Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

ক্লার্কের টিমের সংশয় বাড়িয়ে দিলেন সিডনির পিচ নির্মাতাও

ম্যাচের বাহাত্তর ঘণ্টা আগে এই সময় সাধারণত অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট-মিডিয়া ম্যাচটা নিয়ে নেয়। আর বিপক্ষকে দুরমুশ করা সম্পূর্ণ করে ফেলে। এক কালে মুম্বই ক্রিকেটজগত সম্পর্কে বাকি ভারতের যা ধারণা ছিল, এদের ব্যাপারেও তাই। ওরা বলত, মাই বম্বে ইওর বম্বে। এরা বলে, আওয়ার অস্ট্রেলিয়া, ইওর অস্ট্রেলিয়া।

তৈরি হচ্ছে সিডনি।

তৈরি হচ্ছে সিডনি।

গৌতম ভট্টাচার্য
সিডনি শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৫ ০৩:২৬
Share: Save:

ম্যাচের বাহাত্তর ঘণ্টা আগে এই সময় সাধারণত অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট-মিডিয়া ম্যাচটা নিয়ে নেয়। আর বিপক্ষকে দুরমুশ করা সম্পূর্ণ করে ফেলে। এক কালে মুম্বই ক্রিকেটজগত সম্পর্কে বাকি ভারতের যা ধারণা ছিল, এদের ব্যাপারেও তাই।

ওরা বলত, মাই বম্বে ইওর বম্বে।

এরা বলে, আওয়ার অস্ট্রেলিয়া, ইওর অস্ট্রেলিয়া।

কী আশ্চর্য! বিশ্বকাপের এমন মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের প্রাক্কালে এ বার অস্ট্রেলীয় মিডিয়ার সেই নির্ঘোষ নেই। উল্টে অজি মিডিয়ার কেষ্টবিষ্টুরা আলোচনা করছেন, ছিয়ানব্বইয়ের শ্রীলঙ্কার সঙ্গে দু’হাজার পনেরোর ভারতের তুলনাটা উপযুক্ত হয় কি না।

ছিয়ানব্বই বিশ্বকাপের মাস ছয়েক আগে অস্ট্রেলিয়ায় এ রকমই লম্বা সফরের মধ্যে ছিলেন মুরলীধরনরা। এমসিজিতে সে বার বক্সিং ডে টেস্ট ম্যাচে মুরলীকে চাকিংয়ের জন্য ‘নো’ ডাকেন ডারেল হার্পার। বাকি সফর জুড়েও অবিরত হাঙ্গামা হতে থাকে। সফরে একেবারেই ভাল খেলতে পারেনি রণতুঙ্গার শ্রীলঙ্কা। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে তারাই লাহৌরে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জিতে নেয়! কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলা হয়েছিল, অস্ট্রেলিয়ায় তিন মাসের রগড়ানি টিমকে মানসিক ভাবে চাবুক করে তুলেছিল।

এ বারের বিশ্বকাপেও কি একই বিশ্লেষণ প্রামাণ্য হবে? ভারত চ্যাম্পিয়ন হলে কি আবার বলা হবে, অস্ট্রেলিয়ায় সাড়ে তিন মাসের রগড়ানি তাদের এমন লড়াকু করে দিয়েছিল যে, কোনও চ্যালেঞ্জেই তারা ভাঙেনি! কারা এমন আলোচনা করছে? না, অজি মিডিয়া!

এটা ভাবাই যায় না যে, অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়া সেমিফাইনালিস্ট বিপক্ষ সম্পর্কে প্রাক্-ম্যাচ এমন ইতিবাচক আলোচনা করতে পারে! আর যেখানে কি না সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে অস্ট্রেলিয়ার টিমটাই তুলনায় ভাল। অনুপাতে খুব বেশি না হলেও বৃহস্পতিবারের ম্যাচে তারাই ফেভারিট।

রবি শাস্ত্রী ইতিমধ্যে তাঁর মাইন্ডগেম শুরু করে দিয়েছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার টিভি চ্যানেল সুপার স্পোর্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকার এবং সিনিয়র অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট সাংবাদিককে করা টেক্সট মেসেজ দু’টোতেই শাস্ত্রী নিঃসঙ্কোচে বলে দিলেন, আমরা অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেব!

এতে আরও বিস্ময়ের সঞ্চার হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার মাঠে গত তিন মাস অস্ট্রেলিয়ার কাছে একটাও ম্যাচ না জিততে পারা দল আগাম বলে দিচ্ছে সেমিফাইনালে মারব, এমন কখনও হয়নি! টিম অনেক সময় মনোবিদের পরামর্শ এবং কোচের সবুজ সঙ্কেত নিয়ে এ ধরনের স্ট্র্যাটেজিগত হুঙ্কার ছাড়ে। অস্ট্রেলিয়ানরাই এর জন্য সবচেয়ে প্রসিদ্ধ।

ধোনির আগের বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দলে মনোবিদ হিসেবে যুক্ত ছিলেন প্যাডি আপটন। এ বার কাউকে নিয়োগ করা হল না কেন?

“কারণ এই টিমটার মনোবিদ আমি বলে! যার যা মানসিক সমস্যা, সেগুলো আমি ঠিক করি,” বললেন রবি শাস্ত্রী।

জর্জ স্ট্রিট রাস্তাটা হল সিডনির ধমনী। খুব কাছেই ইন্ডিয়া টিমের হোটেল। রাস্তার ওপরেই দেখা হয়ে গেল শাস্ত্রীর সঙ্গে। তিনি আর অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন টিম ম্যানেজার স্টিভ বার্র্নার্ড কথা বলতে বলতে হাঁটছেন। এমনিতে সিডনির এই অঞ্চলটার বিশেষত্ব হল, পর্যটকে ভর্তি। সিডনিবাসীরা যেন পর্যটকদের হাতে শহরটাকে তুলে দিয়ে চলে গিয়েছেন! কোন নম্বরের বাড়িটা কোন দিকে, অমুক হোটেল কোথায়, দেখিয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই। উপচে পড়া পর্যটকের বেশির ভাগের ঢেউ চলেছে সামনের চায়নাটাউনের দিকে। চাইনিজ রেস্তোরাঁর বাইরে পুজোর ভিড়। বড় বড় বারগুলোয় প্রাক্-সন্ধে নিখরচায় ডান্স ক্লাস করাচ্ছে কর্তৃপক্ষ! যাতে তাদের দেওয়া ট্রেনারের কাছে নাচ শিখে খদ্দের আবার রাতে সঙ্গিনীকে নিয়ে এই বারেই ফেরত আসে।

এমন উৎসবমুখর শহরে বসে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের প্ল্যান ভাঁজা দু’পক্ষের কাছেই কঠিন। অস্ট্রেলিয়া আবার বাড়তি চিন্তায় রয়েছে ডেভিড ওয়ার্নারকে নিয়ে। ওয়ার্নার এই গত ক’মাসে ভারতের বিরুদ্ধে দু’বার তর্কে জড়িয়ে পড়ে শাস্তি পেয়েছেন। সেমিফাইনালে যদি আরও একটা ঘটনা হয়, তিনি স্ট্রেট সাসপেন্ড হয়ে যাবেন। অস্ট্রেলিয়া ফাইনাল গেলেও তাঁর খেলা হবে না। ভারতের সঙ্গে খেলা হলেই প্রতিযোগিতা আরও তীক্ষ্ন হয়। কোনও না কোনও বচসায় অবধারিত জড়িয়ে পড়েন ওয়ার্নার! তাই তাঁকে বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে, মাথা ঠান্ডা রেখো।

এ দিন ইয়ান চ্যাপেলের লেখাতেও অস্ট্রেলিয়ার ওপর চাপ বেড়ে থাকল। চ্যাপেলের কলমের সঙ্গে এ দেশের কাগজে একটা লাইন যায়সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় কণ্ঠস্বর। ওই লাইনটা না থাকলেও অসুস্থ বেনো পরবর্তী সময়ে চ্যাপেলই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর। তা তিনি এ দিন লিখেছেন, ‘ভারতের জন্য পাকিস্তান অস্ট্রেলিয়ার বেশ কিছু ফুটোফাটা দেখিয়ে দিয়েছে। দেখিয়েছে অ্যারন ফিঞ্চকে অফস্টাম্পের বাইরে থেকে আসা ইনসুইঙ্গারে যে কোনও সময় বিব্রত করা যায়। দেখিয়েছে রাউন্ড দ্য উইকেট এলে ওয়াটসন আর ক্লার্ক দু’জনে বিব্রত হতে পারে। ভারতীয় পেস বোলারদের হয়তো ওয়াহাব রিয়াজের মতো পেস নেই। কিন্তু ওরা যদি ঠিক জায়গায় রাখতে পারে, অস্ট্রেলিয়া সমস্যায় পড়বে।’

অস্ট্রেলিয়াকে হারাব: হুঙ্কার রবি শাস্ত্রীর। —ফাইল চিত্র।

জর্জ স্ট্রিটের কোণে দেখা হয়ে গেল ভারতীয় বোলিং কোচ ভরত অরুণের সঙ্গেও। যিনি চ্যাপেলীয় প্রেসক্রিপশন কাজে লাগানোর জন্য যোগ্যতম লোক। যাঁকে টিম ঠাট্টা করে ডাকছে ‘দ্য ম্যান উইথ সেভেন্টি উইকেটস’! সাত ম্যাচের প্রতিটায় বিপক্ষের দশ উইকেট ফেলে দিতে পারা থেকেই এমন নামকরণ। ভরত আবার মোহিত শর্মার নাম দিয়েছেন ‘ব্যাঙ্কার’। ব্যাঙ্কার কেন? না, সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বলে। টিম ম্যানেজমেন্টের কাছে অসম্ভব প্রশংসিত হচ্ছেন ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গারও। কলকাতায় এলে যিনি নেতাজি ভবনে একবার যাবেনই, সেই বাঙ্গারকে অবশ্য রাস্তাঘাটে দেখলাম না। আন্দাজ করতে পারি হোটেলে নিজের ঘরে বসে মিচেল স্টার্কদের ফুটেজ হয়তো টিভিতে দেখছিলেন!

মিচেল স্টার্ক বলতে মনে পড়ে গেল, পাকিস্তানের সঙ্গে খেলায় ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচে’র পুরস্কার নিতে গিয়ে তাঁর মন্তব্য দ্য নেম ইজ স্টার্ক!

এই ভদ্রলোকের এত রসকষ বোধ আছে বলে শোনা যায় না। নইলে বন্ডের ছবির মতো তাঁরও ইন্ট্রোডাকশন হতে পারত দ্য নেম ইজ পার্কার। টম পার্কার।

সিডনি মাঠের এই চরমপন্থী পিচ প্রস্তুতকারক আপাতত বৃহস্পতিবারে যুযুধান দু’দেশকেই আতঙ্কে রেখে দিয়েছেন। পার্কার অনেকটা ইডেনের প্রবীর মুখুজ্জের মতো। সিডনি ক্রিকেট মাঠের উইকেট হল তাঁর কাছে বাঞ্ছারামের বাগান। বাগানে অন্য কারও হস্তক্ষেপ তিনি বরদাস্ত করতে পারেন না। সেই অনুপ্রবেশকারীর নাম মাইকেল ক্লার্ক বা মহেন্দ্র সিংহ ধোনি, যা-ই হোক না কেন। এই সিডনি মাঠের ভূখণ্ডে কেমন পিচ বানানো হবে, সেটা নিয়ে বেশি নির্দেশ-টির্দেশ তাঁর কাছে অসহ্য। কয়েক বার এমনও হয়েছে যে, হোম টিম ক্যাপ্টেনের দাবি অগ্রাহ্য করে পার্কার ঠিক উল্টো উইকেট বানিয়ে দিয়েছেন। যা তিনি চাননি।

বিশ্বকাপ সেমিফাইনালের মতো মেগা ম্যাচের আগে পার্কারকে কতটা ঘাঁটানো উচিত? এই নিয়ে অস্ট্রেলিয়া শিবিরও দুর্ভাবনায়। ভারতের তো মোটামুটি ঠিক করাই রয়েছে যে, যেমনই উইকেট হোক এক টিম খেলবে। অস্ট্রেলিয়ার তা নয়। উইকেট স্পিনিং হলে পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা টিম ধরে রাখাটা অসুবিধেজনক। তা হলে স্পেশ্যালিস্ট স্পিনার এক জনও টিমে থাকছে না। যদি পরে বল করতে হয় এবং পিচ ঘোরে, তখন ভারতকে বিব্রত করবে কে? সকালে প্রাথমিক আলোচনায় স্থির হয়, অ্যাডিলেডের ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ হ্যাজলউডকে উপায়ান্তর না পেয়ে বাদ দিতে হবে। স্পেশ্যালিস্ট স্পিনার হিসেবে ঢুকবেন জেভিয়ার ডোহার্টি। তার পর আবার বিকেলে মত বদলে গিয়েছে। এখন ঠিক হয়েছে পার্কার যা উইকেটই দিন, কিছু বাউন্স আর পেস তো থাকবেই। সেই সারফেসের ওপরই গতির রথ আর শর্ট পিচ বোলিংয়ে ভারতকে ভেজে ফেলার উদ্যোগ হবে। অস্ট্রেলিয়ানরা মনে করেন, ভারতীয় পেসাররা তাঁদের বিরুদ্ধে অত কার্যকরী হবেন না, টুর্নামেন্ট জুড়ে যা হয়েছেন।

কিন্তু তাতেও ফাঁড়া কাটবে না। কারণ সেমিফাইনালের আসল ব্যথা হয়ে দাঁড়াতে পারেন কোহলিরা। যদি ভারত প্রথম ব্যাট করে। তাই পাকিস্তান মডেলেই অফস্টাম্পের বাইরে স্লিপ, গালি সাজিয়ে প্রচণ্ড গতি সম্পন্ন বোলিংয়ে ভারতকে গেঁথে ফেলার চেষ্টা হবে। মাইকেল ক্লার্কের টিম জেনে গিয়েছে, গোটা গরমকাল জুড়ে তারা যাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি, সেই টিম আর এই টিম এক নয়।

ভারত পিচ নিয়ে আলোচনায় কোনও উৎসাহই দেখাচ্ছে না! ২০১১ বিশ্বকাপের আগেও তারা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, খেলার আগে কেউ পিচ দেখতে যাবে না। মনোবিদ আর কোচের সঙ্গে বসে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, একই উইকেটে যখন ওরাও খেলবে, তখন দেখে লাভ কী? পিচ তো দু’জনের জন্যই সমান।

শাস্ত্রী অবশ্য রাত্তিরে বলছিলেন, “টিম পার্কারকে কাল প্র্যাকটিসের সময় বলে আসব, তোমার ওপর আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। বরাবর তুমি এমন উইকেট বানিয়েছ যেখান থেকে ব্যাটসম্যান-বোলার সমান সুবিধে পায়। আমি জানি, এ বারও ব্যতিক্রম হবে না।”

বললাম না মাইন্ডগেম শুরু হয়ে গিয়েছে। আর তার সূক্ষ্ম সব স্ট্র্যাটেজিও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE