সোনাজয়ী: কেরলকে পাঁচ গোলে হারায় বাংলার ফুটবলাররা। ফাইল চিত্র।
জাতীয় গেমসে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে বাংলার ফুটবলারদের জন্য অপেক্ষা করল ‘বিশেষ পুরস্কার’। অন্য কারও হাত দিয়ে নয়, সেই ‘পুরস্কার’ তুলে দিয়েছেন বাংলারই ফুটবল প্রশাসকেরা। বঙ্গ ফুটবলের রক্ষক, আইএফএ কর্তারা।
কী সেই পুরস্কার?
না, আমদাবাদ থেকে দু’রাতের উপরে ট্রেন যাত্রার ধকল সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় ফেরো। এই হল সোনা জিতে রাজ্যের মুখ উজ্জ্বল করা ফুটবলারদের জন্য কর্তাদের ‘বিশেষ পুরস্কার’। শুনে মনে হতে পারে সত্যি নয় গপ্পো। কোনও সংস্থা রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে রাজ্যকে গর্বিত করে সোনা জেতানো খেলোয়াড়দের এমন ভাবে ট্রেনে ফেরাতে পারে?
তা হলে শুনুন, চলন্ত ট্রেন থেকে ফুটবলারদের মুখ থেকেই শুনে নিন সত্যি না গপ্পো। আনন্দবাজারের ফোন পেয়ে দলের এক ফুটবলার বলে দিলেন, ‘‘হ্যাঁ, আমরা ট্রেনেই ফিরছি। বুধবার ট্রেনে উঠেছি। শুক্রবার দুপুরে কলকাতায় পৌঁছব।’’ কেন ট্রেনে ফিরতে হচ্ছে? আইএফএ কি ফ্লাইটের টিকিট করতে চায়নি? সেই ফুটবলারের জবাব, ‘‘আমরা অনুরোধ করেছিলাম ফ্লাইটের টিকিট দেওয়ার জন্য। যাতে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতে পারি। তা ছাড়া দু’রাত যাত্রার ধকলটাও তা হলে এড়ানো যেত।’’ কর্তারা কী বললেন ফুটবলারদের প্রস্তাব শুনে? বঙ্গ ফুটবল কর্তাদের যে কী করুণ অবস্থা, তা বেরিয়ে এল ফুটবলারটির জবাবে। ‘‘আমাদের বলা হয়েছে, ফ্লাইটের টিকিটের যে খরচটা হত, সেটা রেখে দেওয়া হল। আমাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে,’’ বললেন তিনি।
এখানই শেষ নয়। সোনা জিতে ট্রেনে ফিরতে নিশ্চয়ই হতাশ লাগছে? ফুটবলারটির উত্তর, ‘‘হতাশ লাগলেও তো কিছু করার নেই। আমাদের হাতে তো কিছু নেই।’’ আরও কেউ কেউ যোগ করলেন, ‘‘বাড়ি থেকে, পরিবার থেকে অনেকে ফোন করছে। জিজ্ঞেস করছে, তোরা ফ্লাইটে ফিরছিস না? কী বলব, লজ্জা লাগলেও বলতে হচ্ছে, না, ফিরছি না। আমরা ট্রেনে ফিরছি।’’
কোথায় গর্বের সঙ্গে সোনার পদক ঝুলিয়ে ফিরবেন। না, মাথা হেঁট করে বলতে হচ্ছে, ট্রেনে করে ফিরছি। ফুটবলারদের হাতে যতটুকু ছিল, সেখানে লেটার মার্কস নিয়ে পাশ করেছেন তাঁরা। কেরলের মতো দলকে ফাইনালে ৫-০ হারিয়ে সোনা জিতেছেন। সেই কেরল যাদের কাছে সন্তোষ ট্রফির ফাইনালে হেরেছিল বাংলা। জাতীয় গেমসে সার্ভিসেসের মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়েছে। আর যেখানে কর্তাদের সামান্য পরীক্ষা দেওয়ার ছিল, সেখানে তাঁরা ডাহা ফেল।
ফুটবলারেরা ট্রেনে করে দু’রাতের উপরে যাত্রা করে ফিরছেন। অথচ, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরে আইএফএ থেকে যে সব কর্তারা গিয়েছিলেন গৌরবের মূহূর্তের ভাগীদার হতে, ছবি তোলার জন্য পোজ় দিতে, কৃতিত্বের অংশীদার হতে, তাঁরা প্রত্যেকে ফিরে এসেছেন ফ্লাইট ধরেই। বাংলা থেকে বেঙ্গল অলিম্পিক সংস্থার উচ্চ কর্তারাও ছিলেন। জাতীয় গেমস মানে তাঁরাও দায় এড়াতে পারেন না। তাঁরা ফ্লাইট ধরে চলে এসেছেন। কোচ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যও ফিরে এসেছেন বিমান ধরে। যে যাঁর নিজেদের আরাম খুঁজে নিয়েছেন, অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকলেন ফুটবলারেরা। কেউ কেউ রসিকতা করে বলে ফেলছেন, ‘‘চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরেও এই পুরস্কার! জাতীয় গেমসে ব্যর্থ হলে তো মনে হয় হাঁটিয়ে ফেরানো হত ফুটবলারদের!’’ নিজের রাজ্যের ফুটবলারদের প্রতি কর্তাদের লজ্জাজনক আচরণই বলে দিচ্ছে বঙ্গ ফুটবল আজ কেন এত দীন!
বিশেষ করে আমদাবাদ থেকে ট্রেন যাত্রা মানে আরও বেশি ধকলের। দু’রাতের উপরে ট্রেনে থাকতে হবে। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা বলার মতো নয়। দেখেশুনে মনে হবে, চ্যাম্পিয়ন হয়ে নয়, বাংলার মানসম্মান ডুবিয়ে যেন ফিরছেন ফুটবলারেরা।
যাঁরা কি না বাঙালির প্রিয় দুর্গাপুজোর উৎসব ছেড়ে রাজ্যকে সোনা এনে দেওয়ার লড়াই করছিল। ঢাকের বাজনার তালে তালে যখন সকলে আনন্দ করছিল, তাঁরা কি না নিজেদের নিংড়ে দিচ্ছিল সোনার জন্য! যাঁরা ন’দিনে পাঁচটি ম্যাচ খেলার মধ্যেও স্বপ্ন দেখা ছাড়েনি। এর পর ফুটবলারেরা যখন ট্রেনে করে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে ফিরবেন, তাঁদের স্টেশনে বরণ করতে ছুটবেন কর্তারা। সংবর্ধনা দেওয়ার হিড়িকও পড়বে। ট্রফির সঙ্গে ছবিটায় যে মুখ দেখাতে হবে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy