জঙ্গলমহল আন্দোলনের নেতা ছত্রধর মাহাতোর বড় ছেলে ধৃতিপ্রসাদ মাহাতো। শনিবার ময়দানে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী
এই সে দিনও দরজায় এসে গভীর রাতে কড়া নাড়ত পুলিশ।
শোনা যেত ভারী বুটের শব্দ, গোলা-গুলির আওয়াজ!
জঙ্গলঘেরা দোতালা মাটির বাড়িতে মাঝেমধ্যেই হানা দেয় দাঁতাল হাতি।
দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বাবা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়ে আলিপুরের সেন্ট্রাল জেলে বন্দি।
বাবার বিরুদ্ধে মামলা আরও জোরালো করতে নিরীহ ছেলেটিকে কেসে জড়িয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করেছিল পুলিশ। বাঁচতে জামিন নিতে হয়েছিল।
অথচ এই আবহে বেড়ে ওঠা যুবক শুধু তারকা ফুটবলার হতে চান!
আর সে জন্যই বহু মাইল পেরিয়ে জঙ্গলমহল থেকে ট্রায়াল দিতে তিনি হাজির ময়দানে।
জঙ্গলমহল আন্দোলনের নেতা ছত্রধর মাহাতোর বড় ছেলে ধৃতিপ্রসাদের সঙ্গে শনিবার বিকেলে কথা বলার সময় মনে হচ্ছিল কোনও সিনেমার চিত্রনাট্য যেন। যেখানে প্রবল ভাবে হাজির জেদ আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি। ‘‘মা গতকাল জেলে গিয়ে বাবার সঙ্গে দেখা করেছিল। বাবাকে মা বলে এসেছে আমি আজ ট্রায়াল দিতে কলকাতায় আসব। বাবা খুব খুশি হয়েছে শুনে। জানেন বাবাও আমার সঙ্গে পাড়ার ক্লাবে ফুটবল খেলেছে। আমাকে বড় ফুটবলার হতেই হবে। বাবার স্বপ্ন সার্থক করতেই হবে।’’
ছত্রধরের নেতৃত্বে দুর্বার গণ আন্দোলনের সেই ভয়াবহ দিনগুলির কথা বেশি তুললে অবশ্য সঙ্কুচিত হয়ে যান বছর কুড়ির ধৃতিপ্রসাদ। বলে দেন, ‘‘সেই দু’হাজার নয় সালে বাবাকে পুলিশ গ্রেফতার করার পর থেকেই তো আমি আর ভাই মেদিনীপুরে চলে যাই পড়াশোনা করতে। ওখানেই খড়গপুর লিগে খেলেছি। জঙ্গলমহল কাপে খেলেছি। ট্রফি, মেডেল পেয়েছি। তার পর তো স্যার আমাকে বেছে নিলেন। ছিলাম স্টপার, স্যার করে দিলেন উইঙ্গার।’’
স্যার, মানে ময়দানের ছোট দলের তারকা কোচ রঘু নন্দী। তিনিই ধৃতিপ্রসাদের তীব্র গতি আর ফুটবল বোধ দেখে বছর পাঁচেক আগে বেছেছিলেন তাঁকে। জঙ্গলমহল কাপের ফাইনালের পর বলে এসেছিলেন, ‘‘তুমি আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখো। তুমি পারবে। তোমায় আমি কলকাতায় খেলাব।’’ এ দিন বিকেলে শতবর্ষপ্রাচীন মেসারার্স ক্লাবে ট্রায়াল নেওয়ার সময় রঘু বলছিলেন, ‘‘জানি না কেন এত দিন যোগাযোগ করেনি। তিন দিন আগে আমাকে ফোন করেছিল, বললাম চলে আয়। দেখছেন কী গতি!’’ মাঠের পাশে বসে বলছিলেন রঘু। অসংখ্য ফুটবলারকে ময়দানের তারকা করেছেন যিনি।
একশো বছর পর মেসারার্স ক্লাব এ বার উঠেছে কলকাতা লিগের প্রথম ডিভিশনে। সেখানে ট্রায়াল দেওয়ার জন্য ভোর সাড়ে চারটেয় লালগড়ের আমলিয়া গ্রাম থেকে বেরিয়ে পড়েছিল ধৃতিপ্রসাদ। প্রায় এক ঘণ্টা বাসে করে মেদিনীপুর স্টেশন। সেখান থেকে হাওড়া। রাস্তার পাশের হোটেলে ভাত-তরকারি খেয়ে ধর্মতলা। ময়দানের কিছুই জানা ছিল না। এক বন্ধু অসিত মাহাতো অবশ্য চিনতেন গ্রিয়ার মাঠ। সেই বন্ধুই এ দিন ছত্রধরের ছেলেকে নিয়ে আসেন রঘু-স্যারের ডেরায়। কিন্তু কোচ আপনাকে নির্বাচন করার পর কেন এত দিন লাগল কলকাতায় আসতে? ট্রায়াল দিয়ে ফেরা ধৃতিপ্রসাদের ঘর্মাক্ত মুখটা নিচু হয়। সাহায্যে এগিয়ে আসেন মেসারার্স ক্লাবের টিডি রঘু। ‘‘হয়তো ভয় পেয়েছিল আসতে। কে কী ভাবে ওকে নেবে সেটা ভেবে। আমাকে ফোন করার পর বলেছিলাম কোনও চিন্তা নেই। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। ওর থাকার ব্যবস্থা করেছি। যা খরচ সব আমি জোগাড় করে দেব।’’
বাবা জেলে। দু’মুঠো খাবার পেতে মা-ভাইকে নিয়ে সংসার চালাতে চাষের কাজ করতে হয় বছরের অর্ধেক সময়। এর মধ্যেই অবশ্য উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে লালগড় কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে ধৃতিপ্রসাদ ওরফে লাল্টু। ‘‘চাষ করে সংসার চালাতে হয় বলেই অনার্সটা নিতে পারিনি। কিন্তু স্যার যখন আছে, ফুটবলটা তো খেলতে হবে। ওটাই তো আমার সবথেকে প্রিয় জিনিস। আমাদের গ্রামে কিন্তু এখন খেলার সুযোগ বেড়েছে,’’ অকপট ছত্রধরের বড় ছেলে।
‘‘বাবার সঙ্গে ভাল ভাবে কথা হয়েছে সেই ‘দাদুভাই’ মারা যাওয়ার পর যখন বাড়িতে এসেছিল। তার পর লালগড় আদালতে দু’একবার দেখা হয়েছে। আর আলিপুরে দেখা করার তো নানা ঝামেলা।’’ বলার সময় যন্ত্রণাবিদ্ধ মনে হয় ধৃতিকে। ‘‘অন্যরা মানুষ মারল। তারা বেঁচে গেল। আর বাবা কিছুই করল না। কাউকে মারল না। তার জেল হল।’’ কথা বলতে বলতেই উপচে পড়ে ক্ষোভ।
জঙ্গলমহলে তো অনেকেই পুলিশে চাকরি পেয়েছে, আপনি চেষ্টা করেননি কেন? ‘‘না। কখনও চেষ্টা করিনি। আমি ফুটবলার হব। বড় ক্লাবে খেলব। তখন তো এমনিতেই চাকরি পাব। কারও দয়া চাই না। নিজের চেষ্টাতেই সফল হতে চাই।’’ রোগাটে চেহারার নীল-সাদা জার্সির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে রুক্ষ মাটির দেশের মানুষের জীবনীশক্তি।
ময়দান বড় কঠিন জায়গা। মোহনবাগান এবং লিওনেল মেসির অন্ধভক্ত ছত্রধর-পুত্র সেই কঠিন হার্ডল টপকানোর জন্য মরিয়া। এখন দেখার, শেষ পর্যন্ত ধৃতিপ্রসাদের তারকা ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছে পূর্ণ হয় কি না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy