা ঐতিহাসিক আবহ। সেখানেই রবিবার দুপুরে বিরাট কোহালির দল নতুন বছরে ঐতিহাসিক লগ্ন উপহার দেওয়ার মঞ্চ তৈরি করে ফেলল। ১৩৭ রানে জিতে সিরিজে কোহালিরা এগিয়ে গেলেন ২-১। শেষ টেস্ট সিডনিতে। সেখানে হেরে গেলেও ২-২ হবে। বর্ডার-গাওস্কর ট্রফি থেকে যাবে ভারতের দখলে।

আরও পড়ুন: মেলবোর্নে জিতেই সিডনির ইতিহাসে চোখ কোহালির

যদিও অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের দ্রুততম ফাস্ট বোলার জেফ থমসনের মতো কিংবদন্তি ২-২ হওয়ার আশা দেখছেন না। ‘‘কেউ যদি জাদুকাঠি নিয়ে উপস্থিত হয়, কোনও ম্যাজিশিয়ানকে যদি টিমে নিতে পারে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া, তা হলে সিডনিতে জিততে পারে আমাদের দল। না হলে আমি কোনও আশা দেখছি না,’’ বলে দিচ্ছেন তিনি। একা থমসন নন, শেন ওয়ার্ন থেকে শুরু করে অ্যাডাম গিলক্রিস্ট— এই মুহূর্তে টিম পেনের অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বাস রাখছেন, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁদের কথা শুনে মনে হবে, টাইটানিক হিমশৈলে ধাক্কা খেয়েছে তলিয়ে যাবে সিডনিতে।

অভিবাদন: মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর পরে ভারতীয় দলকে নিয়ে মাঠ প্রদক্ষিণ বিরাট কোহালির। গেটি ইমেজেস

মেলবোর্নে ভারত শেষ বার টেস্ট জেতে ১৯৮২-তে। এখনকার অধিনায়ক কোহালি তখনও জন্মানইনি। সুনীল গাওস্কর আর ডেনিস লিলির মধ্যে ঝামেলার জন্য বিতর্কিত হয়ে আছে সেই টেস্ট। রবিবারের মতোই ম্যাচের নিষ্পত্তি হয় ভারতীয় সময় সকাল-সকাল। কুঁচকির ব্যথা সত্ত্বেও ইঞ্জেকশন নিয়ে নেমে পাঁচ উইকেট নিয়ে জেতান কপিল দেব। সে বার ছিলেন কপিল, এ বার যশপ্রীত বুমরা। স্পিনের দেশে সুইংয়ের হাত ঘুরে সম্পূর্ণ বিবর্তন হয়ে এখন ফাস্ট বোলারদের কারখানা। বিখ্যাত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পেস ত্রয়ী মার্শাল-হোল্ডিং-গার্নারের এক বছরে সব চেয়ে বেশি উইকেট নেওয়ার রেকর্ড ভেঙে দিচ্ছে তারা। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ত্রয়ী ১৯৮৪-তে নিয়েছিলেন ১৩০ উইকেট। ভারতের বুমরা-ইশান্ত-শামি ২০১৮ শেষ করলেন ১৩৬ শিকার নিয়ে।

দু’ইনিংস মিলিয়ে নয় উইকেট নিয়ে ম্যাচের সেরা বুমরা। তাঁর অধিনায়ক ঘোষণা করে দিলেন, বুমরাই এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ফাস্ট বোলার। এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে সকলে যাঁকে মেনে নিচ্ছেন, সেই কোহালি কি না বলছেন, ‘‘আমি বুমরাকে খেলতে চাই না। বেঁচে গিয়েছি আমরা একই টিমে।’’

আরও পড়ুন: বোলিংয়ে সেরা বুমরা, ব্যাটিংয়ে পূজারা

আর নায়ক? তিনি কী বলছেন? মনে হল, আসল উইকেটটা নিলেন ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে। বল হাতে নয়, মাইক হাতে। যখন বললেন, তাঁর এই সাফল্য আসলে ভারতের উন্নত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটের পুরস্কার। বাউন্সারের লক্ষ্য অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন স্পিনার কেরি ও’কিফ। যিনি প্রথম দিনে মায়াঙ্ক আগরওয়ালকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘‘রঞ্জি ট্রফিতে ও ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছে নিশ্চয়ই কোনও রেলওয়েজ ক্যান্টিনের বোলারদের বিরুদ্ধে।’’ তার পাল্টা জবাব দিয়ে গেলেন বুমরা ও কোহালি দু’জনেই।

স্মারক নিয়ে ভারতের তিন অস্ত্র বুমরা-শামি-ইশান্ত।

যখনই কোনও জুটি জমে গিয়েছে, বুমরাকে খুঁজেছেন কোহালি। তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন বল। আর বুম বুম বুমরা অধিনায়কের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছেন। অস্ট্রেলিয়ার একা কুম্ভ হয়ে ওঠা প্যাট কামিন্সকেও রবিবার ফেরালেন বুমরাই। বৃষ্টির আতঙ্ক কাটিয়ে ম্যাচ শুরু হওয়ার পর দিনের চতুর্থ ওভারেই গেলেন কামিন্স। ম্যাচের ভাগ্যও ঠিক হয়ে গেল। এর পর দেখা গেল অস্ট্রেলিয়ার শেষ ব্যাটসম্যান জশ হেজ্‌লউড ব্যাট করছেন আর বুমরা-ইশান্তদের বোলিংয়ের সামনে তাঁর পা কাঁপছে। লেগসাইডে সরে সরে যাচ্ছেন তিনি। একটা সময়ে অস্ট্রেলীয় পেসারদের দুরন্ত গতিকে এ ভাবে ভয় পেতেন ভারতের নীচের দিককার ব্যাটসম্যানরা। কেউ যেন সোনার কাঠি-রুপোর কাঠির ছোঁয়ায় দু’টো দলকে পাল্টাপাল্টি করে দিয়েছে।

মেলবোর্ন মাঠের বেসমেন্টে আরও এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা দেখা গেল। বেসমেন্টেই দু’টো দলের ড্রেসিংরুম। মাঝখানে সাংবাদিক সম্মেলন কক্ষ। এত কাল এই ঘরটায় বসে থমথমে মুখে বিদেশি দলের অধিনায়ক সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন। আর পাশের অস্ট্রেলিয়া ড্রেসিংরুম থেকে বিজয়োৎসবের উল্লাস ভেসে এসেছে। অতিথি দলের অধিনায়কেরা তার মধ্যে বসেই চুপচাপ কথা বলে গিয়েছেন।

এ দিন উল্টোটা দেখা গেল। পরাজিত টিম পেন সাংবাদিক সম্মেলন করছেন। আর পাশের ভারতীয় ড্রেসিংরুম থেকে ভেসে আসা উৎসবের কলরবে হারিয়ে যাচ্ছে অস্ট্রেলীয় অধিনায়কের বক্তব্য। যাঁদের বলা হত ‘আগলি অসিজ’, যাঁরা নির্মম ভাবে প্রতিপক্ষের টুঁটি চিপে ধরেছেন চিরকাল, তাঁদেরই সুর কি না আজ প্রতিপক্ষের আগ্রাসনে স্তব্ধ!

এমসিজি-তে দাঁড়িয়ে রবিবার এক-এক সময় মনে হচ্ছিল, সত্যিই পাল্টে গিয়েছে যুগ। এই তো সেই অস্ট্রেলিয়া, যারা গতির আগুনে প্রতিপক্ষকে ঝলসানোর নকশা বানাতো। রে লিন্ডওয়াল, ডেনিস লিলি, জেফ থমসন, গ্লেন ম্যাকগ্রা— পেস বোলিংয়ের কী অসাধারণ পরম্পরা তাদের! গোলার্ধ পাল্টে তা এখন ভারতের দিকে চলে গিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক টিম পেনও স্বীকার করে গেলেন, ‘‘বিশ্বের সেরা পেস আক্রমণের বিরুদ্ধে খেলছি।’’

এই কারণেই মেলবোর্ন টেস্টের গভীরতম দৃশ্য হিসেবে থেকে যাবে ভারতের পেসার ত্রয়ীর এক ফ্রেমে তোলা ছবি। তিন জনের হাতে স্মারক উইকেট। আর একটা স্টাম্প দেখা গেল মায়াঙ্ক আগরওয়ালের হাতে। ওপেনিং নিয়ে দুর্যোগের মধ্যে অভিষেক টেস্টেই যিনি সফল এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেট যাত্রা শুরু করলেন জয় দিয়ে।

রাহুল দ্রাবিড়-পরবর্তী প্রজন্মের নতুন দেওয়াল চেতেশ্বর পূজারার কথা বারবার বলে গেলেন কোহালি। চলতি সিরিজে দু’টো টেস্ট জিতেছে ভারত। দু’টোতেই সেঞ্চুরি তাঁর। ভারতীয় ব্যাটিংয়ে বিত্তবান ফেরারি চালকদের মাঝে পূজারা হলেন মধ্যবিত্ত সংসারী। টপ গিয়ারে চলে যাওয়া ব্যাটিং যখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে, দুর্ঘটনাপ্রবণ দেখায়, তিনি স্টিয়ারিং ধরে গাড়িকে বিপন্মুক্ত করেন। কোহালি বলে গেলেন, ‘‘পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তন এবং মানিয়ে নেওয়ার অসাধারণ গুণ রয়েছে পূজারার। সেটাই ওর সাফল্যের মূলমন্ত্র।’’

কোহালিরা টেস্ট জিতে যাওয়ার পরে মেলবোর্নে অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখা গেল। ম্যাচ দেখতে আসা ভারতীয় দর্শকের একটা অংশ ক্রিকেট খেলতে শুরু করে দিয়েছে স্টেডিয়াম চত্বরে। প্রত্যেকের গায়ে ভারতের নীল জার্সি। এমনকি, মেয়েরাও ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে পড়ছে। রীতিমতো উত্তেজনাপ্রবণ ম্যাচ চলছে। মাঝেমধ্যে স্লেজিংও হচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে, সদ্য অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে ওঠার টাটকা প্রভাব।

খেলতে খেলতে এক জন নীল জার্সিধারী বলে উঠলেন, ভয় পাচ্ছ কেন অস্ট্রেলিয়া? যত সময় যাচ্ছে, মনে হচ্ছে, ১৩৭ রানে জয়কে ছাপিয়ে মেলবোর্নে এটাই আসল ট্রফি কোহালিদের। ভয়কে জয় করে শত্রুর চোখে স্থানান্তরিত করা। যে আগ্রাসন ছিল অস্ট্রেলিয়ার অস্ত্র, তা-ই এখন কোহালির ভারতের মন্ত্র।

অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের রাজধানীতে এর আগে মাত্র দু’টো দল উৎসব করার সাহস দেখিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অ্যাশেজ জিতে বিতর্কিত ‘স্প্রিঙ্কলার ডান্স’ করা ইংল্যান্ড। তার সঙ্গে যুক্ত হল রবিবার বিকেলের ইতিহাস ওলটপালট করে দেওয়া ওই ছবিটা।

ভারতীয় ড্রেসিংরুম থেকে ভেসে আসা জয়োল্লাস আর তার মাঝে বসে বিধ্বস্ত অস্ট্রেলীয় অধিনায়কের সাংবাদিক সম্মেলন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE