প্রশ্ন: ডান কাঁধের কাছে চোটটার জন্য এ মুহূর্তে ভারতীয় ক্রিকেট দলের বাইরে রয়েছেন। খেলতে না পারার যন্ত্রণা নিশ্চয়ই হচ্ছে?
উত্তর: দলের বাইরে থাকা, খেলতে না পারাটা কষ্টের। তবে ওটা নিয়ে ভাবতে চাই না। ভাবাটাই যন্ত্রণার। এখন খেলা থাকলে টিভিতে দেখি। এর বেশি কিছু ভাবছি না।
প্রশ্ন: অস্ট্রেলিয়া সিরিজে উইকেটের পিছনে দুরন্ত ক্যাচ ধরার জন্য আপনাকে তো স্পাইডারম্যানও বলা হয়েছিল। কেমন লেগেছিল তখন?
উত্তর: (হেসে) ভাল। সাউথ অফ্রিকার সঙ্গে ম্যাচেও ভাল ক্যাচ নিয়েছিলাম।
প্রশ্ন: ফর্মুলা ওয়ান গেমটা আপনার খুবই পছন্দের খেলা শুনেছি?
উত্তর: ওটাই তো আমার কাছে এক নম্বর স্পোর্টস। ক্রিকেটটা কিন্তু দ্বিতীয়। এখনও তিনটে-চারটে পর্যন্ত রাত জেগে ফর্মুলা ওয়ান দেখি। ফর্মুলা ওয়ান গেমও খেলি।
প্রশ্ন: শিলিগুড়ির মতো জায়গা থেকে আপনি ভারতীয় দলের ক্রিকেটার হিসাবে উঠে এসেছেন। কবে থেকে ক্রিকেট খেলার দিকে আপনার ঝোঁক হল?
উত্তর: ছোট বেলায় টেনিস বলে ক্রিকেট খেলতাম। পাড়ার ছেলেরা যেমন খেলে। আমার তখন ক্লাস এইট। পাড়ার ক্লাবে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। কাকতালীয় ভাবে ওদের তিন-চারজন উইকেট কিপারের কেউ সে দিন আসেনি। বাবা ছিলেন। বললেন, কিপিং করতে। কয়েকটা ক্যাচ ধরলাম। ভাল লাগল। তবে বাবা বলেছিলেন যদি ভাল লাগে, মন থেকে মজা পাই তবেই যেন খেলি, কিপিং করি। তারপর ভেবে ঠিক করলাম খেলব।
প্রশ্ন: তা হলে খেলার জন্যই পড়াশোনা থেকে দূরে সরে গেলেন?
উত্তর: ছোট থেকেই পড়াশোনার ইচ্ছে ছিল না আমার। পাস নম্বর পাওয়ার মতো পড়তাম। খেলা দেখতাম। আর খেলতাম। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত হাতে গোনা খুব কমই স্কুলে অনুপস্থিত থেকেছি। ক্লাস এইট থেকে খেলার জন্য স্কুলে অনুপস্থিতি বাড়তে থাকে।
প্রশ্ন: অন্য কোনও দিকে চেষ্টা করেছিলেন?
উত্তর: আরও আগে বাড়ি থেকে চেষ্টা হয়েছে। মা, দাদা (অনির্বাণ)-কে গান, আমাকে তবলা শেখানোর ব্যবস্থা করলেন। খাতাপত্র কেনা হল। কিন্তু আমি যাইনি। মন টানেনি। আমার দাদা এখন মিউজ়িশিয়ান। মুম্বইতে রয়েছে। দাদা যখন কলেজে পড়ছে ও বলেছিল মন দিয়ে খেল। বাড়ি থেকে টেবল টেনিস খেলার জন্য বলেছিল। সেটাও খেলিনি।
প্রশ্ন: শিলিগুড়ির অগ্রগামী ক্লাবেই অনুশীলন করে উঠে এসেছেন। কখন থেকে ওই ক্লাবে খেলতে শুরু করেন?
উত্তর: পাড়ার ক্লাবে ক্রিকেট খেলার কিছুদিন পর থেকেই বাবার সঙ্গে অগ্রগামী ক্লাবে যেতাম। বাবা ওই ক্লাবে খেলতেন।
প্রশ্ন: আপনার বাবা প্রশান্তবাবু তো ভাল ফুটবল খেলতেন? গোলকিপার ছিলেন। আপনি ফুটবল না খেলে ক্রিকেটে এলেন কেন?
উত্তর: ফুটবল তখন একটু-আধটু খেলতাম। ছোট বেলায় ক্রিকেট, ফুটবল রাত জেগে টিভিতে দেখতাম। তবে ক্রিকেটাই খেলব বলেই ঠিক করলাম। আমাকে টেবিল টেনিস খেলার জন্য মা ক্লাবে দিয়েছিলেন। যদিও মা বলতেন, পড়াশোনা করতে। কিন্তু বাবা বলতেন পড়াশোনা কর, সঙ্গে খেল।
প্রশ্ন: বড় ম্যাচ খেলা কবে থেকে শুরু হল?
উত্তর: বড় ম্যাচ বলতে ওই সময় অগ্রগামীতে এক মাস অনুশীলনের পর অনূর্ধ্ব ১৩ টুর্নামেন্ট, যেটা সিএবির অম্বর রায় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, সেটাই ক্লাবের হয়ে খেলতে যাই কলকাতায়। ডিউজ বলে প্রথম টুর্নামেন্ট। পরে এসে আন্তঃজেলা অনূর্ধ্ব ১৬ খেলি। কোচবিহার, জলপাইগুড়ি বিভিন্ন জেলায় গিয়ে খেলতে থাকলাম। ম্যাটে খেলা হত। এরপর অনূর্ধ্ব ১৯ দলে খেলি।
প্রশ্ন: কলকাতায় কী ভাবে খেলা শুরু হল? কোন ক্লাবের হয়ে খেলতেন?
উত্তর: তখন বয়স ষোলো। ভাইদা (অগ্রগামীর কোচ জয়ন্ত ভৌমিক) কুমারটুলিতে ব্যবস্থা করে দিেলন। শিলিগুড়ির কামাল হাসান মণ্ডল কুমারটুলিতে খেলতেন। ভাইদা নিজেও এক সময় কুমারটুলি থেকেই খেলা শুরু করেছিলেন। প্রথম বছর ছ’টা ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম। কারণ ওদের কিপার ছিল। তিনি যখন খেলেননি বা ব্যাটসম্যান হিসাবে খেলেছেন, আমি তখন কিপার হিসাবে সুযোগ পেয়েছি। ব্যাটিং অর্ডার সে বছর পাইনি।
প্রশ্ন: বাংলা দলে কী ভাবে সুযোগ এল?
উত্তর: প্রথমে অনূর্ধ্ব ১৬, অনূর্ধ্ব ১৯ বাংলা দলের ‘ট্রায়াল’-এ সুযোগের চেষ্টা করি। হয়নি কোনও কারণে। তার পর অনূর্ধ্ব ১৯ দলে সুযোগ মিলল। সেখান থেকে অনূর্ধ্ব ২২। সেখান থেকে বাংলা একদিনের ক্রিকেট দলে। তারপরই রনজি খেলতে বাংলা দলে সুযোগ এল।
প্রশ্ন: ভারতীয় দলে খেলার ইচ্ছে কী আগে থেকেই ছিল? বা কখন থেকে সেটা জাঁকিয়ে বসল।
উত্তর: ভাল জায়গায় খেলার ইচ্ছে সবারই থাকে। অনূর্ধ্ব ১৯ বাংলা দলে যখন খেলছি, তখনও ইচ্ছে ছিল। মাথা বলছে আমি খেলব। তবে ভিতর থেকে একটা আর্জ, তাগিদ—ভাল পারফরম্যান্স করলে আমি ভারতীয় দলে খেলতে পারি। এটা এসেছিল অনূর্ধ্ব ১৯ খেলার পর। তখন অনূর্ধ্ব ২২ দলে যাওয়ার ইচ্ছা।
প্রশ্ন: উত্তরবঙ্গের মতো এলাকা থেকে যাঁরা যান, কলকাতায় তাঁদের থাকার সমস্যা হয়। আপনি কোথায় থাকতেন?
উত্তর: আমি কোলে মার্কেটে একটা মেসে থাকতাম। কামাল সেখানেই থাকত। ওর সঙ্গে থাকতাম। এমনকী ভারতীয়-এ দলে খেলার সময়ও কোলে মার্কেটের ওই মেস থেকে খেলেছি। প্রথম ম্যাচ ইজরায়েলের সঙ্গে খেলেছিলাম মনে রয়েছে। অশোক দিন্দা-সহ অনেকেই থাকত সেখানে।
প্রশ্ন: পরে কলকাতার আর কোন কোন ক্লাবে সুযোগ এসেছিল?
উত্তর: কুমারটুলির পরে কলকাতা কাস্টমসে বছর দু’য়েক তারপর শ্যামবাজার ক্লাবের হয়ে তিন বছর খেলেছি। কাস্টমসে থাকার সময় অনূর্ধ্ব ১৯ বাংলা দলে খেলতাম। অনূর্ধ্ব ২২ খেলার সময় শ্যামবাজারে।
প্রশ্ন: এর পরেই কী বাংলা মূল দলে সুযোগ?
উত্তর: হ্যাঁ, তারপর বাংলার একদিনের ক্রিকেট দলে সুযোগ। দীপ দাশগুপ্ত তখন খেলছেন। খেলতে থাকলাম। দীপদা যে বছর আইসিএল খেলতে গেলেন, সে বছর আমি বাংলায় খেলার সুযোগ পেলাম। সেটা এক দিনের ম্যাচ খেলার পরের বছরই। আইসিএল না হলে হয়তো দীপদাও খেলতেন। আমার হয়তো ডেবিউ করতে দেরি হত।
প্রশ্ন: ভারতীয় ক্রিকেট দলে আজকের জায়গায় পৌঁছতে তো অনেক লড়াই করতে হয়েছে আপনাকে?
উত্তর: লড়াই এবং ধৈর্য। এটা সব সময়ই রাখতে হবে। লড়াই সব সময়ই থাকে। প্রথম দিন থেকে এখন পর্যন্ত। লড়াই ছাড়া মানেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।
প্রশ্ন: আপনি ডেবিউ ম্যাচ তো দারুণ পারফরম্যান্স করেছিলেন?
উত্তর: হ্যাঁ, ১১১ রান করে অপরাজিত ছিলাম হাদরাবাদের বিরুদ্ধে। শুরুটা ভাল হওয়াতে সুবিধে পেলাম। তার পরের বছর সেখান থেকে আইপিএল-এ সুযোগ। ২০০৮ সম্ভবত। সেখান থেকে ইন্ডিয়া-এ দলে।
প্রশ্ন: এই সময়টা, যখন একটা জায়গা থেকে আরেকটা জায়গায় লডাই করে সুযোগ করে নিতে হচ্ছে নিশ্চয়ই টেনশনে কাটাতে হত?
উত্তর: না, টেনশনের মধ্যে আমি কখনও থাকতাম না। ছোট থেকেই। এটা বিশ্বাস করি না, টেনশনে থাকলে ভাল হবে। এমনি সময় যে ভাবে স্বাভাবিক থাকি, সুযোগ আসার সময়েও তেমন করেই থাকতে হবে। নিজের উপর চাপ সৃষ্টি করা ঠিক নয় বলেই মনে হয়। সুযোগ এসেছে, ভাল করার চেষ্টা করব। সেটা করতে না পারলেও ঠিক আছে। আবার সুযোগ তৈরি করতে হবে। বারবার চেষ্টা করতে হবে। একবার-দু’বার হচ্ছে না বলে, হাল ছেড়ে দেওয়ার মধ্যেও আমি নেই।
প্রশ্ন: শিলিগুড়িতে জয়ন্ত ভৌমিক তথা ভাইদার পরামর্শের উপর খুব নির্ভর করতেন, এ কথা অনেক সময়ই বলেছেন। এখনও শুনেছি অনেক বিষয়ে পরামর্শ নিয়ে থাকেন?
উত্তর: অনূর্ধ্ব ১৩ থেকে বাংলা ১৯ দলে খেলা পর্যন্ত ভাইদা পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকী আইপিএল খেলার পরও। কোথায় কী সমস্যা হত, কী করতে হবে তিনিই ভাল বুঝতেন। অনেক কিছু হয়তো আমিও জানতাম না। বলে দিতেন। এখনও বাইরে গেলেও যোগাযোগ থাকে। খেলার আগে পরে। ছোট বেলায় যেটা শিখেছি তার উপর ভিত্তি করেই তো অতদূর গিয়েছি। তাই এই পরামর্শ জরুরি। অনেকে এখনও বলে তুমি যে ভাবে খেলে এসেছ, সেভাবেই খেল।
প্রশ্ন: উঠতি ক্রিকেটারদের কী পরামর্শ?
উত্তর: প্রথম কথাই হচ্ছে নিজের ইচ্ছে। তা না থাকলে কেউ ২৪ ঘন্টা চেষ্টা করলেও হবে না। পরামর্শ নিচ্ছে অনেকে। তার মধ্যে, যার ইচ্ছে আছে, সে আগে সেটা রপ্ত করে উঠে আসবে। তা ছাড়া ডিসিপ্লিন, স্কিল, টেকনিক রপ্ত করা তো রয়েইছে। ভাল করে করার ইচ্ছে, নতুন কিছু জানার ইচ্ছেটাই বড়। যারা এখন বড় জায়গায় খেলছে তাদেরও, এই ইচ্ছেটা যদি চলে যায় মনে হবে এত ভাল খেলত, এখন কেন পারছে না? যেটা করব, একশো শতাংশ মন দিয়ে তা করা উচিত।
প্রশ্ন: শিলিগুড়ি থেকে আপনার মতো আর কেউ উঠে আসছে না কেন?
উত্তর: আমার আগে এখান থেকে অনেকেই বাংলা দলে খেলেছে। ভাইদা হয়তো কোনও কারণে রণজি ট্রফি খেলতে পারেননি। আমার আগে রণজি খেলেছেন কামাল হাসান মণ্ডল। অনেকেই অনূর্ধ ১৪, ১৬, ১৯ খেলছে এখনও। ভাল খেলেও হয়তো সুযোগ হল না। তখন ছেড়ে দিলে হবে না। কেউ হয়তো দু’বার ভাল করল, সুযোগ হল না। তৃতীয়বারে হয়তো পেয়ে যেত। কিন্তু তার আগেই হয়তো হতাশ হয়ে, অনুশীলন ছেড়ে দিয়েই কেরিয়ার শেষ করে দিল।
প্রশ্ন: কোন ম্যাচকে সেরা তালিকায় রাখছ?
উত্তর: সব ম্যাচই বেস্ট। জাতীয় দলের হয়ে যে ভাবে খেলি, অফিসের হয়েও সে ভাবে খেলি। অফিস ম্যাচেও আমার অনেক পঞ্চাশ, একশো রয়েছে। ভাল ক্যাচ আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy