Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মালির হাতে টাকা গুঁজে ‘ওরা’ খদ্দের নিয়ে ঢুকে পড়ে শুনশান তাঁবুতে!

মোহনবাগান তাঁবুর কোথাও একটা ইট গাঁথা হচ্ছে খবর পেলেই ছুটে এসে তা বন্ধ করে দেন সেনারা। ময়দান অঞ্চলে কোথাও প্যান্ডেল বেঁধে কোনও অনুষ্ঠান করতে গেলেই লাগে সেনা এবং পুলিশের অনুমতি। ক্লাব-তাঁবুর সামনে স্পনসরের নাম লাগানো বোর্ড লাগালে তা খুলে ফেলে দেন সেনার লোকজন।

ছবি শঙ্কর নাগ দাস

ছবি শঙ্কর নাগ দাস

রতন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৭ ০৪:০১
Share: Save:

মোহনবাগান তাঁবুর কোথাও একটা ইট গাঁথা হচ্ছে খবর পেলেই ছুটে এসে তা বন্ধ করে দেন সেনারা।

ময়দান অঞ্চলে কোথাও প্যান্ডেল বেঁধে কোনও অনুষ্ঠান করতে গেলেই লাগে সেনা এবং পুলিশের অনুমতি।

ক্লাব-তাঁবুর সামনে স্পনসরের নাম লাগানো বোর্ড লাগালে তা খুলে ফেলে দেন সেনার লোকজন।

সেনা এবং পুলিশের গাড়ি ঘোরাফেরা করে নিয়মিত। আলাদা দফতর ও লোক-লস্কর আছে ময়দানের সব ঠিকঠাক আছে কি না সরেজমিন দেখভালের জন্য। পরিদর্শনও হয়। লালবাজার থেকে পাঠানো ফর্ম পূরণ হয় নিয়মমাফিক।

তা সত্ত্বেও সন্ধ্যা নামলেই ময়দানের কোথাও রমরমিয়ে বসছে জুয়া আর মদের আসর। কোথাও মালিদের হাতে টাকা গুঁজে নিয়ে দেহোপজীবিনীরা খদ্দের নিয়ে ঢুকে পড়ে শুনশান তাঁবুতে। কোনও কোনও ক্লাবের তাঁবু আবার বিভিন্ন প্রাক্তন নামী ক্রিকেটারের কোচিং সেন্টারকে বা নানা সংস্থাকে ভাড়া দেওয়া হয় মোটা টাকার বিনিময়ে। তাঁবু ব্যবহারের যে নিয়মবিধি আছে তাতে এ সব কাজই বেআইনি।

কারণ ময়দানে তাঁবু নেওয়ার সময় প্রধানত তিনটি বিষয়ে মুচলেকা দিতে হয় পুলিশ ও সেনাকে। এক) কোনও না কোনও ক্রীড়া সংস্থার নথিভুক্ত হতেই হবে। দুই) খেলাধুলোর বাইরে অন্য কিছু করা যাবে না। তিন) তাঁবু ভাড়া দেওয়া যাবে না।

তিনটের কোনওটাই মানা হচ্ছে না বলে লালবাজারে যে ক্লাবগুলির তাঁবু নিয়ে অভিযোগ জমা পড়েছে বলে খবর, তাদের মধ্যে রয়েছে বিড়লা ক্লাব, ইঞ্জিনিয়ার্স ক্লাব, আইসিআই, মার্টিন বার্ন, হিন্দুস্থান মিত্র ক্লাব, এয়ারলাইন্স ক্লাব, বয়েজ স্কাউট অ্যান্ড গাইড, আশুতোষ কলেজ, বঙ্গবাসী কলেজের মতো তাঁবুগুলো। যার অনেকগুলোই ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কর্তাদের অজান্তেই কিছু তাঁবুতে এ সব অপকীর্তি চলছে। মালি ও বাইরের কিছু লোকের যোগসাজসে। সেনা-পুলিশের একাংশও নাকি জড়িত!

বারবার খোঁজ করেও অর্ধেক তাঁবুর মালিই দিতে চাননি ওই সব ক্লাবের প্রেসিডেন্ট বা সচিবের মোবাইল ফোন নম্বর। বলে দিচ্ছেন, ‘‘আমার কাছে নম্বর নেই। সন্ধেবেলা আসুন।’’ আর সন্ধ্যায় গেলে দেখা মেলে অন্য মালির। তিনি আবার বলেন, ‘‘সচিববাবু তো আসেননি। কাল আসুন।’’ ক্লাব তাঁবুতে যাঁরা থাকেন তাঁদের কাছেও পাওয়া যায় না ক্লাব কোন লিগে খেলে তার তথ্য। গত কয়েক দিন সরেজমিন খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল অদ্ভুত সব দৃশ্য।

মোহনবাগান তাঁবুর পিছনের দিকে যে তাঁবু রয়েছে তাঁর সামনে শীত-সন্ধ্যায় জমাট অন্ধকার। বাবুঘাটের পাশের ওই জায়গায় যৌনকর্মীদের ভিড়। গা ছমছম করে ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে হাঁটতে গেলে। সেই পথেই খদ্দের নিয়ে যাচ্ছেন ওরা। দূরে দাঁড়িয়ে মনে হল, লক্ষ্য ওই তাঁবুই।

ময়দানের গাঁধী মূর্তির পাশের একটি টেন্টে সন্ধে সাতটায় মদ-জুয়ার আসর বসে গিয়েছে রমরমিয়ে। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে দু’টো পুলিশ জিপ। ওই তাঁবুতেই সকালে চলে একটি ক্রিকেট কোচিং সেন্টার। এক নামী ক্রিকেটার তাঁবু ভাড়া নিয়ে বহু দিন চালাচ্ছেন সেটা।

ময়দান মার্কেটের পাশের গলির একটি টেন্টে বা পার্ক স্ট্রিট সংলগ্ন একটি তাঁবুতে সন্ধ্যা নামতেই জুয়ার আসর বসেছে দরজা অর্ধেক বন্ধ করে। ইডেনের উল্টো দিকে মহমেডান মাঠের পাশে দু’টো টেন্টেও সন্ধ্যা থেকেই চলে নানা কুকর্ম। সেখানেও যৌনকর্মীদের আনাগোনা।

সবথেকে যেটা বিস্ময়ের, যে সব তাঁবুর বিরুদ্ধে বেআইনি কাজকর্মের অভিযোগ উঠেছে, তাদের বেশিরভাগই কোনও খেলার সঙ্গে যুক্ত নয়। অথচ মাত্র কুড়ি টাকা সরকারের ঘরে জমা দিয়ে ভোগ করছে তাঁবু। নিয়মকে তোয়াক্কা না করে কয়েকটি তাঁবুর আবার বেআইনি হাতবদলও হয়েছে গত কয়েক বছরে। মোটা টাকার বিনিময়ে।

বিড়লা, মার্টিন বার্ন বা আইসিআই-এর মতো অফিস ক্লাবগুলো এক সময় অফিস লিগ খেলত। এখন কোথাও তাদের খেলতে দেখা যায় না। অদ্ভুত এক নিয়মে তাদের তাঁবু কিন্তু রয়ে গিয়েছে ময়দানে। আবার ময়দানে এমন কিছু ক্লাব আছে যারা ফুটবল, ক্রিকেট বা হকি সংস্থায় নাম কা ওয়াস্তে নথিভুক্তি করে আইন বাঁচিয়ে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাঁবু ভোগ করার জন্য।

সব মিলিয়ে ময়দানে যে ৬৮ তাঁবু আছে তার প্রায় তিরিশ শতাংশ তাঁবু নিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। অন্যতম প্রধান কারণ পুলিশ এবং সেনার মধ্যে সংযোগের অভাব। ব্রিটিশ আমলের তৈরি নিয়ম। কারণ ময়দান কার দখলে, তা নিয়ে বহু দিন ধরে চলে আসছে লড়াই। সমাধান হয়নি। ওই দুই সরকারি দফতরের টানাপড়েনের সুযোগে বেআইনি কাজ ক্রমশ বাড়ছে ময়দানের বিভিন্ন তাঁবুতে বলে অভিযোগ। ময়দান ঘুরলে বা মালিদের সঙ্গে কথা বললেই পুলিশ এবং সেনা দু’পক্ষের বিরুদ্ধে শোনা যায় ঘুষ নেওয়ার অভিযোগও।

ময়দানের তাঁবু নিয়ে অবশ্য পুলিশ এবং সেনাদের কোনও এক অদ্ভুত কারণে গা ছাড়া ভাব। শহরের প্রাণকেন্দ্রের বিশাল এই অঞ্চলের কাজকর্ম নিয়েও তাদের মনোভাব দায়সারা গোছের। ময়দানের দায়িত্বে থাকা কলকাতা পুলিশের ডিসি (সাউথ) প্রবীণ ত্রিপাঠিকে বেশ কয়েক বার ফোন করা হলেও ‘মিটিংয়ে ব্যস্ত’ জানিয়ে ফোন ধরেননি। ময়দান থানার অফিসাররা যুক্তি দিচ্ছেন, ‘‘আমরা তাঁবুর ভিতরে অভিযোগ পেলে ঢুকি। না হলে বাইরে থেকে দেখে চলে আসি। প্রতিদিন সব তাঁবু ঘোরা সম্ভব নয়।’’ আর পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলের সেনা কর্তাদের দাবি, ‘‘অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেব। আমরা তো নিয়মিত সব তাঁবুতে যাই।’’

বারবার বিভিন্ন তাঁবু নিয়ে অভিযোগ জমা পড়লেও কেন উদাসীন থাকেন পুলিশ বা সেনারা? সে জন্য ফেলুদা-কে ডাকা যেতে পারে। একজন মালি বললেন, ‘‘টাকা দিলেই সব ম্যানেজ হয়ে যায়। ময়দানে চা-চানাচুর, মুড়িওয়ালাদের কাছ থেকেও টাকা নেয় ওরা। না দিলে মারধোর করে।’’

ময়দানে বহু নামী ক্লাবেরই নিজস্ব মাঠ বা তাঁবু নেই। অন্যের তাঁবু ভাড়া নিয়ে তারা ফুটবল, ক্রিকেট বা হকি লিগ খেলে। টালিগঞ্জ অগ্রগামী বা ইউনাইটেড স্পোর্টস ক্লাবের যখন রমরমা ছিল তখন তারা অনেক চেয়েও তাঁবু পায়নি ময়দানে। ব্রিটিশ আমলের নিয়ম তাদের থামিয়ে দিয়েছে।

পাবেনই বা কী করে? সরষের মধ্যেই যে ভূত!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Illegal works Kolkata Maidan club tents
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE