Advertisement
০৪ মে ২০২৪

‘কোহালিকে দেখে আমিও লড়ার অনুপ্রেরণা পাই’

গুয়াহাটি। বুধবার সকাল আটটা। ন্যাশনাল হাইওয়ে নম্বর ৪০। দুধসাদা ইনোভার গন্তব্য আড়াই ঘণ্টা দূরের শিলং। গাড়ির সামনের সিটে মাত্র ন’দিনের ব্র্যান্ড নিউ ক্রিকেট বোর্ড প্রেসিডেন্ট। তিনি অনুরাগ ঠাকুর এমন সময় দায়িত্ব নিয়েছেন যা শিলংয়ে ওঠার পাহাড়ি রাস্তার চেয়ে ঢের বেশি বিপজ্জনক। নতুন বোর্ড প্রধান এবিপি-র কাছে এমন অনেক স্পর্শকাতর বিষয়ে মুখ খুললেন যা আগের কোনও সাক্ষাৎকারে করেননি। আজ প্রথম পর্ব।গুয়াহাটি। বুধবার সকাল আটটা। ন্যাশনাল হাইওয়ে নম্বর ৪০। দুধসাদা ইনোভার গন্তব্য আড়াই ঘণ্টা দূরের শিলং। গাড়ির সামনের সিটে মাত্র ন’দিনের ব্র্যান্ড নিউ ক্রিকেট বোর্ড প্রেসিডেন্ট। তিনি অনুরাগ ঠাকুর এমন সময় দায়িত্ব নিয়েছেন যা শিলংয়ে ওঠার পাহাড়ি রাস্তার চেয়ে ঢের বেশি বিপজ্জনক। নতুন বোর্ড প্রধান এবিপি-র কাছে এমন অনেক স্পর্শকাতর বিষয়ে মুখ খুললেন যা আগের কোনও সাক্ষাৎকারে করেননি। আজ প্রথম পর্ব।

গৌতম ভট্টাচার্য
শিলং শেষ আপডেট: ০৩ জুন ২০১৬ ০৩:৩২
Share: Save:

প্রশ্ন: আপনাকে একটু পিছিয়ে নিয়ে যাই। ১৯৯৪ পঞ্জাব।

অনুরাগ: হুঁ।

প্র: পঞ্জাবের হয়ে একটি ছেলে তখন জুনিয়র পর্যায়ে প্রচণ্ড রান করছিল। অপ্রত্যাশিত ভাবে সে-ই হঠাৎ করে পঞ্জাবের মূল টিম থেকে বাদ হয়ে যায়। ছেলেটির কাছে অবিশ্বাস্য লেগেছিল সেই বাদ যাওয়া। তা হলে আর কী করতে হবে টিমে ঢোকার জন্য? সেই তরুণকে বাদ দিয়েছিলেন মুখ্য নির্বাচক এমপি পাণ্ডব। বাইশ বছর পর সেই পাণ্ডবই একই ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করেন। ওটা বাদ দেওয়ার হাত ছিল, এটা বোর্ড প্রেসিডেন্ট হওয়ার।

অনুরাগ: (প্রথমে জানলার দিকে বাইরে তাকিয়ে যেন শোনেননি। কিছু পরে জবাব) ওহ, ঘটনাটা জানেন (হাসি)। পাণ্ডবজি তখন ন্যাশনাল সিলেক্টর ছিলেন, আবার পঞ্জাব ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের জয়েন্ট সেক্রেটারি। আমি সেই সময় জুনিয়র লেভেলে নর্থ জোন টিমের বেশ কয়েক বছর ক্যাপ্টেন্সিও করেছি।

প্র: কেমন লেগেছিল বাইশে মে-র দুপুরে। অস্ফুটে বলেছিলেন যে, তুমিই বন্ধু বাদ দিয়েছিলে, তুমিই কিনা ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পদের জন্য আমার নাম প্রস্তাব করলে?

অনুরাগ: না না, তখনকার মতো খারাপ লেগেছিল। পরে বুঝেছিলাম নিশ্চয়ই আমার আরও বড় রান করার দরকার ছিল। একটা সময়ের পর আমি বুঝতে পারি সিলেক্টররা ৯৬-কে গুরুত্ব দেয় না। ৭৮ তো তাদের কাছে কোনও রানই নয়। তারা বোঝে শুধু সেঞ্চুরির ভাষা। হতেই পারে সেই অনুযায়ী আমার হয়তো আরও রান করা উচিত ছিল।

প্র: এই তো আপনি সতর্ক বোর্ড কর্তা হয়ে গেলেন।

অনুরাগ: না না, সত্যি বলছি। নিজের যন্ত্রণার জন্য নির্বাচককে দায়ী করার চেয়ে এটাই কি ভাল নয় যে, আপনি বুঝতে পারছেন আরও চাওয়া হচ্ছে। ভাল তো, আপনি নিজেকে ইমপ্রুভ করার চেষ্টা করতে পারেন। তা ছাড়া পাণ্ডবজি বিসিসিআই-তে একজন সিনিয়র মানুষ। আমার পদ আজ যা-ই হোক, দিনের শেষে উনি আমার সহকর্মী। একটা সংস্থা চালাতে গেলে সবাইকে নিয়ে চলতে হয়। সবার সঙ্গে আপনার অভিমত না-ই বা মিলতে পারে। তা বলে তাকেও আপনাকে ক্যারি করতে হবে।

প্র: আমার প্রশ্নটা কিন্তু কোনও বোর্ড অফিসিয়ালকে ছিল না, সেই তরুণকে করা হয়েছিল যে সেই সময় রক্তাক্ত আর মূর্ছিত ছিল। কী বলছেন অনুরাগ, ক্রিকেটার কখনও রক্তের দাগ ভুলতে পারে?

অনুরাগ: বললাম তো, আমি তখনকার অনূর্ধ্ব-১৯ নর্থ জোন ক্যাপ্টেন নিজের জীবন দিয়ে এটাই শিখেছিলাম যে সেঞ্চুরির এক রানও কম করলে সেটা হাফসেঞ্চুরি হিসেবে গণ্য হয়। অতএব জীবনে সেঞ্চুরি ছাড়া কোনও স্টেশন রেখো না। আমি নিজের ভুল থেকে শিখেছি সেটাই তো ভাল।

প্র: আপনি ব্যাটসম্যান?

অনুরাগ: ইয়েস, মিডল অর্ডার ব্যাট ছিলাম। লক্ষ্মণের সঙ্গে আমি অনেক খেলেছি। আমরা প্রায় সমসাময়িক।

প্র: কোথাও মনে হয় আপনার চিন্তনের মধ্যে আজও সেই ক্রিকেটারটা বেঁচে রয়েছে। নইলে কতগুলো পুরনো প্লেয়ার আজ হাসিমুখে ক্রিকেট খেলত না।

অনুরাগ: যেমন?

প্র: যেমন আশিস নেহরা। যেমন যুবরাজ সিংহ। যেমন হরভজন সিংহ। শ্রীনিবাসন গ্রুপ দেড় বছর আগের নির্বাচনে জিতে গেলে এরা প্রত্যেকে হয়তো একদিনে রিটায়ারমেন্ট ঘোষণা করতেন।

অনুরাগ: আমি কী করলাম?

প্র: আপনি খুব ভাল করে জানেন আমি কী বলছি। এই নেহরা-যুবরাজদের জন্য আপনি ফরমাইশ না করলে ওদের ফেরানো হত না। ধোনি এঁদের চাননি।

অনুরাগ: আরে ভাই সিলেক্টররা যা করার করেছেন। ইন্ডিয়ান টিম তো ওঁরা বাছেন, আমি নই। হ্যাঁ আমি এতে খুব সন্তুষ্ট যে ওঁরা কিছু ভাল প্লেয়ারকে কামব্যাক করিয়েছেন। একটা ক্রিকেট টিম তখনই সত্যিকারের ভাল যেখানে সিনিয়র-জুনিয়র ভাল মিক্সিং থাকে। নেহরা যদি আইপিএলে দুর্দান্তই হয় তা হলে বাবা আমি ওকে দেশের হয়ে টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ খেলাব না কেন? ওঁরা নিশ্চয়ই সেটাই ভেবেছেন।

সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন।

প্র: আগে সেটা ভাবলে তো দু’বছর আগেই ওঁদের কামব্যাক করাতেন। আপনার গুঁতোর জন্য ব্যাপারটা অপেক্ষা করত না।

অনুরাগ: মনে হয় ওঁরা তার আগে অন্য তরুণদের চান্স দিয়ে দেখছিলেন। সিলেক্টরকে তো সব অ্যাঙ্গলে দেখতে হয়।

প্র: সেই সময় তামিলনাড়ু সর্বাত্মক কন্ট্রোল করছিল ইন্ডিয়ান ক্রিকেট। আপনি চেন্নাই লবির কৃপাদৃষ্টিতে না থাকা মানে আপনি গেলেন। সেই ব্যালান্সটা বদলাল আপনি আর মিস্টার ডালমিয়া ক্ষমতায় আসার পর। মানবেন তো?

অনুরাগ: আমি গত ষোলো বছর ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছি। আমার মনে হয় কন্ট্রোল শব্দটা ব্যবহার করা ঠিক হল না।

প্র: কন্ট্রোলই তো, একটা লোক তো তাই করত!

অনুরাগ: করলে কত দিন করবেন? ক্রিকেট বোর্ডে পার্মানেন্ট কিছু নেই। ডালমিয়া-বিন্দ্রা জুড়ি তো এক সময় সর্বেসর্বা ছিলেন। তার পর ওঁদেরও ছেড়ে দিতে হয়েছে। একটা সময়ের পর তুমি যে-ই হও না কেন ছেড়ে দিতে হবে। আমি যেমন। আমার মেয়াদ মাত্র ১৭ মাস। আমার আগে যারা ছিল তারা কেউ টেস্ট ম্যাচ খেলেছে, কেউ পুরো পঞ্চাশ ওভার ব্যাট করেছে। আমার সেই সুযোগ নেই। আমি পাচ্ছি মাত্র কুড়ি ওভার— পরিষ্কার টি-টোয়েন্টি। সে ভাবেই খেলব।

প্র: মানে স্কুপ শট, রিভার্স সুইপ, ফলিং সুইপ?

অনুরাগ: আমি স্ট্রেট ব্যাটেই রানটা তুলতে চাই।

প্র: জগমোহন ডালমিয়া জমানার পরে আপনি বোধহয় একমাত্র প্রেসিডেন্ট যিনি প্লেয়ারদের স্বার্থরক্ষাকে সবার আগে রাখেন। তাদের কর্মচারী হিসেবে ভাবায় না।

অনুরাগ: সেটা হবে কেন? মানুষকে তো বুঝতে হবে যুগ বদলে গিয়েছে। তিরিশ বছর আগে আর পরে এক নয়। একটা উদাহরণ দিই। তিরিশ বছর আগে অভিভাবকেরা মারধর করতেন বাচ্চা কথা না শুনলে। এখন সেই বাচ্চাদেরই বন্ধুর মতো বোঝাতে হয়। গায়ে হাত না তুলে ওদের হাত ধরতে হয়। আমি যখন জয়েন্ট সেক্রেটারি হই সেই সময় থেকেই কখনও ভাবিনি যে আমরা হলাম বস আর ওরা কর্মচারী। আরে দেশের হয়ে যুদ্ধ করে সম্মানটা তো ওরা আনে। আমরা তা হলে ওদের ওপরে হলাম কী করে?

প্র: মিডল অর্ডার ব্যাট করতে যাওয়ার আগে উইকেট কেমন বোঝার যথেষ্ট সুযোগ পায়। সেই অনুযায়ী নিজের ছাঁচটা করে। আপনিও যে এত প্লেয়ার দরদি সেটা কি আরও বেশি করে এইজন্য যে আপনার পূর্বতনরা দু’পক্ষের সম্পর্ককে তলানিতে নামিয়ে এনেছিলেন?

অনুরাগ: আমি আজ থেকে নয়, আমার পঁচিশ বছর বয়সে যখন বোর্ডে ঢুকেছি সেই সময় থেকেই প্লেয়ার অনুরাগী। এরা তো অনেকে আমার সঙ্গে খেলেছে। আর কীসের পদ নিয়ে মদমত্ততা? আমি রাজনীতিতে আছি বলে ভাগ্যক্রমে আরও ভাল জানি যে আজ আপনি পাওয়ারে তো কাল অপজিশনে। সব সময় আপনাকে মাটির কাছাকাছি থাকতে হবে কোনও রকম বসগিরি না করে। এই জন্যই তো সৌরভ-সচিন আর ভিভিএস-কে কমিটিতে আনতে পেরেছিলাম। দ্রাবিড়কে অবধি কোচ হতে রাজি করাতে পেরেছিলাম। জাস্ট ব্যক্তিগত সম্পর্কের খাতিরে।

প্র: একটা সোজা প্রশ্ন করছি। বোর্ড প্রেসিডেন্ট হয়ে জবাব দেবেন না।

অনুরাগ: কী প্রশ্ন?

প্র: সহবাগের জন্য আপনার খারাপ লাগে না? ওঁকে রিটায়ার করতে হয় না আর এক বছর আগে আপনারা ক্ষমতায় এলে।

অনুরাগ: নট রিয়েলি। আপনাকে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, দেশের হয়ে খেলার জন্য কোটি কোটি প্রতিযোগী প্রতীক্ষায় থাকে। হ্যাঁ প্লেয়াররা টিমের বাইরে বেরিয়ে গেলে সমস্যা হয়, তখন নির্বাচকদের কথা বলা উচিত কারা কারা কামব্যাক করতে চায় এবং সে আইডিয়াটা আদৌ বাস্তবোচিত
কি না।

প্র: কিন্তু সহবাগের সঙ্গে তো কেউ কথাই বলেনি?

অনুরাগ: হয়তো বলেছে, আমরা কী করে জানছি?

প্র: আবার আপনি সেই মাঝে মাঝে অসম্ভব সতর্ক বোর্ড কর্তা হয়ে যাচ্ছেন। অথচ এক ঝলকে পিছন ফিরে যে তরুণকে দেখতে পাচ্ছি সে তাজ বেঙ্গলের লবির এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা একটা সন্ত্রস্ত মুখ। যে সভায় ঢুকতে পারবে কি না জানত না। আর আজ পনেরো বছরে সে-ই কিনা ক্রিকেট বোর্ড প্রেসিডেন্ট। নিজের অবাক লাগছে না?

অনুরাগ: ষোলো বছর তো অনেকটা সময়। অনেকে আছে যারা আমার চেয়ে কম সময় বোর্ডে কাটিয়ে মগডালে উঠেছে। বাট আমি সেটা চাইনি। আমার মনে হয়েছে তাড়াহুড়ো করে দশ ওভারে সেঞ্চুরি করার দরকার নেই। তার চেয়ে উইকেটে থেকো, খেলাটা শেখো।

প্র: মহেন্দ্র সিংহ ধোনি ছোট শহর থেকে উঠে আসা অধিনায়ক। আবার বোর্ডের প্রধানও তাই। কী আছে ছোট শহরের ছেলেদের মধ্যে? বড় শহরকে হারানোর বাড়তি রোখ— যাকে আপনারা বলেন খুন্নাস?

অনুরাগ: ছোট শহরের ছেলেদের মাইন্ডসেট অন্য রকম হয়। তারা জানে শুরু থেকেই তাদের ওপর ভরসা করা হয় কম। ধরেই নেয় এ বড় সিটি-বয়দের কাছে হারবে। সেটা অবশ্য একটা সুবিধেও কারণ প্রথম থেকেই আপনার ওপর বিশেষ চাপ নেই। তার ক্যানভাস নিয়ে তাই ছোট শহরের ছেলেরা অনেক ইজি খেলতে পারে। অবশ্যই তার মধ্যে অদম্য জেদ থাকা চাই।

প্র: একটু আগে আপনি বলছিলেন এই সতেরো মাসে স্ট্রেট ব্যাটে টি-টোয়েন্টি খেলবেন। মডেল কি বিরাট?

অনুরাগ: কোনও সন্দেহ নেই বিরাট খুব ইন্সপায়ারিং ক্যারেক্টর। ওকে দেখে আমিও উজ্জীবিত হই।

প্র: আপনি হয়তো ভারতীয় বোর্ডের বিরাশি বছরের ইতিহাসে প্রথম বোর্ড প্রেসিডেন্ট যে খোলাখুলি বলল তার ‘অধীনস্থ’ কোনও ক্রিকেটারকে দেখে সে অনুপ্রাণিত হয়।

অনুরাগ: বিরাট তো অনুপ্রাণিত করার মতোই চরিত্র। যে কোনও বয়সির রোলমডেল হতে পারে। যে ভাবে ও উদোম পরিশ্রম করে। বেছে বেছে খায়। যে স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে ও ট্রেন করে তা সত্যিই তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। ফাটা হাত নিয়ে অন্যরা হলে বসে থাকত। বিরাট কী করল? না ম্যাচই শুধু খেলল না, জিমে আরও বেশি সময় দিল। একটা ম্যাচে কী পরিমাণ ছোটাছুটি যে ও করে ভাবাই যায় না। শর্ট থার্ড থেকে কখনও দৌড়চ্ছে লং অন। যে ভাবে অন্যদের জন্য ও স্ট্যান্ডার্ড সেট করে সেটা একস্ট্রাঅর্ডিনারি।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anurag thakur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE