Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বডিলাইনের ঝাপ্টা সামলে ইতিহাস সৃষ্টির মঞ্চ গড়া শুরু

সেই টেস্টেই স্ট্যান ম্যাকেবের অবিশ্বাস্য ১৮৭ রানের ইনিংস। চার ঘণ্টার ব্যাটিংয়ে এমন পাল্টা আক্রমণ করেছিলেন লারউডদের, যা সিডনি মাঠের চিরকালীন লোকগাথায় ঢুকে রয়েছে।

আক্রান্ত: সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বাউন্সার এড়াচ্ছেন মায়াঙ্ক। এএফপি

আক্রান্ত: সিডনিতে অস্ট্রেলিয়ার বাউন্সার এড়াচ্ছেন মায়াঙ্ক। এএফপি

সুমিত ঘোষ 
সিডনি শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০৪:১৫
Share: Save:

পঁচাশি বছর পেরিয়ে গিয়েছে। বিখ্যাত সেই বডিলাইন সিরিজের প্রথম টেস্ট হয়েছিল এই সিডনিতেই। যদিও ডন ব্র্যাডম্যান প্রথম টেস্টে খেলেননি নিজের দেশের বোর্ডের সঙ্গে ঝামেলা চলায়। ডগলাস জার্ডিনও তাঁর পেস অস্ত্র হ্যারল্ড লারউডকে দিয়ে সিডনিতে বডিলাইন বোলিং করাননি। তা সত্ত্বেও লারউড দশ উইকেট নিয়ে জেতান ইংল্যান্ডকে।

সেই টেস্টেই স্ট্যান ম্যাকেবের অবিশ্বাস্য ১৮৭ রানের ইনিংস। চার ঘণ্টার ব্যাটিংয়ে এমন পাল্টা আক্রমণ করেছিলেন লারউডদের, যা সিডনি মাঠের চিরকালীন লোকগাথায় ঢুকে রয়েছে। ম্যাকেবের অস্ত্র ছিল পাল্টা আক্রমণ। আর বৃহস্পতিবার একই মাঠে চেতেশ্বর পূজারা বডিলাইনের বিরুদ্ধে হাতিয়ার করলেন রক্ষণকে।

বডিলাইন বোলিং নিয়ে মহাপ্রলয় শুরু হয় অ্যাডিলেডের তৃতীয় টেস্টে। লারউডের বাউন্সার আছড়ে পড়ে বিল উডফুলের বুকের উপরে। এর পর বার্ট ওল্ডফিল্ডের মাথা ফেটে যায় লারউডের আর একটা মিসাইলে। ক্রিকেটের ইতিহাসে সব চেয়ে অপ্রীতিকর ম্যাচ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে সেই অ্যাডিলেড টেস্ট।

বৃহস্পতিবার সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে বসে মনে হচ্ছিল, জার্ডিনের ইংল্যান্ড এখানে বডিলাইনের ব্যবহার না করে থাকতে পারে। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে জার্ডিন খেলেছিলেন, সেই অস্ট্রেলিয়াই সাম্প্রতিক কালের সব চেয়ে ভয়ঙ্কর বডিলাইন বোলিং করে গেল সিডনিতে। মাঠে শেষ পর্যন্ত যে ফিল হিউজ ট্র্যাজেডি ফেরেনি, সেটাই সৌভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু বারবার আতঙ্ক তৈরি হল। একাধিক বার মাথায় বল লাগল দুই ভারতীয় ব্যাটসম্যান মায়াঙ্ক আগরওয়াল এবং চেতেশ্বর পূজারার। অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক টিম পেনকে দেখে কে বলবে এক দিন তাঁর দেশই জার্ডিনের রণনীতির তীব্র সমালোচনা করেছিল। বরং তখনকার জার্ডিনের মতো পেন এ দিন লেগ থিয়োরি প্রয়োগ করে বডিলাইন ফিল্ডিংয়েরও

স্মৃতি ফেরালেন।

যুগ পাল্টেছে, নিয়ম পাল্টেছে। ব্র্যাডম্যানের আমলে আত্মরক্ষার জন্য হেলমেট বা অন্য কোনও সরঞ্জাম ছিল না। এখন প্রায় সারা শরীরই সুরক্ষিত করে মাঠে নামা যায়। বডিলাইন সিরিজের পরেই লেগ সাইডে ফিল্ডিং বিধিনিষেধ তৈরি হয়েছে। ওভার প্রতি বাউন্সারের সংখ্যাও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তাই বডিলাইন প্রয়োগ করে এখন আর অধিনায়কদের কপালে জার্ডিনের মতো ঘৃণা বা নিন্দা জোটে না। ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ চার ফাস্ট বোলারের আগুনে সারা ক্রিকেট বিশ্বকে শাসন করেছে।

অস্ট্রেলিয়াই পরবর্তী কালে প্রচুর ফাস্ট বোলারের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিপক্ষকে লারউড-ভোসের মতোই শরীর লক্ষ্য করে বল করে তাদের ভয় পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এ দিনও পেন যেমন লেলিয়ে দিলেন তাঁর ফাস্ট বোলারদের। বিরাট কোহালি টস জিতে ব্যাটিং নেওয়ার পরে শুরুতে সব ঠিকঠাকই চলছিল। অস্ট্রেলীয় পেসাররা শর্ট বল ব্যবহারই করছিলেন না। এই সময়ে রিকি পন্টিংকে কমেন্ট্রিতে বলতে শোনা গেল, ‘‘আমি বুঝতে পারছি না অস্ট্রেলিয়া কী ধরনের বোলিং ট্যাকটিক্স নিয়েছে। মেলবোর্নে শর্ট বলে যথেষ্ট সমস্যা হচ্ছিল মায়াঙ্ক আগরওয়ালের। ওকে ব্যাটের গোড়ায় বল দেওয়ার মানে কী?’’

পন্টিংয়ের মন্তব্য পেনের কানে গিয়েছিল কি না জানা নেই। কিছুক্ষণ পরে অন্য মূর্তিতে দেখা গেল অস্ট্রেলিয়াকে। মিচেল স্টার্ককে আক্রমণে ফিরিয়ে আনলেন পেন। তিনি রাউন্ড দ্য উইকেট এসে মায়াঙ্ক আগরওয়ালকে লক্ষ্য করে বাউন্সারের বৃষ্টি ঘটাতে লাগলেন। স্টার্ককে দুর্দান্ত কভার ড্রাইভে একটা চার মারলেন মায়াঙ্ক। সঙ্গে সঙ্গে ফাস্ট বোলারের ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া। পরের বলটাই গিয়ে গ্লাভসের উপর দিয়ে আঙুলে লাগল তাঁর। জলপানের বিরতিতে ভারতীয় দলের ফিজিয়ো প্যাট্রিক ফারহার্ট ছুটে এলেন। বেশ কিছুক্ষণ ধরে মায়াঙ্কের আঙুলের শুশ্রূষা চলল। পরের ওভারেই একটা বাউন্সার মায়াঙ্কের গ্লাভস ছুঁয়ে হেলমেটে লেগে স্লিপের মাথার উপর দিয়ে চার হয়ে গেল। ফের ছুটতে ছুটতে এলেন ফিজিয়ো। ফের দীর্ঘক্ষণ শুশ্রূষা চলল। হেলমেট পাল্টে আবার ব্যাট করতে দাঁড়ালেন ভারতীয় ওপেনার। এর পরেও থামেনি বাউন্সার বৃষ্টি। আর এক বার পাঁজরে এমন লাগল মায়াঙ্কের যে, যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলেন। তা দেখে আরও আগ্রাসী হয়ে গেলেন পেন। ফিল্ডিং সাজালেন এ রকম: দুই স্লিপ, গালি, পয়েন্ট, ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ এবং লেগ গালি।

অন্য দিক থেকে হেজ্‌লউডকে নিয়ে এলেন অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক। তিন পেসারের মধ্যে তাঁর গতি সব চেয়ে কম। কিন্তু এখানে তিনিও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন। চেতেশ্বর পূজারা এত জমাট ব্যাটসম্যান। তাঁকেও নড়বড়ে দেখাতে থাকল হেজ্‌লউডের শর্ট-পিচ্‌ড বোলিংয়ের সামনে। একটা বল আগে থেকে চোখ বন্ধ করে ফেললেন পূজারা। বলটা গিয়ে লাগল ঘাড়ের নীচে কানের পাশে বিপজ্জনক জায়গায়। প্রথম দিনের খেলার সব চেয়ে আতঙ্কিত মুহূর্ত ছিল সেটাই। কেউ কেউ বলাবলি করতে থাকেন, এটা তো সেই ফিল হিউজের বল লাগার অভিশপ্ত জায়গা। কানের নীচে, যেখানে লেগেছিল শন অ্যাবটের বাউন্সার। হিউজের ঘটনার পর থেকে মাথায় লাগলেই খেলা থামিয়ে দেন আম্পায়াররা। দলের ডাক্তার বা ফিজিয়োকে মাঠে আসতে হয়, তিনি পরীক্ষা করে দেখবেন, সব ঠিক আছে কি না। তার পরে সেই ব্যাটসম্যান আবার খেলতে পারবেন। পূজারার ক্ষেত্রেও সেটা করতে হল। ভারতের তিন নম্বর অবশ্য দমে যাওয়ার লক্ষণই দেখালেন না। সামান্য শুশ্রূষা নিয়েই দাঁড়িয়ে গেলেন খেলতে। ২৪ ওভারে ৬৯-১ স্কোর নিয়ে লাঞ্চ করতে গেলেন পূজারা এবং আগরওয়াল। ফিরে আসার পরে অনেক বেশি জমাট দেখাল তাঁদের। স্টার্কদের বডিলাইন বোলিং সামলে দ্বিতীয় উইকেটে ১১৬ রান যোগ করে তাঁরাই দিনের শেষের ৩০৩-৪ স্কোরের ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন।

নেথান লায়নের মনোবল ধ্বংস করতে গিয়ে উইকেট বিসর্জন দিয়ে গেলেন মায়াঙ্ক। দু’টো ছয় মারার পরে ফের ও়ড়াতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন বাউন্ডারির ধারে। পরে সাংবাদিকদের সামনে এসে নবাগত ওপেনার বলে গেলেন, ‘‘আমি খুবই হতাশ এ ভাবে উইকেট ছুড়ে দিয়ে আসার জন্য। বড় স্কোর করে আসা উচিত ছিল। এই ভুল থেকে শিক্ষা নিতে চাই আমি।’’ স্বীকার করলেন, অস্ট্রেলিয়ার পেসারদের বাউন্সার বৃষ্টি তাঁদের অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল।

পূজারা এবং কোহালিকে দেখে মনে হচ্ছিল, ভারতীয় ব্যাটিংয়ের দুই সেরা রত্ন আরও একটা বড় রানের পার্টনারশিপ গড়তে চলেছেন। কোহালি খুব সাবধানী ইনিংস খেলছিলেন। ব্যাট করতে নামার সময় ফের এ দিন অস্ট্রেলীয় সমর্থকদের একাংশ ধিক্কার ধ্বনি দিল। সেটা শুনে সম্ভবত আরও চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছিল ভারত অধিনায়কের। অফস্টাম্পের বাইরে পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছিলেন না। কিন্তু চা-পানের পরে মনঃসংযোগে সাময়িক বিঘ্ন ঘটল, আর ওই ছিদ্র দিয়েই ঢুকে পড়ল কালনাগিনী।

পাঁজর লক্ষ্য করে ধেয়ে আসা হেজ্‌লউডের বল পুল মারতে গিয়ে উইকেটকিপার টিম পেনের হাতে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নিলেন ভারত অধিনায়ক। এর পর স্টার্কের হাত থেকে বেরোল মারণ বল। থুতনি লক্ষ করে ঘণ্টায় ১৪৬ কিলোমিটার গতিতে চকিতে ধেয়ে আসা সেই বল থেকে মুখ বাঁচাতে গিয়ে গ্লাভসে লাগিয়ে আউট হলেন অজিঙ্ক রাহানে। মাঠ ছাড়ার সময় দেখা গেল, মাইকেল হাসি বলছেন, শুক্রবার সকালে হনুমা বিহারীকে শর্ট বল দিয়ে আক্রমণ করা উচিত। তা হলে ম্যাচে ফেরার সম্ভাবনা থাকবে অস্ট্রেলিয়ার। মেলবোর্নে ওপেন করতে নেমে বাউন্সারের সামনে দুর্বল দেখিয়েছে বিহারীকে। ৫৮ বলে ৩৯ অপরাজিত তিনি। পূজারার সঙ্গে পঞ্চম উইকেটে ইতিমধ্যেই ৭৫ রান যোগ করে ফেলেছেন। কিন্তু শুক্রবার সকালে ফের পরীক্ষা দিতে হবে। ভুল বললাম। বডিলাইনের সামনে ফের পরীক্ষা দিতে হবে। জার্ডিনের নিন্দিত নকশাই যে আজ বন্দিত হাতিয়ার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE