Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
পঁচাত্তরের সঙ্গে পনেরোর আড্ডা

ডং, তর গোলটা ডার্বিতে আমিও করসি

বাড়ি থেকেই ১৮ নম্বর লেখা লাল-হলুদ জার্সিটা ব্যাগে নিয়ে বেরিয়েছিলেন। তার পর সটান ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুমে ঢুকে তাঁদের টানা ছ’টা লিগ জেতার রেকর্ডের ইতিহাস চল্লিশ বছর পরে স্পর্শের উপহারস্বরূপ সেটাই এখনকার প্রজন্মের মেহতাব, সৌমিকদের হাতে তুলে দিলেন সমরেশ চৌধুরী। ‘‘আমাগো ছোঁয়ার জন্য তদের লগে এই জার্সি।’’

ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুমে চ্যাম্পিয়নদের সঙ্গে সমরেশ চৌধুরী। সোমবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুমে চ্যাম্পিয়নদের সঙ্গে সমরেশ চৌধুরী। সোমবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।

দেবাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০২:২৩
Share: Save:

বাড়ি থেকেই ১৮ নম্বর লেখা লাল-হলুদ জার্সিটা ব্যাগে নিয়ে বেরিয়েছিলেন। তার পর সটান ইস্টবেঙ্গল ড্রেসিংরুমে ঢুকে তাঁদের টানা ছ’টা লিগ জেতার রেকর্ডের ইতিহাস চল্লিশ বছর পরে স্পর্শের উপহারস্বরূপ সেটাই এখনকার প্রজন্মের মেহতাব, সৌমিকদের হাতে তুলে দিলেন সমরেশ চৌধুরী। ‘‘আমাগো ছোঁয়ার জন্য তদের লগে এই জার্সি।’’

ময়দানের ‘পিন্টু’-র এর পরে মেহতাবদের কাছে আবদার, ‘‘অখন আই লিগটাও আন। বাইসা থাকতে থাকতে দেইখ্যা যাই।’’ ততক্ষণে সমরেশের আনা জার্সির উপর মার্কার দিয়ে খাবরা লিখে ফেলেছেন ‘ফ্রম ফর্মার চ্যাম্পিয়ন টু কারেন্ট চ্যাম্পিয়ন— লং লিভ পিন্টুদা’।

লাল-হলুদের প্রথম হেক্সা লিগ জয়ে টানা ছ’বছরই টিমে ছিলেন সমরেশ ছাড়াও সুধীর কর্মকার। সোমবার ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে সুধীর না এলেও সমরেশ হাজির ছিলেন সকালে ইস্টবেঙ্গল মাঠে ক্লাব পতাকা তোলার অনুষ্ঠানে। যেখানে লাল-হলুদের সাফল্য, আবেগের সঙ্গে নস্ট্যালজিয়াও মিলেমিশে একাকার।

ড্রেসিংরুমে এক প্রান্তে বসেছিলেন ইস্টবেঙ্গলের নতুন ‘প্রিন্স চার্মিং’ ডু ডং হিউন। তাঁকে সেই নিজের প্রিয় ১৮ নম্বর জার্সি দেখিয়ে সমরেশের বাঙাল ভাষায় রসিকতা, ‘‘আটতিরিশ বচ্ছর আগে সাতাত্তরের বড় ম্যাচে তর মতো আমিও চল্লিশ গজের ফ্রিকিকে গোল করসিলাম রে। কাজেই ঘ্যাম নিবা না...।’’ বলেই অবশ্য সমরেশ বুকে জড়িয়ে ধরলেন তাঁর প্রিয় ক্লাবের তরুণ কোরিয়ান ফুটবলারকে। ডংকে তখন এ সব কিছু তর্জমা করে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন অ্যালভিটো। বিষয়টা বুঝে ডংও হাসতে লাগলেন হো হো করে।

ড্রেসিংরুমে অন্য প্রান্তে তখন বসে এ বারের ‘হেক্সা লিগ’ জয়ী লাল-হলুদের ছ’বছরই টিমে থাকা তিন ফুটবলার। খাবরা, মেহতাব, সৌমিক। তাঁদের জার্সি দেওয়ার পরেই বসল আড্ডা। বন্ধ সেই ড্রেসিংরুমে একমাত্র হাজির আনন্দবাজার। আর তার পরের কথাবার্তা এ রকম:

মেহতাব: পিন্টুদা, আপনাদের ছ’টা লিগ জয়ে কোনটা সবচেয়ে কঠিন ছিল?

সমরেশ: ধুর, কী যে কস! একটাও না। পান চাবাইতে চাবাইতে মাঠে নামতাম। তোদের কোনটা?

খাবরা: এ বারেরটা দাদা। দশটা দল। চারটে নামবে। ফলে লড়াই আরও বেশি। সঙ্গে সাপোর্টারদের টানা ছ’বার লিগ পাওয়ার প্রত্যাশার চাপ। তার উপর আর্মি আর কালীঘাট ম্যাচে তো ফার্স্ট হাফে দু’গোলে হারতে থাকা। সেই সব সামলে লিগ চ্যাম্পিয়ন আমরা।

সমরেশ: (খাবরার পিঠে স্নেহসুলভ থাপ্পড় মেরে) তাইলে লাল-হলুদ জার্সিটা পড়ছস ক্যান?

সৌমিক: শুনেছি, আপনাদের সময় কলকাতা লিগ আরও চাপের ছিল?

সমরেশ: তা আর কইতে? ড্র করলেই তাঁবু ঘেইরা ফেলত সাপোর্টার লগে। তবে চাপটা ভাল। প্রমাণ করার তাগিদ আসে। তবে আমাগো টাইমে শুধুই চাপ নয় রে, কর্তাদের ভালবাসাও কম ছিল না।

মেহতাব: দু’একটা ঘটনা বলুন না?

সমরেশ: (মুচকি হেসে) আমাগো পল্টুদা, জীবনদা, ডাক্তারদা (ডা. নৃপেন দাস)-রা ছিলেন মহান মানুষ। পল্টুদা তো গার্জেন-কাম-বন্ধু। প্লেয়ারের বাড়ির চাল, চিনি থেইক্কা চিকিৎসা সব ম্যানেজ করতেন একা। একাত্তরে আমি আর সুধীর এক দিন ডাক্তারদার কাছে গিয়া কইলাম, সুধীরের হাজার আর আমার পাঁচশ টাকা লাগব’। শুনে ডাক্তারদা কইলেন কথাটা ইংরেজিতে ক। আমি কইলাম, পড়াশোনা জি়গাইস্যান ক্যান? একটা বল দিই আপনারে। দশ বার নাচান তো? ডাক্তারদা তখন হাসতে হাসতে কইলেন, যা, কাল টাকা দিয়া দিমু।

সৌমিক: আমাদের নীতুদা, কল্যাণদা, বাবুদারাও এ রকমই।

মেহতাব: আমার কেরিয়ারে যখন ভাঁটার টান তখন নীতুদাই দিনের পর দিন ঘরে ডেকে বুঝিয়েছে— চিন্তা নেই তুই পারবিই। এটাই টানা ছ’টা লিগ জয়ের বড় শক্তি।

সমরেশ: আমরা যখন ছ’বার লিগ আনসি তখনকার ওই তিন কর্তা আজ আর নাই। কেবল স্বপনদারে দেখি। আর দেখি সে দিনের পোলা নীতুরে। পল্টুদার মতো ও-ও কিন্তু টানা ছয় বার লিগটা আনল আমাগো তাঁবুতে। ক্যাবল তফাত এই যে, দাদা ছয় বারের লিগটা আনার বছরে একটা পাঁচ গোলের ইতিহাসও রাখসিল। আর ভাই, চার গোলেই থাইম্মা গেল। (এ বার চোখ আধশোয়া বিকাশ জাইরুর দিকে) তর নাম বিকাশ না? কাল ওই বলটা আরও একটু জোরে মারতে পারলি না! তা হলেই কিন্তু পাঁচ গোল হইয়া যাইত। দাদা-ভাই ম্যাচটাও ড্র হইয়া যাইত। হা-হা-হা...।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE