Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

এ কী ফুটবল! জয়েও অসুখী জার্মানি

গভীর রাত তখন। প্যারিস টাইমে প্রায় ১টা। দূরের গির্জার অস্পষ্ট ঘণ্টাধ্বনি কানে আসে। গম্ভীর ‘গং’ মনে করিয়ে দেয়, রাত অনেক হল। চলো বন্ধু, ফেরো নিজ নিকেতনে। কিন্তু ফিরব বললেই ফেরা যায়? কথা শোনে না অবাধ্য মন। যখন সে দেখে, চলে আসতে হবে বিশাল আইফেল টাওয়ার ফ্যান পার্কের মধ্যরাত-নাটক ফেলে!

দীর্ঘ পেনাল্টি যুদ্ধের শেষে দুই গোলরক্ষক। জার্মানির ন্যয়ারকে (বাঁ দিকে) শুভেচ্ছা ইতালির বুফনের। ছবি: এএফপি

দীর্ঘ পেনাল্টি যুদ্ধের শেষে দুই গোলরক্ষক। জার্মানির ন্যয়ারকে (বাঁ দিকে) শুভেচ্ছা ইতালির বুফনের। ছবি: এএফপি

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
প্যারিস শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৬ ০৩:৪৫
Share: Save:

গভীর রাত তখন। প্যারিস টাইমে প্রায় ১টা। দূরের গির্জার অস্পষ্ট ঘণ্টাধ্বনি কানে আসে। গম্ভীর ‘গং’ মনে করিয়ে দেয়, রাত অনেক হল। চলো বন্ধু, ফেরো নিজ নিকেতনে।

কিন্তু ফিরব বললেই ফেরা যায়? কথা শোনে না অবাধ্য মন। যখন সে দেখে, চলে আসতে হবে বিশাল আইফেল টাওয়ার ফ্যান পার্কের মধ্যরাত-নাটক ফেলে! ওই যে টাকমাথার খর্বকায় জার্মান, উনি কী বলছেন? রণসাজে সজ্জিত লাল-কালো-হলুদ জনতা তাঁকে ঘিরে বসে। মাঝে-মাঝে মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুড়ে দুর্বোধ্য কিছু বলছেন খর্বকায়। শুনে হিংস্র নাদব্রহ্মে প্রত্যুত্তর উঠছে, ‘‘ডয়েশল্যান্ড! ডয়েশল্যান্ড!’’

আড়াই ঘণ্টার অসহ্য টেনশন শেষে উচ্ছল আনন্দের স্যেন নদী বইছে, বোঝা যায়। কিন্তু ভদ্রলোক আদতে করছেন কী?

জার্মানরা এমনিতে বেশ দিলখোলা, আমুদে। এঁদের অনেকেই যেমন প্রথম বিশ্ব-তৃতীয় বিশ্বের অলিখিত দূরত্বে বিশ্বাস রাখেন না, তেমনই ইংরেজদের সঙ্গে ঐতিহাসিক বিরোধ থাকলেও ইংরেজি শুনে নাক সিঁটকোন না। বরং কাঁধে হাত রেখে নিজেদের ভাবাবেগ অনুবাদ করে দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পাশে দাঁড়ানো অতিকায় এক জার্মান সে ভাবেই বুঝিয়ে দিলেন— ভিড় পরিবৃত ওই ‘ব্যান্ডমাস্টার’ আসলে বলছেন, ‘‘দেখো ফাইনালটা জিতে গেলাম। আজ থেকে আমরা শাপমুক্ত! এত দিন আমাদের ‘ভাই’ (পড়তে হবে ইতালি) পরপর জিতেছে। আজ থেকে ইতিহাসের চাকাটা আমরা কেমন উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দিলাম।’’

ভাই, ইতালি, শাপমুক্তি— অনর্গল শব্দপ্রপাত ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে ফেলবে চুয়ান্ন বছর আগে। চিলি বিশ্বকাপ! সেখান থেকেই তো ইতালির কাছে বড় মঞ্চে জার্মানদের অভিশাপের শুরু। নতুন শতাব্দীতে পদার্পণ করেছে বিশ্ব, কিন্তু জার্মান-ভাগ্যচক্র একটুও পাল্টায়নি। আট বারের আট বারই তারা ফিরে গিয়েছে ভগ্নহৃদয়ে। কপালে জুটেছে হয় ড্র, নইলে হার। এক জার্মান কাগজ এ দিন দেখা গেল, কভার পেজটাই করেছে জাতীয় পতাকার রঙে দৈত্যাকৃতি তিন শব্দ দিয়ে। বাংলা তর্জমা করলে হয়— ‘হ্যাঁ.. হ্যাঁ.. হ্যাঁ!’ নীচে লিখেছে, ‘অশেষ ধন্যবাদ তোমাদের। দেশ চিরকৃতজ্ঞ থাকবে তোমাদের কাছে।’ ম্যানুয়েল আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেল, হেক্টরের পা কাটাল এত দিনের অভিশাপ।

কোনও সন্দেহ নেই, সাডেন ডেথের শেষ শটটা মেরে জোনাস হেক্টরও শনিবার রাত থেকে তাঁর দেশে ট্রয়ের হেক্টরের মতোই সম্মাননীয় চরিত্র হয়ে গেলেন। কিন্তু জার্মান জাত্যভিমান? শাপমুক্তির সঙ্গে সেটাও জিতল তো? জোয়াকিম লো-র টিম ইতিহাস সৃষ্টি করেও পেল তো সমগ্র জার্মান সমর্থকের অকুণ্ঠ পুষ্পবৃষ্টি?

নাহ্।

যে কোনও দেশের ফুটবল-সমর্থনের দু’টো ভাগ হয়। একটা দল আসে স্রেফ ফুর্তির টানে। টিম হারলে কাঁদে, চলে অভিসম্পাত বর্ষণ। আবার জিতলে পাগল হয়ে যায়। উন্মত্ততা থামাতে নিরাপত্তারক্ষীকে ছুটতে হয় লাঠি নিয়ে। দ্বিতীয় দলটা আসে ভাল ফুটবলের লোভে। বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণে যারা টিম পারফরম্যান্সের কাঁটাছেড়া করে। ফলাফলের ঊর্ধ্বে উঠে বিচার করতে বসে, তার টিম সত্যিই জিতল কি না। এদের কাছে জয়-পরাজয়ের অঙ্কের চেয়ে অনেক বেশি লোভনীয়, টিমের ঐতিহ্য রক্ষা। সম্মান।

সমর্থনের এই প্রজাতির কাছেই শনিবার হেরে গেলেন জোয়াকিম লো।

বার্লিন থেকে আসা বছর তিরিশের জোয়াকিম হাইনেরি ফ্যান জোনে একাকী হাঁটতে-হাঁটতে বলছিলেন, “জার্মানি আজ সামান্য ভাল খেলেছে। কিন্তু যে জার্মানিকে আজন্ম দেখে এসেছি, এরা তারা নয়।” তাঁর বিশ্লেষণ ধরলে, জার্মান ফুটবলের সৌন্দর্যটাই ইউরো কোয়ার্টার ফাইনালে দেখা যায়নি। জার্মান ফুটবল মানে গতি, নিখুঁত পাসিং আর মুহুর্মুহু আক্রমণে প্রতিপক্ষকে ছিঁড়ে ফেলা। বোর্দোয় কোথায় ছিল সে জার্মানি? হৃদয় মুচড়ে হাইনেরি বলছেন, “জিতেছে ঠিকই, কিন্তু আমার কাছে এরা ইউরো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যোগ্য নয়!” মিশায়েল নামের আর এক যুবককেও পাওয়া গেল, যিনি লো-র ফুটবল-নীতির উপর চরম অভিমানী। জার্মান কোচ নিজেদের ছক ছেড়ে ইতালিরই ৩-৫-২ ধার করলেন দেখে চরম অপমানিত লাগছে তাঁর। বলছিলেন, “জার্মানি কেন ইতালি হবে? আমাদের ঐতিহ্য বলে, মাঠে নেমে বিপক্ষকে কাঁপিয়ে দাও। কোথায় সেটা করল লো-র টিম?”

এঁদের কথা ধরলে, আসল গণ্ডগোলটা করছেন টমাস মুলার। মারিও গটজেকে বসিয়ে গোমেজকে খেলানোর সিদ্ধান্ত একদম ঠিক। গোমেজ ফাইনাল পাস দারুণ দেন। কিন্তু মুলার এত নিষ্ক্রিয় থাকায় ঝাঁঝটাই চলে যাচ্ছে। ব্রাজিল বিশ্বকাপে দুর্ধর্ষ খেলা মুলারের অবস্থা এখন এতই খারাপ যে, পেনাল্টি নিচ্ছেন গড়ানো শটে!

এক মার্কিন কাগজও আজ একই কথা লিখেছে— অতিরিক্ত ট্যাকটিকাল ফুটবলে দু’টো টিম ঢুকে পড়ায় জার্মানি-ইতালি ‘ফাইনালের’ মাধুর্যটাই নষ্ট হয়ে গেল। কালান্তক চাপের মেঘ এমনই ঘোরাফেরা করল যে, টাইব্রেকার এবং সাডেন ডেথ মিলিয়ে আঠারোটা পেনাল্টির সাত-সাতটা নষ্ট হল! নক আউট-যুদ্ধে একটা টিমকে শেষ পর্যন্ত জিততে হতো, জার্মানি সেটা জিতেছে। কিন্তু তার চেয়ে বেশি গৌরব জার্মান-জয়ে খুঁজতে যাওয়া বোকামি হবে।

এবং চাপ যে কতটা ছিল, মর্যাদার যুদ্ধের দাবিদাওয়ায় যে মিশে ছিল কতটা নিষ্ঠুরতা, ম্যাচের পর কোচ-ফুটবলারদের প্রতিক্রিয়ায় তা প্রমাণিত। ম্যানুয়েল ন্যয়ার বলে ফেলেছেন, “নার্ভের ওপর যে কী প্রেশার পড়েছিল, বোঝানো সম্ভব নয়।” জোয়াকিম লো-র টাইব্রেকারের সময় নিঃশ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছিল। বলেছেন, “উফ্, এত নাটক হবে ভাবিনি। নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে।”

ও দিকে, ইতালি। বীরের মর্যাদা পেয়েও তারা কাঁদছে, দৈত্যের মতো লড়েও শিশুর আশ্রয় খুঁজছে। চোখের জল চাপতে-চাপতে আন্তোনিও কন্তে বলে ফেলেছেন, “আমি চলে যাচ্ছি। শুধু ফুটবল ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ছাড়া কেউ পাশে দাঁড়ায়নি আমার। নিজের লড়াই একা লড়ছি। যা-ই হোক, কিছু ওয়ার-মেশিন রেখে গেলাম। যারা গোটা দুনিয়াকে ভয় পাওয়াবে। আশা করব, ওদের আপনারা সমর্থন করবেন।” চোখের জল মুছতে মুছতে জিজি বুফন বলে গেলেন, এত ভয়াবহ রাত তাঁর জীবনে আসেনি— “শকিং, শকিং। আমরা জেতার এত কাছে চলে গিয়েছিলাম!” বারজাগলির সাক্ষাৎকারও অর্ধসমাপ্ত থেকে যায় কান্নায়। ফোঁপানির ফাঁকে কিছু টুকরো বিলাপ বেরিয়ে আসে, “প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে...আমরা চেয়েছিলাম টুর্নামেন্টে আরও থাকতে..।”

যন্ত্রণা, ফোঁপানি, বিলাপ, অবিশ্বাস, দীর্ঘশ্বাস, দম আটকে আসা— এগুলোই ইউরো কোয়ার্টার ফাইনালের যথাযোগ্য প্রতিশব্দ হওয়া উচিত। ভাবা যায়, সোয়াইনস্টাইগার-ওজিল-মুলার-বোনুচ্চির মতো কিক-টেকাররা পেনাল্টি মিস করছেন! এত উথাল-পাথাল সাডেন ডেথও বা শেষ কবে দেখেছে বিশ্ব? শেষ কবে এমন মহানাটকীয় পেনাল্টি নষ্টের প্রদর্শনী সভা খুলে বসেছে দুই বিশ্বজয়ী? হেক্টর যখন পেনাল্টিটা নিতে যাচ্ছেন, ফ্যান পার্কের কিছু ইতালীয় যুবতীকে দেখলাম, নির্নিমেষ বুফনের দিকে তাকিয়ে। ন্যয়ার তখন দাঁড়িয়ে গোলের দিকে পিছন ফিরে। নিষ্পলক দৃষ্টি নিবদ্ধ গ্যালারিতে। দেখতে চান না, ক্রসবারের নীচে কী হচ্ছে না হচ্ছে!

হেক্টর পেনাল্টিটা নিলেন বাঁ দিক ঘেঁষে, বুফনও ঝাঁপালেনও বাঁ দিকে। ইতালি কিপারের হাতের নীচ ছুঁয়ে গেল না একটু?

স্পষ্ট হল না, একটা সমুদ্রোচ্ছ্বাস শোনা গেল শুধু।

ইট্স জার্মানি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE