Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
একই সরকারি হাসপাতালের দুই ছবি

ক্রীড়ামন্ত্রীর ভিআইপি ঘরের নীচেই চরম অবহেলায় চিকিৎসা চলছে বাংলার সফল মেয়ে ফুটবলারের

সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠলেই বোঝা যায় কোনও ভিআইপি চত্বরে এসে পড়েছি। পুলিশ, সান্ত্রী, ডাক্তার, নার্সদের সর্বক্ষণের ব্যস্ততা। এখানেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল ঘরে রয়েছেন সারদা কাণ্ডে অভিযুক্ত রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র। এলাহি আয়োজনের মাঝে। সিঁড়ি দিয়ে না উঠে ডানদিকের একটা দরজার ভিতর দিয়ে ঢুকে গলি, তস্য গলি পেরিয়ে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল কোনও অন্ধকার ভুলভুলাইয়ায় এসে পড়েছি। মেয়েদের অর্থোপেডিক ওয়ার্ডের সারি সারি পাতা বেড দেখে আচমকা কোনও কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বলে মনে হতে পারে!

আর খেলব না বাংলায়। প্রতিজ্ঞা হতাশ কুসুমিতার। ছবি: উৎপল সরকার।

আর খেলব না বাংলায়। প্রতিজ্ঞা হতাশ কুসুমিতার। ছবি: উৎপল সরকার।

রতন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৫ ০৪:২৭
Share: Save:

সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠলেই বোঝা যায় কোনও ভিআইপি চত্বরে এসে পড়েছি। পুলিশ, সান্ত্রী, ডাক্তার, নার্সদের সর্বক্ষণের ব্যস্ততা। এখানেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল ঘরে রয়েছেন সারদা কাণ্ডে অভিযুক্ত রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র। এলাহি আয়োজনের মাঝে।

সিঁড়ি দিয়ে না উঠে ডানদিকের একটা দরজার ভিতর দিয়ে ঢুকে গলি, তস্য গলি পেরিয়ে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল কোনও অন্ধকার ভুলভুলাইয়ায় এসে পড়েছি। মেয়েদের অর্থোপেডিক ওয়ার্ডের সারি সারি পাতা বেড দেখে আচমকা কোনও কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বলে মনে হতে পারে! এখানেই ভর্তি আছেন মেয়েদের ফুটবলে বাংলা এবং ভারতের অন্যতম সেরা স্টপার কুসুমিতা দাস। পরিবারের সামান্য জমি বন্ধকের অর্থে যাঁর বাঁ পায়ে অস্ত্রোপচার হয়েছে চব্বিশ ঘণ্টা আগেই। কেরলে বাংলার হয়ে জাতীয় গেমসে খেলতে গিয়ে চোট পেয়েছিলেন। তার পর খোঁজ রাখেনি কেউ-ই।

দু’টোই এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ড!

যার দোতালায় ভিআইপি রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী, নীচের তলায় রাজ্যেরই কপর্দকহীন অসহায় কিন্তু প্রবল সফল এক মেয়ে ফুটবলার— দু’টো এলাকা শুক্রবার বিকেলে ঘোরার পর মনে হচ্ছিল আলোর নীচে সত্যিই নিকষ অন্ধকার থাকে।

‘‘আমি আর কোনও দিন বাংলা কিংবা ভারতের হয়ে খেলব না। কী লাভ খেলে? চার মাস ধরে সবার দোরে দোরে ঘুরেও কোনও আর্থিক সাহায্য পাইনি। সবাই শুধু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অথচ কেরলে চোট পাওয়ার পরেও বাংলাকে জেতানোর জন্য পঁয়তাল্লিশ মিনিট মাঠে ছিলাম। ওটাই আমার কাল হল,’’ বলার সময় গলা ভারী হয়ে যায় সন্দেশখালি খুলনার কুসুমিতা ওরফে টুম্পার। চোখের জল শত চেষ্টাতেও বাঁধ মানে না।

মাটির বাড়ি আর খড়ের চাল মাটিতে মিশে গিয়েছিল আয়লার সময়। মাঝেমধ্যেই রায়মঙ্গল নদীর জলোচ্ছাসে, কখনও বা ঝড়ে ভেঙে যায় মাটির বাড়ি। তাতে অবশ্য এখন আর কান্না পায় না, দুঃখ হয় না টুম্পাদের। বাবা আশুতোষ দাস নদীতে কাঁকড়া ধরেন। দাদা জনমজুরের কাজ করেন। সেই সামান্য রোজগারে মাঝেসাঝেই খাবার জোটে না সেটাও মেনে নিয়েছেন টুম্পা। কিন্তু বাংলার হয়ে খেলতে গিয়ে এই করুণ পরিণতি হবে ভাবেননি। ‘‘চোট পাওয়ার পর হাঁটতে পারছিলাম না। যন্ত্রণা হত প্রতিদিন। ডাক্তার অস্ত্রোপচার করতে বলেছিলেন। কিন্তু টাকা কোথায়? কে দেবে? আমি গ্রামের মেয়ে। কিছুই চিনি না। ব্যান্ডেজ বাঁধা পায়েই আইএফএ, ক্রীড়াপর্ষদ, বিওএ সবার কাছে ছুটেছি। কিন্তু কেউ সাহায্য করেনি। শেষ পর্যন্ত বাবা বললেন, ‘তুই তো আমার মেয়ে। তোকে তো আমাকেই সুস্থ করতে হবে।’ আমাদের ভিটে-মাটি বন্ধক রেখে টাকা নিয়ে এসেছেন বাবা। সেই টাকাতেই অপারেশন হল।’’ কুসুমিতার কথাগুলো আরও একবার তীক্ষ্ম ভাবে বুঝিয়ে দেয় বাংলার খেলাধুলোর দৈন্যতা। এ রাজ্যের ক্রীড়াকর্তাদের মনোভাবটাও।

কোনও সাহায্যই কি পাননি কুসুমিতা? পেয়েছেন! জাতীয় গেমসে বাংলার মেয়ে টিমের ম্যানেজার আর তাঁর বাবা মিলে এমআরআইয়ের খরচ যোগাড় করে দিয়েছেন। বিওএ প্রেসিডেন্ট হাসপাতালের বেডের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আর এক মহিলা ফুটবলের কর্তা সেই বেড ফ্রি করে দিয়েছেন। ব্যাস এইটুকুই। কিন্তু প্রায়ান্ধকার ঘরের বিছানার নীচে যে বিপজ্জনক ভাবে বিড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা দেখতে আসেননি আইএফএ বা বিওএ-র কোনও কর্তাই। বাংলা ফুটবলের যাঁরা নিয়ন্ত্রক। দোতালায় ক্রীড়ামন্ত্রীর কাছে কিন্তু অন্য অনেক মন্ত্রী ছাড়াও আসেন ক্রীড়া দফতরের লোকজন। কিন্তু তাঁরা তার নীচেই কুসুমিতার কাছে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি এখনও!

কুসুমিতা ক্লাব ফুটবল খেলছেন ছোটবেলা থেকেই। বাংলার হয়ে খেলছেন টানা প্রায় ছয় বছর। ভারতীয় দলে ছিলেন তিন বার। আপাতত পুলিশের মেয়েদের টিমের ফুটবলার। গ্রিন পুলিশে চাকরির সুবাদে। মাইনে পান সাকুল্যে চার হাজার দু’শো টাকা। ‘‘আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে আসতে-যেতেই দু’শো টাকা খরচ। তাই হাওড়ায় অনেক কষ্টে বাড়ি ভাড়া করে থাকি। ডাক্তাররা তো বলছেন সেরে উঠতে এক বছর লাগবে। জানি না পুলিশের হয়ে আর আদৌ খেলতে পারব কি না। তবে আমার অফিসের কোচ আর অন্যরা খুব সাহায্য করছেন,’’ নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশার কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে গ্রাম্য মেয়েটির মুখে। আশঙ্কায় রয়েছেন, বাবার বন্ধক দেওয়া জমিও আর কোনও দিন ছাড়িয়ে আনতে পারবেন কি না!

কুসুমিতার লিগামেন্টের অস্ত্রোপচার করতে কত খরচ হয়েছে? রোগাটে চেহারার মেয়েটি মাথা নিচু করে জানায়, চল্লিশ হাজার!

অস্ত্রোপচারের পর বন্ধু কেমন আছেন তা দেখতে এসেছিলেন কয়েক জন সতীর্থ ফুটবলার। তাঁদেরই মধ্যে একজন যা শুনে বলে ফেললেন, ‘‘শুনছি ক্রীড়ামন্ত্রীর জেল-হাসপাতালের প্রতিদিনের খরচ নাকি পঞ্চাশ হাজার টাকা! সত্যি?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE