Advertisement
০৩ মে ২০২৪
মার্কিন দিগন্তে তখন মেসি ম্যাজিক

ইউরোয় সবুজ মাঠে দিমিত্রি পায়েতই পিকাসো

পায়েত, আমাদের দিমিত্রি পায়েত আছে! মনে হয় না, তোমরা কেউ বুঝলে। ও সুপারম্যান, ওর পিছনে জিদান। পায়েত, আমাদের একটা দিমিত্রি পায়েত আছে! ফরাসি মিডফিল্ডারকে নিয়ে ওয়েস্ট হ্যামের গানটার যদি বঙ্গানুবাদ করা যায়, এ রকমই দাঁড়াবে না?

ইউরোর মাঠ দেখল পায়েতের ভেল্কি। ফরাসি তারকার বাঁ পায়ের শট এ ভাবেই বাঁক নিয়ে ঢুকে যায় রোমানিয়ার গোলে। শুক্রবার উদ্বোধনী ম্যাচে।

ইউরোর মাঠ দেখল পায়েতের ভেল্কি। ফরাসি তারকার বাঁ পায়ের শট এ ভাবেই বাঁক নিয়ে ঢুকে যায় রোমানিয়ার গোলে। শুক্রবার উদ্বোধনী ম্যাচে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৬ ০৮:৫৭
Share: Save:

পায়েত, আমাদের দিমিত্রি পায়েত আছে!

মনে হয় না, তোমরা কেউ বুঝলে।

ও সুপারম্যান, ওর পিছনে জিদান।

পায়েত, আমাদের একটা দিমিত্রি পায়েত আছে!

ফরাসি মিডফিল্ডারকে নিয়ে ওয়েস্ট হ্যামের গানটার যদি বঙ্গানুবাদ করা যায়, এ রকমই দাঁড়াবে না? ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে যে গানটা শোনা যায় সমর্থকদের গলায়, পায়েতের গোলের সময়। শুক্রবারের স্তাদ দে ফ্রান্সে বাঁ পায়ের শটটা পোস্টকে চুমু দিয়ে গোলে ঢোকার সময় গানটা বোধহয় হয়নি। কিন্তু মার্সেইয়ে অ্যালবানিয়া ম্যাচ দেখতে গিয়ে ফরাসি সমর্থকরা যদি গানটা গাইতে-গাইতে যান? চমক হবে কি?

ফরাসি মনন, মিডিয়া এখন অন্য কথা বলছে। বলছে, জিদান এক জনই। কিন্তু একটা দিমিত্রি পায়েতের জন্যও পাগল হওয়া যায়!

স্তাদ দে ফ্রান্স থেকে শিকাগোর সোলজার ফিল্ড স্টেডিয়াম প্রায় হাজার পাঁচেক মাইল। ভারতীয় সময়ে শুক্রবার রাত থেকে শনিবার ভোর— সময়টা ফুটবল-দেবতার আশীর্বাদধন্য ছিল বোধহয়। অন্য এক মহাদেশ, অন্য এক টুর্নামেন্ট, কিন্তু সেই এক স্বপ্নের বাঁ পা। উনিশ মিনিটে অনির্বচনীয় হ্যাটট্রিক করে চলে যাওয়া এক বাঁ পা। খসখসে, শুকনো, প্রাণহীন এক টুর্নামেন্টকে জীবনের সন্ধান দিয়ে চলে যাওয়া এক বাঁ পা। নেইমার নেই। কিন্তু তিনি ও তাঁর বাঁ পা আছে। সুয়ারেজ ছিটকে গিয়েছেন। কিন্তু তিনি ও তাঁর বাঁ পা থাকবে। দুই মহাদেশের সংস্কৃতি-বৈষম্য, দুই টুর্নামেন্টের আভিজাত্যের প্রভেদ, সব ধুয়েমুছে একাকার হয়ে যায় ফুটবলের ভাষায়। দুই মহাদেশের দুই বাঁ পায়ের ভাষায়।

ইউরোপে ‘পায়েত দ্য পিকাসো।’ আমেরিকায় ‘মেসি দ্য ম্যাজিশিয়ান।’

শনিবার সকালে ফেসবুকে এক আর্জেন্তিনা সমর্থক লিখেছিলেন— মেসিতে পাঁচটা শব্দ। আবার ম্যাজিকেও। তা যে কত বড় সত্যি, শনিবার সকালে কোপা আমেরিকার পাল্টে যাওয়া মানচিত্র থেকে বোঝা যায়। ফ্রান্সে পায়েত নিয়ে পাগলামি এক রাতেই উত্তুঙ্গ পর্যায়ে। ফরাসিরা বলছেন, দুঃখ-যন্ত্রণাময় দেশকে পায়েত দিয়ে গেলেন অনাবিল খুশি। ফরাসি ফুটবলমহলে বলছে, কাদের নায়ক ধরেছিলাম, আর কে তাজ নিয়ে গেল! আঁতোয়া গ্রিজম্যান, পল পোগবাদের নিয়ে ফরাসিদের স্বপ্নের আকাশে কোথাও তো পায়েত ছিলেন না। আন্তর্জাতিক ফুটবল দুনিয়া— গ্যারি লিনেকার থেকে রিও ফার্দিনান্দ, পায়েতের পায়ের জন্য কী বিশেষণ বরাদ্দ রাখবেন, বুঝতে পারছেন না। লিনেকার লিখেছেন, ‘মঁসিয়ে পায়েত, ওয়েল প্লেড। মাঠে তুমি সেরা ছিলে, আর কী গোলটাই না করে গেলে।’ বেলজিয়ামের এডেন হ্যাজার্ড আবার শুধু ‘পায়েত’ শব্দটা লিখে নানা রকম ইমোজি পোস্ট করে দিয়েছেন। কিন্তু শিকাগো— সেখানেও বা কম কী হল? হোক না পানামা। হ্যাটট্রিক, হ্যাটট্রিকই। পায়েত যদি ফরাসিদের অন্ধকারে সোনার রোদ আনেন, মেসি তবে একা আইসিইউ-য়ে ঢুকে যাওয়া এক টুর্নামেন্ট দেখতে টিভির সামনে ফের বসিয়ে দিলেন বিশ্ববাসীকে।

পানামা কোচ তো মেসিকে বলে ফেলেছেন, ‘মনস্টার।’ ভুল বলেননি। শনিবারের আগে পর্যন্ত চোট-আঘাতে মাঠের ধারে বসেছিলেন। আর শনিবার মাঠে নেমে উনিশ মিনিটের মধ্যে রূপকথা! আধঘণ্টার মধ্যে কোপাকে ইউরোর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফিরিয়ে আনা। ফ্রান্সে জড়ো হওয়া গোটা ইউরোপকে বার্তা দেওয়া, তোমাদের একটা রোনাল্ডো, একটা বেল, একটা হ্যাজার্ড, একটা রুনি থাকবে। উল্টো দিকে আমেরিকায় আমি থাকলাম। দেখি কে জেতে!

দুই মহাদেশের দুই মহানায়কের সাফল্যের প্রেক্ষাপটেও অদ্ভুত মিল। পায়েত ফ্রান্সকে জিতিয়ে কাঁদতে-কাঁদতে বলেছেন, ‘‘ইউরোয় গোল করছি, এক বছর আগে কেউ আমাকে বললে তাকে পাগল ভাবতাম।’’ আজকের ফরাসি নায়ক এক বছর আগেও ফুটবল-ঐশ্বর্যের বিচারে ছিলেন কর্পদকহীন। অ্যালবানিয়ার বিরুদ্ধে ফ্রান্সের ০-১ হারের ম্যাচে ক্ষিপ্ত দিদিয়ের দেঁশ তাঁকে হাফটাইমে তুলে নেন। অনেকেই তখন ভেবেছিলেন যে, এই বোধহয় শেষ। পোশাকের দোকানে এক সময় কাজ করে যে ছেলেটা উঠে এসেছিল, ফ্রান্সের নীল জার্সি আর তার পরা হবে না। থিঁয়েরি অঁরির মন্তব্যকে তাই আজ সেরা মনে হবে। পায়েতের পুর্নজন্ম দেখে অঁরি বলেছেন, ‘‘একজন ক্ষতবিক্ষত মানুষকে আজ তোমরা দেখলে। ওর কান্নাই বোঝায় ফ্রান্সের হয়ে ও কতটা খেলতে চেয়েছিল।’

লিওনেল মেসি— চোট-আঘাত ছেড়ে দেওয়া যাক। কোপায় নামতে পারবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তাকে ছেড়ে দেওয়া যাক। সব কিছুর আগে তো দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। তাঁর মন্তব্যই তো মেসির কাছে সবচেয়ে বড় চোট। ক’দিন আগেই পেলের কাছে বলছিলেন দিয়োগো, ছেলেটা ভাল খেলে, কিন্তু নেতা নয়। হ্যাটট্রিক করে পরে মেসি বলে গেলেন, ‘‘ব্যথা আস্তে আস্তে কমছিল। তার পর প্রথম গোলটা করলাম। এটা টিমের জয়। আমরা যেখানে পৌঁছতে চেয়েছিলাম, পৌঁছতে পেরেছি।’’ কোথাও মারাদোনা নেই। কিন্তু ভীষণ ভাবে আছেন।

আসলে পূর্বসুরিকে মেসির বোঝানোর ছিল, নেতৃত্ব নিয়ে বদনাম মুছতে তাঁর উনিশ মিনিট লাগে। পায়েতের আবার একই ভাবে দেশঁকে দিয়ে বলানোর ছিল ‘পায়েত ওয়াজ দ্য ডিফারেন্স’। মেসি বুঝিয়েছেন। পায়েত বলিয়েছেন। সমালোচকদের চুপ করিয়ে, গোটা পৃথিবীকে সম্মোহনের আরামকেদারায় বসিয়ে দিয়ে।

ফুটবলকে কী সাধে জীবন বলে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Euro Cup Dimitri Payet sensational goal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE