Advertisement
০৪ মে ২০২৪

আনকোরা বিদেশিদের হাতে আজ ডার্বি ভাগ্য

বাঙালিকে দু’ভাগ করে দেওয়া চিরকালীন ডার্বি কি তার কৌলীন্য হারাচ্ছে? ইলিশ-চিংড়ি বা বাঙাল-ঘটির লড়াই বেঁচে থাকবে আর কত বছর? সমর্থকদের আবেগের মহা-উদ্বেলতার আয়ু-ই বা কত দিন?

এক দিন আগে ডার্বি-মেজাজ। প্র্যাকটিসে নিরুত্তাপ সনি। প্লাজাকে নিয়ে হইচই। শিলিগুড়িতে। -বিশ্বরূপ বসাক

এক দিন আগে ডার্বি-মেজাজ। প্র্যাকটিসে নিরুত্তাপ সনি। প্লাজাকে নিয়ে হইচই। শিলিগুড়িতে। -বিশ্বরূপ বসাক

রতন চক্রবর্তী
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৩:৪৮
Share: Save:

বাঙালিকে দু’ভাগ করে দেওয়া চিরকালীন ডার্বি কি তার কৌলীন্য হারাচ্ছে?

ইলিশ-চিংড়ি বা বাঙাল-ঘটির লড়াই বেঁচে থাকবে আর কত বছর? সমর্থকদের আবেগের মহা-উদ্বেলতার আয়ু-ই বা কত দিন?

শিলিগুড়ির ধুন্ধুমার ডার্বি শুরুর আগের বিকেলে পাশাপাশি বসে থাকা ট্রেভর জেমস মর্গ্যান আর সঞ্জয় সেনকে দেখে প্রশ্নগুলো উঠতেই পারে। একে অন্যের পাশে বসে তাঁদের সমর্থন সূচক মাথা নাড়ানো বা নিরামিষ কথাবার্তা শুনলে মনে হবে আই লিগের আর-পাঁচটা ম্যাচের মতোই এটাও স্রেফ একটা ম্যাচ। যেখানে শুধুই পয়েন্ট পাওয়ার লক্ষ্যে নামছে দুটো টিম।

কী যে এক নিয়ম করেছেন সংগঠকরা! যুগ্ম সাংবাদিক সম্মেলন! আই এস এল থেকে ধার নিয়ে আই লিগের জাতে ওঠার চেষ্টা হয়তো। তাই মিডিয়াকে প্রথম পনেরো মিনিট অনুশীলন দেখতে দেওয়ার নিয়ম থেকে সব হাজির নীতা অম্বানির ‘রাজত্ব’ ছেড়ে ফুটবল হাউসের সংগঠকদের মধ্যেও।

এই পরিস্থিতিতে কোচেরা কী ভাবে পিকে বনাম অমল বা সুভাষ বনাম সুব্রতর লড়াইয়ের আবহ তৈরি করবেন? ফলে যা হওয়ার তাই হল। কথার ফুলঝুরি বা বিস্ফোরণ কিছুই হল না।

নিরামিষ সাংবাদিক সম্মেলন থেকে কী কী পাওয়া গেল দেখা যাক।

প্রশ্ন: আই লিগের এই ডার্বির গুরুত্ব কতটুকু?

সঞ্জয় সেন: ডার্বির গুরুত্ব জানি। তা সত্ত্বেও বলছি এটা আর একটা ম্যাচ। এখানে জিতলে বা খারাপ ফল হলে লিগ খেতাবে প্রভাব পড়বে না।

ট্রেভর জেমস মর্গ্যান: সদস্য-সমর্থকদের কাছে এটা স্পেশ্যাল হতে পারে, আমার কাছে নয়। কোনও চাপ নেই। তিন পয়েন্টের জন্য খেলব। না পেলেও ছিটকে যাব না লড়াই থেকে। আরও এগারোটা ম্যাচ বাকি থাকবে।

প্রশ্ন: ছয় জন বিদেশির মধ্যে নতুন বিদেশি পাঁচ। এটা কোনও টিমের কাছে ভাল না খারাপ? সুবিধা না অসুবিধার?

মর্গ্যান: আমার টিমের তিন বিদেশিই বহু আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে এখানে এসেছে। এই ম্যাচের চাপ নেওয়ার ক্ষমতা ওদের আছে।

সঞ্জয়: সুবিধা-অসুবিধা দু’টোই আছে। অচেনা বিদেশি ভয়ঙ্কর হতে পারে। আবার সুবিধাও করে দিতে পারে। মাঠে নামলে বোঝা যাবে।

বাগান কোচ আর যা যা বলছেন তার নির্যাস, ‘‘দশ মাস আগের ডার্বি হারের শোধ তোলার ম্যাচ নয় এটা। ইউনাইটেডে থাকার সময় মাঠে মর্গ্যানের মুখোমুখি হয়েছি। ডার্বিতে অবশ্য ওর বিরুদ্ধে এই প্রথম। তাতে কোনও বাড়তি উত্তেজনা নেই।’’

ফের প্রশ্ন, আই লিগের এই ডার্বি কি ট্যাকটিক্যাল ম্যাচ হতে চলেছে? শুনে মর্গ্যানের প্রতিক্রিয়া, ‘‘সেটা মাঠে দেখা যাবে। তিন পয়েন্ট চাই। এটা মাথায় রেখেই নামব।’’

দুই কোচের কোনও চাঁচাছোলা বা আগুনে মন্তব্য ছাড়াই শেষ বাগান বনাম বেঙ্গল কোচ-পর্ব।

বরং দুই প্রধানের দুই অপরিহার্য ফুটবলারের মধ্যে তবু পাওয়া গেল যুদ্ধের মেজাজ!

বাগান অধিনায়ক কাতসুমিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ডার্বিতে সেরা বাছবেন কোন ক্লাবকে? জাপানি বোমার বিস্ফোরণ ঘটল এ ভাবে, ‘‘মোহনবাগান অ্যান্ড মোহনবাগান।’’ এ বার চ্যাম্পিয়ন হবে কে? সেখানেও একই কথার পুনরাবৃত্তি, ‘‘মোহনবাগান।’’ আর পনেরো বছর এই ম্যাচটা দাপটে খেলছেন যিনি সেই মেহতাব হোসেন বলে গেলেন, ‘‘কার কী হয় জানি না। আমার কিন্তু মনে আছে জীবনের প্রথম ডার্বির আগের রাতে ঘুমোতে পারিনি। এখনও মনে হয় এই একটা ম্যাচ জিততে না পারলে খেলাটাই বৃথা।’’

দুই কোচের একে অপরের পিঠ চাপড়ে দেওয়া মন্তব্য বা ফুটবলারদের সামান্য উত্তেজনা ছড়ানো কথাবার্তা বলেই চুপ করে যাওয়া— এ সব কি চাপে পড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত? না কি পেশাদারিত্ব?

ঘটনা যাই হোক, পর্দার সামনে যা ঘটল সেটা মনে হল দু’দলের ড্রেসিংরুমের গায়ে চাপিয়ে দেওয়া জ্যাকেট। যে আবরণের নীচে ভিতরটা আসলে হতে চলেছে সেই রক্তক্ষয়ী। অঙ্ক এবং পাল্টা অঙ্ক দশ মাস পর হতে চলা কলকাতা ডার্বিকে করে তুলতে পারে ধুন্ধুমার। ছড়িয়ে দিতে পারে রংমশালের আলো।

গড়িয়া থেকে আসা যে ইস্টবেঙ্গল সমর্থক জোড়া ইলিশ নিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন বা কলকাতার যে জ্যোতিষী গর্বভরে নিজের ভবিষ্যদ্বাণী শোনাচ্ছিলেন মিডিয়াকে, তাঁদের জন্য কিন্তু রবিবাসরীয় বিকেল দিতে চলেছে উত্তেজনায় টইটম্বুর একটা হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ। যা থেকে পাওয়া যাবে অনেক প্রশ্নের উত্তর। শনিবার সকালে দু’দলের অঙ্ক কষা ক্লোজ ডোর অনুশীলন, ফুটবলারদের হাবভাব, টিম হোটেলে ক্লাসের পর ক্লাস এবং দুই প্রধানের বড় কর্তাদের সরব উপস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ডার্বি আছে ডার্বিতেই।

চতুর ব্রিটিশ আর চেতলার নিখাদ বঙ্গসন্তান কোচের মগজাস্ত্র-যুদ্ধে কে এগিয়ে? বলা খুব মুশকিল। তবে এটা বলা যায়, নতুন বিদেশিদের উপর ম্যাচের ফলাফল নির্ভর করছে অনেকটাই। ইস্টবেঙ্গলের বুকেনিয়া, প্লাজা বা ওয়েডসন প্রথম বার ডার্বি খেলছেন। বাগানের ডাফি আর এডুও ভারতে অন্য টিমের জার্সিতে ম্যাচ খেললেও বড় ম্যাচে নামছেন এই প্রথম। মজিদ থেকে এমেকা প্রথম ডার্বিতে ফ্লপ করেছিলেন। আবার হোসে ব্যারেটো, রডরিগে, ডু-ডং এই ম্যাচে নেমেই করেছিলেন গোল। কয়েক বছর আগে বাগান জার্সিতে জেলেনি ডার্বিতে প্রথম নেমেই চমকে দিয়েছিলেন।

কানে হিরের দুল, অনুশীলনে পর পর জোরালো শট মারতে থাকা এডু কি পারবেন বাগানের রক্ষণকে দুর্ভেদ্য দুর্গ করে তুলতে? অসম্ভব সিরিয়াস হয়ে থাকা সনি নর্ডিকে কি মাঠে নড়াচড়া করতে দেবেন মর্গ্যান? বা ডাফিকে? প্লাজা, ওয়েডসনরা কি গোল করতে পারবেন? স্লথ বুকেনিয়া আটকাতে পারবেন ছটফটে জেজে-কে?

গ্যালারির আঠাশ হাজারের শব্দব্রহ্মের সামনে কে ডোবাবেন আর কে ভাসাবেন, সেটা রবিবারের স়ূর্যাস্ত আর চন্দ্রোদয়ের মাহেন্দ্রক্ষণে বোঝা যাবে।

বাঙালির চিরকালীন যুদ্ধে বঙ্গসন্তানদের দাপট এ বার অনেকটাই কম। এখনও পর্যন্ত যা খবর, প্রথম বাইশে দু’দল মিলিয়ে জনা পাঁচ বা ছয় খেলতে পারেন হয়তো। বাগানের সুবিধা তাদের টিমটা তিন বছর ধরে প্রায় একই, বেঙ্গলের প্লাস পয়েন্ট টিমটা ধারাবাহিক জিতছে।

ফলে ম্যাচ ফিফটি-ফিফটি।

কোন তাস মর্গ্যান বা সঞ্জয় শেষ পর্যন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘার টেবলে ফেলবেন সেটা তাঁরাই জানেন। যাই করুন, দু’দলের শক্তির ফারাক এতটাই কম যে, একটা অঙ্ক ভুল করলেই ফেল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। তা ছাড়া দু’জনেই মাথায় রাখছেন, এই ম্যাচটা লিগের শেষ ম্যাচ নয়। ফলে মুখে তিন পয়েন্টের কথা বললেও দু’জনেই হারতে চাইবেন না। রক্ষণ আঁটসাঁট রেখে পরে পাল্টা যুদ্ধে যেতে চাইবেন দুই কোচই।

তবে সারসত্যটা বলে গেলেন সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়। বাগান ম্যানেজার হয়ে আসা সত্যর ৮৮টি ডার্বি খেলার অভিজ্ঞতা আছে। ‘‘ডার্বিতে কোনও অঙ্ক হয় না। ডার্বির চাপ যে নিতে পারবে সেই জিতবে।’’ বলেই ম্যানেজার্স মিটিংয়ে ঢুকে পড়লেন তিনি।

যেখানে বসে আছেন রেফারি শ্রীকৃষ্ণ আর তাঁর টিম। কৃষ্ণের বাঁশির একটা ভুল সুর যে-কোনও সময় বদলে দিতে পারে ডার্বির রং।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Foreign players derby East Bengal Mohun Bagan
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE