Advertisement
০১ মে ২০২৪
আগেই মাঠে নেমে অভিনব বার্তা আগ্রাসী কোহালির

নির্ভীক দুই ওপেনার ও দুঃসাহসিক অধিনায়ক

বক্সিং ডে মেলবোর্নে চা-বিরতির পরে খেলা শুরু হওয়ার সময়ে বিরল  দৃশ্য দেখা গেল। আম্পায়ারদের সঙ্গেই বিরাট কোহালিও মাঠে নেমে পড়েছেন। তখনও তিনি একটা বলও খেলেননি। মায়াঙ্ক আগরওয়াল আউট হতেই চা-বিরতি ডেকে দেওয়া হয়েছে।

যুগলবন্দি:  মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্টের প্রথম দিনের শেষে দুই অসাধারণ যোদ্ধা। পুজারাকে অভিনন্দন অধিনায়ক কোহালির। বুধবার। এএফপি

যুগলবন্দি: মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্টের প্রথম দিনের শেষে দুই অসাধারণ যোদ্ধা। পুজারাকে অভিনন্দন অধিনায়ক কোহালির। বুধবার। এএফপি

মেলবোর্ন
সুমিত ঘোষ  শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৪:১৪
Share: Save:

ক্রিকেটে বরাবরের প্রথা হচ্ছে, খেলার শুরুতে বা বিরতির পরে আম্পায়াররা আগে মাঠে ঢুকবেন। তার পরে ফিল্ডিং দল। সবার শেষে দুই ব্যাটসম্যান।

বক্সিং ডে মেলবোর্নে চা-বিরতির পরে খেলা শুরু হওয়ার সময়ে বিরল দৃশ্য দেখা গেল। আম্পায়ারদের সঙ্গেই বিরাট কোহালিও মাঠে নেমে পড়েছেন। তখনও তিনি একটা বলও খেলেননি। মায়াঙ্ক আগরওয়াল আউট হতেই চা-বিরতি ডেকে দেওয়া হয়েছে। কোহালি এ বার ব্যাট করতে নামছেন। নট আউট ব্যাটসম্যান চেতেশ্বর পূজারা হেঁটে হেঁটে আসছেন। কোহালি তাঁর আগ্রাসী ভঙ্গিতে দৌড়তে দৌড়তে ক্রিজের দিকে এগিয়ে গেলেন। আর অস্ট্রেলিয়া দল মাঠে নামল অন্তত দেড় মিনিট পরে। কোহালি এবং পূজারা তত ক্ষণে পিচের উপরে পৌঁছে গিয়ে ব্যাট দিয়ে ঠোকাঠুকিও শুরু করে দিয়েছেন!

বক্সিং ডে মেলবোর্নে সারা দিন ধরে নানা উত্তেজক ঘটনাই দেখা গেল। তিয়াত্তর হাজার দর্শক উপস্থিত। গরিষ্ঠ সংখ্যক ভারতীয়। গ্যালারিতে বেশ কয়েক বার মেক্সিকান ওয়েভ উঠল। মাঝেমধ্যে গুলিয়েই যাবে, মেলবোর্ন না মুম্বই?

অভিষেক টেস্ট খেলতে নামা মায়াঙ্ক আগরওয়ালের দুর্দান্ত লড়াই। দু’দেশের প্রাক্তন তারকারাও মুগ্ধ। পিচে ঘাস ছেড়ে রাখা হয়েছে দেখেও কোহালি-রবি শাস্ত্রীর টিম ম্যানেজমেন্টের দারুণ ভাবে বাইশ গজের চরিত্র ধরতে পারা যে, এই ঘাস আসলে মরীচিকা। কোহালির টসে জিতে ব্যাটিং নেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং দুই নতুন ওপেনারের প্রথম ঘণ্টায় অসীম সাহসী হয়ে অস্ট্রেলীয় পেসারদের আগুন সামলে দেওয়া। এক জন— মায়াঙ্ক আগরওয়াল জীবনের প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছেন। অন্য জন— হনুমা বিহারী আসলে মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। ঘরোয়া ক্রিকেটে তিন নম্বরে ব্যাট করেছেন। দলের সঙ্কটের মুহূর্তে ওপেন করতে হচ্ছে। এ দিন অস্ট্রেলীয় পেসারদের মধ্যে সব চেয়ে ভয়ঙ্কর দেখানো প্যাট কামিন্সের বাউন্সার এমন ভাবে বিহারীর হেলমেটে লাগল যে, প্রেস বক্স থেকে পর্যন্ত শব্দ শোনা গেল। গ্যালারিতেও রীতিমতো আতঙ্ক তৈরি হতে দেখা গেল। আম্পায়ার খেলা থামিয়ে দিয়ে বিহারীর কাঁধে হাত রেখে জানতে চাইলেন, সব ঠিক আছে কি না। ভারতীয় ড্রেসিংরুম থেকে ফিজিয়ো দৌড়ে এলেন। বিহারীকে ক্ষণিকের জন্য কম্পিত দেখাল। কিন্তু মাঠ ছেড়ে গেলেন না। শুশ্রূষা নিয়ে, হেলমেট পাল্টে আবার দাঁড়িয়ে গেলেন কামিন্সকে খেলতে।

ধারাবাহিক ভাবে ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটারের কাছাকাছি গতিতে বল করে যাওয়া কামিন্সকে খেলতে গিয়ে এ দিন সব চেয়ে সমস্যায় পড়লেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানেরা। মেলবোর্ন পিচ নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই আলোচনা চলছিল। গত বছর অ্যাশেজে এখানে নিষ্প্রাণ ড্রয়ের পরে আইসিসি পিচকে ‘পুয়োর’ রেটিং দিয়েছিল। এ দিনও অভিযোগ উঠে গিয়েছে, পিচে গতি, বাউন্স কিছুই নেই। উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, এ বারেও যদি নিষ্প্রাণ ম্যাচ হয় তা হলে বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্রিকেট মাঠ হয়েও মেলবোর্নের ভবিষ্যৎ নিয়েই না অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। অ্যালান বর্ডার পিচের ঘাস নিয়ে কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘‘আমি একটাই কথা বলব। প্রত্যেকটা ঘাস যত্ন নিয়ে কেটে উড়িয়ে দেওয়া হোক। অন্তত স্পিনারের উইকেট তো করা হোক।’’

এমন পিচেও বডিলাইন বোলিং করে গেলেন অস্ট্রেলীয় পেসাররা। জার্ডিনের লেগ থিয়োরিকে মনে করিয়ে টিম পেন লেগসাইড ফিল্ডিংও সাজালেন। দু’তিন বার শরীরে আঘাত পেলেন দুই ওপেনার। শেষ পর্যন্ত দু’জনেই কামিন্সের বাউন্সার-বৃষ্টির সামনে পরাভূত হলেও সকালে এক ঘণ্টার উপর কাটিয়ে প্রায় ১৯ ওভার খেলে দিয়ে যাওয়াটা ভারতকে শক্ত ভিতের উপরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেল। বিহারী করলেন মাত্র ৮ রান কিন্তু অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ তাঁর ৬৬ বল খেলে দেওয়া। কুকাবুরা বল প্রথম ঘণ্টাতেই সব চেয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে ফাস্ট বোলারদের হাতে। বিহারী পার্ট-টাইম ওপেনার হিসেবে এসেও সেই আগুন সামলে দিয়ে গেলেন। মুরলী বিজয় এবং কে এল রাহুলের চেয়ে অনেক বেশি ভরসা দিয়ে যেতে পেরেছেন তাঁরা।

সাহসী দুই ওপেনার। সাহসী তিন নম্বর চেতেশ্বর পূজারা। আর তাঁদের দুঃসাহসিক নেতা। যিনি চা-বিরতির পরে অস্ট্রেলীয়দের দেখিয়ে আগে মাঠে নেমে পড়লেন। কোহালি গত কালই সাংবাদিক সম্মেলনে এসে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আশি শতাংশ মানসিক লড়াই। কুড়ি শতাংশ টেকনিক্যাল। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই নিজে সেটা হাতেনাতে দেখিয়ে দিলেন। মায়াঙ্ক আগরওয়ালের উইকেট তুলে নিয়ে চা-পানের বিরতিতে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া। কামিন্স তখন আগুন ঝরাচ্ছেন। টিম পেনের দলের মনে হতেই পারে যে, ভারতকে বাগে পেয়ে গিয়েছি। চা-কফি পান করে এসে বাকিটা দেখে নিচ্ছি। কিন্তু কোহালি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ডাকাবুকো মনোভাবে অস্ট্রেলিয়াকে সেই মনস্তাত্ত্বিক সুবিধে নিতেই দিলেন না। উল্টে নিজেই আগে-আগে ক্রিজে পৌঁছে গিয়ে এমন একটা বার্তা দিলেন যেন, বক্সিং ডে সকালে ঘুম থেকে উঠে সান্টা ক্লজ়ের উপহার হাতে পেয়েছেন। ব্যাট হাতে দিয়ে সান্টা তাঁকে বলেছেন, যাও ব্যাট করো। আর তিনি বাচ্চা ছেলের মতো নাচতে নাচতে উপস্থিত হয়ে গেলেন মেলবোর্নের বাইশ গজের উপরে।

ক্রিকেট ইতিহাস সম্পর্কে অবহিতদের মনে পড়ে যেতে পারে ১৯৮৪ সালের হেডিংলের কথা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বনাম ইংল্যান্ড সেই বিখ্যাত টেস্ট। বুড়ো আঙুল ভেঙে যাওয়া ম্যালকম মার্শাল খেলবেন না বলে বিরতিতে খুব স্বস্তিতে ছিলেন ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানেরা। চা-কফি পান করছেন আর হাসিঠাট্টা চলছে। তার পর হঠাৎই ড্রেসিংরুমের জানালা দিয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে তাঁরা আবিষ্কার করেন, তাঁদের নাকের ডগায় এসে দেখিয়ে-দেখিয়েই মার্শাল ওয়ার্ম-আপ করছেন! বাঁ হাতে প্লাস্টার করা। ৫৩ রানে সাত উইকেট নিয়ে ইংল্যান্ডকে ধ্বংস করে দেন মার্শাল। কিন্তু অনেকেই বিশ্বাস করেন, সে দিন ইংল্যান্ডের পুরো দলটাই শেষ হয়ে গিয়েছিল জানালা দিয়ে আহত মার্শালের ওয়ার্ম-আপ করা দেখে।

সময় বলবে, মেলবোর্ন টেস্টের নিষ্পত্তি চা-বিরতির পরের ওই কোহালিয়ানাতেই হয়ে গিয়েছিল কি না। আপাতত স্কোরবোর্ড বলে দিচ্ছে, অ্যাডভ্যান্টেজ ভারত। দিনের শেষে ২১৫-২। কোহালি-পূজারা ৯২ রান যোগ করে ফেলেছেন। পূজারার ২০০ বলে ৬৮ অপরাজিত দেখে ধারাভাষ্যকারেরা বলাবলি করছিলেন, রাতে পায়জামা পরেও ব্যাট করে যাবেন তিনি। এতটাই স্বচ্ছন্দে আছেন। কোহালি ১০৭ বলে ৪৭ অপরাজিত। দিনের শেষ লগ্নে দ্বিতীয় নতুন বলে মিচেল স্টার্ক একটা দুর্ধর্ষ স্পেল করলেন। কোহালির ক্যাচ ফেললেন উইকেটকিপার টিম পেন। যা নিয়ে পরে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে হতাশা প্রকাশ করে গেলেন ট্রাভিস হেড। তবু দু’জনেই অক্ষত আছেন। রান ওঠার গতি তুলনামূলক ভাবে অনেক কম হলেও দারুণ কিছু স্ট্রোক খেলেছেন দু’জনে। পূজারা যেমন দর্শনীয় অফ ড্রাইভে, তেমনই কোহালি সুন্দর অন ড্রাইভে।

দ্বিতীয় দিন সকালে সাত ওভার পুরনো নতুন বলে ফের আগুন ঝরাবেন স্টার্ক, কামিন্সরা। তাই কোহালি-পূজারার পরীক্ষা বাকি থাকছে। যদি প্রথম ঘণ্টাটা সামলে দিতে পারেন এই দু’জন, ইয়ারা পার্কের মতো এমসিজির ভিতরেও ‘ইন্ডিয়ান সামার ফেস্টিভ্যাল’ চলবে। ভারতীয় ক্রিকেটের দুই ব্যাটিং স্তম্ভের সংযম, শৃঙ্খলা আর নিয়ন্ত্রণ দেখে মার্ক ওয়রা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন, ডাবল সেঞ্চুরির প্রতিজ্ঞা নিয়ে তাঁরা ক্রিজে এসেছেন।

ভারতীয় ক্রিকেটের আর একটা ‘বড়দিন’ কি তা হলে বৃহস্পতিবার আসন্ন? স্বপ্ন দেখা শুরু মেলবোর্নে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE