Advertisement
০৬ মে ২০২৪
হুঙ্কারে শুরু হতাশায় শেষ

রাজধানী দেখল আলেকজান্ডার বনাম পুরু

তা হলে বোঝা গেল, দিল্লির রোদের মধ্যে খেলতে না হলে রাফায়েল নাদাল গতকালই সিঙ্গলসে নামতেন। ও সব ‘ডেলি বেলি’ বা কব্জি-টব্জি কিছুই নয়!

প্রথম সেটে লি-রা তখন ছুটছেন। কনচিতার ছোঁয়ায় খানিক ঠান্ডা হয়ে পাল্টা মার নাদালের।

প্রথম সেটে লি-রা তখন ছুটছেন। কনচিতার ছোঁয়ায় খানিক ঠান্ডা হয়ে পাল্টা মার নাদালের।

সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:১২
Share: Save:

তা হলে বোঝা গেল, দিল্লির রোদের মধ্যে খেলতে না হলে রাফায়েল নাদাল গতকালই সিঙ্গলসে নামতেন। ও সব ‘ডেলি বেলি’ বা কব্জি-টব্জি কিছুই নয়!

সকাল দশটা নাগাদ টিম হোটেলের ব্রেকফাস্ট লাউঞ্জে দেখা আনন্দ অমৃতরাজের সঙ্গে। ভারতীয় দলের নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেন বললেন, ‘‘ওদের ক্যাম্পের লোকজনের থেকে তো শুনছি রাফা আজ ডাবলসে নামবে। আমাদের বিকেলে অলিম্পিক্স চ্যাম্পিয়ন জুটির সঙ্গে খেলতে হবে ধরে নিয়ে এখন থেকে এগোচ্ছি।’’

হঠাৎ মনে পড়ে গেল, দু’দিন আগে এই টাইয়ের ড্র-এর পরে স্পেনের নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেন কনচিতা মার্টিনেজের কথাটা। ‘‘নাদাল দ্বিতীয় সিঙ্গলসটা খেলার সুযোগ পেলে ভাল হত।’’ তখন অন্তর্নিহিত অর্থটা বোঝা যায়নি। শনিবারের পর পরিষ্কার— প্রথম দিনও আজকের মতো সন্ধে সাতটার মনোরম নৈশালোকের খন্না স্টেডিয়ামে নামতে হলে নাদাল সিঙ্গলসও খেলতেন। কিন্তু স্প্যানিশ টেনিস মহাতারকা দিল্লির বিকেল পাঁচটার রোদেও খেলবেন না।

শনিবার রাতে এও বোঝা গেল, গোলিয়াথকে হারানো ডেভিডের পক্ষে অসম্ভব ঠিকই, তবে হৃদয় দিয়ে লড়লে অন্তত সেই হার লজ্জার হয় না। বরং বীরোচিত পরাজয় হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকে।

ভারত এই নিয়ে টানা তিন বার প্লে-অফ থেকে ছিটকে গেল। আর তিন বারই প্লে-অফের লটারিতে বাঘা বাঘা টেনিস দেশের মুখে পড়েছে। সর্বিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, এ বার তো একেবারে স্পেন। যে দেশের টেনিস ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট আজ স্টেডিয়ামের কর্পোরেট হসপিটালিটি বক্সে বসে ডাবলস শুরুর আগে বলছিলেন, ‘‘স্পেন এখন গোটা টেনিস বিশ্বের অর্ধেক। ছেলে-মেয়েদের বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়ে প্রথম পঞ্চাশে আমাদের দেশের প্লেয়ার সবচেয়ে বেশি। সারা পৃথিবীতে যত টেনিস অ্যাকাডেমি আছে, তার তিরিশ শতাংশ স্পেনে।’’

সেই দেশের কিংবদন্তি নাদাল আর তাঁর অলিম্পিক্স ডাবলস সোনাজয়ী পার্টনার লোপেজের কাছে ৬-৪, ৬-৭ (২-৭), ৪-৬, ৪-৬ হারাটা লিয়েন্ডার-সাকেতের জন্য মোটেও অগৌরবের নয়।

বরং কী আশ্চর্য, গত তিন বারই টাই-এর একটা না একটা সময় ভারতকে দেখে মনে হবে, লিয়েন্ডাররা ওয়ার্ল্ড গ্রুপের দরজা খুলে ফেলতে পারতেন!

বেঙ্গালুরুতে দু’বছর আগে ভারত প্রথম দিন ০-২ পিছিয়ে পড়েও শেষ দিন প্রথম সিঙ্গলসের পর টাই-এর স্কোর ছিল ২-২। লিয়েন্ডার-বোপান্না ডাবলস আর সোমদেব প্রথম রিভার্স সিঙ্গলসটা জিতে চাকা প্রায় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই সময় অনভিজ্ঞ তরুণ য়ুকি ভামব্রি মীমাংসাসূচক শেষ রাবারের চাপ নিতে না পেরে শেষ সিঙ্গলসে যাচ্ছেতাই হেরে বসেন।

ম্যাচ শেষে শত্রুকে লি-র অভিনন্দন। নয়াদিল্লিতে শনিবার।

গত বছর এই দিল্লিতেই চেকদের বিরুদ্ধে প্রথম দিন দু’টো সিঙ্গলসের পর স্কোর সম্মানজনক ১-১ রেখেছিল ভারত। কিন্তু ডাবলসে ফেভারিট হয়েও লিয়েন্ডার-বোপান্না সম্ভবত তাঁদের জুটির জঘন্যতম ম্যাচ খেলেন। তার পর ভারত আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি।

এ বার গতকাল নাদালের সিঙ্গলসে অনুপস্থিতির সুযোগ পেয়েছিলেন রামকুমার। পরিবর্ত ফেলিসিয়ানোর সঙ্গে টেনিসের স্কিলে না পারুন, হৃদয় দিয়ে লড়েছিলেন। একটা সেটও কেড়ে নিয়েছিলেন। চতুর্থ সেটের প্রথম গেমেই ব্রেক হয়ে না বসলে কে বলতে পারে রামকুমার ম্যাচ পঞ্চম সেটে নিয়ে যেতেন না? বা, শেষমেশ জিতেও যেতেন না?

আজও তো ডাবলসে প্রথম সেটে ভারত (লিয়েন্ডারের সার্ভিসে) ব্রেক হয়েও পাল্টা ডাবল ব্রেক করে ৬-৪ জিতে স্টেডিয়ামকে মাতিয়ে দেয়। লোপেজ এমনকী নাদালও তখন নিজের সার্ভিস হারিয়ে বসেছেন। নাদাল তো গ্রাউন্ডস্ট্রোকও খুব খারাপ করছিলেন প্রথম দু’টো সেটে। দ্বিতীয় সেটের যেটা টার্নিং পয়েন্ট সেই ৫-৪ গেমে এগিয়ে থাকা অবস্থায় সাকেতের সার্ভিস ব্রেক হওয়ার কোনও মানে নেই। নেটের সামনে সহজ ভলি মিস করে সাকেত হারেন। টাইব্রেকারে ভারতীয় জুটিকে কোনও সুযোগ দেননি নাদালরা। তৃতীয় সেটে নাদাল কিছুটা নাদালের মতে খেলায় স্পেনের ২-১ সেটে এগিয়ে যেতে সমস্যা হয়নি।

কিন্ত চার নম্বর সেটে আবার গ্যালারিতে আগুন জ্বলেছিল। চড়চড় করে উত্তাপ বাড়ছিল। দ্বিতীয় গেমেই নাদালের সার্ভিস ভেঙে লিয়েন্ডাররা লড়াইয়ে ফিরে এসেছিলেন। নাদালকে ম্যাচের প্রায় সত্তর ভাগ সময় লেগেছে নাদালের ছায়া। তা সত্ত্বেও প্রথম সেটে হেরেও স্প্যানিশ জুটি জিতে গেল কী ভাবে?

নিজেদের ওজনের জোরে।

আজ কোথায় নাদালের সেই হেভি টপস্পিন? কোথায় সেই বিধ্বংসী ফোরহ্যান্ড! তার মধ্যেও নেটের সামনে দাঁড়িয়ে এমন কয়েকটা ড্রপ শট মারলেন, মনে হচ্ছিল সারা জীবন নাদাল যেন নেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন! যিনি কিনা গোটা কেরিয়ার কিংবদন্তি সিঙ্গলস প্লেয়ার। তাও আবার ‘বেসলাইন বম্বার!’ আর দায়বদ্ধতা? এটা নাদাল, লিয়েন্ডারের থেকে এই প্রজন্মের শেখার!

নেটের এক দিকে আজ তখন প্রথম সার্ভ ঠিকঠাক পড়ছিল না নাদালের। উত্তেজনায় ছটফট করছিলেন। কোনও শট লাইনের উনিশ-বিশ এ ধার-ও ধারে পড়লেই চ্যালেঞ্জ নিচ্ছিলেন। টিভি রিভিউয়ের জন্য। আসলে বিপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টির গেমপ্ল্যান। দ্বিতীয় সেট জেতার মু‌খে আসতেই লোপেজকে একটা পয়েন্ট খেলার মধ্যেও ছুটে গিয়ে তাতালেন। ২-১ সেটে এগিয়ে যাওয়ার পরে চতুর্থ সেটে যখন আবার পিছিয়ে পড়েছেন, একটা ড্রিঙ্কস ব্রেকে কোর্টের ধারে প্রকাশ্যেই রাগারাগি করলেন প্রায় গোটা টিমের সঙ্গে। নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেনকে দিয়ে লোপেজকে বোঝালেন স্ট্র্যাটেজি।

নেটের উল্টো দিকে আবার লিয়েন্ডার তাঁর ট্রেডমার্ক হাত ছুড়ে, পাগলের মতো চোখ করে, প্রচণ্ড চিৎকার করে নিজের পাশাপাশি সাকেতকে তাতালেন। গ্যালারিকে নিজেদের দিকে নিলেন। যে ঠাসা গ্যালারিতে আজ ভারতের সমর্থক আর নাদালভক্ত, দুই-ই প্রায় সমান সমান ছিল। বাকি তিন জন প্রথম সার্ভিস যেখানে ১৯০-১৯৫ কিমির আশপাশে করেছেন আজ, সেখানে লিয়েন্ডারের ১৬০-১৬৫। বাকিদের দ্বিতীয় সার্ভের গতির মতো। কিন্তু পেশাদার সার্কিটে প্রায় তিরিশ বছরের পোড়খাওয়া লিয়েন্ডার বুদ্ধি করে প্রচুর স্পিন মেশাচ্ছিলেন সার্ভিসে। গতির চেয়ে নিঁখুত লক্ষ্যের দিকে নজর দিয়েছিলেন বেশি। আর তেতাল্লিশের চিরযুবকের নেট প্লে? রিফ্লেক্স? এখনও লা জবাব! এ দিনও লিয়েন্ডারের বেশির ভাগ উইনার নেটের সামনে থেকে মারা অদ্ভুত সব ফ্লিকে। যাকে ‘প্রোদুনোভা ভল্টে’র মতো বলা যেতে পারে ‘লিয়েন্ডার ফ্লিক’। শটগুলো না পুরোপুরি ড্রপ শট, না ভলি। র‌্যাকেটটাকে তেরছা করে মারা অতুলনীয় সব প্লেসিং!

সাকেতও বেশ ভাল খেলেছেন। বিশেষ করে আগের দিন সিঙ্গলসে ও রকম লজ্জাজনক হারের ধাক্কা এক রাতের মধ্যে সামলে উঠে। ছয় ফুট দুইয়ের সার্ভ ছিল আজ চার প্লেয়ারের মধ্যে সেরা। নাদালের চেয়েও ভাল। তবু দিনের শেষে জয়ী নাদালরাই। ওয়ার্ল্ড গ্রুপে স্পেন-ই। ভারত আবার ওয়ার্ল্ড গ্রুপের দরজায় কড়া নেড়েও খুলতে ব্যর্থ।

কিন্তু এসব তো নিছক রসকসহীন পরিসংখ্যান। সাড়ে তিন ঘণ্টার লড়াই শেষে লিয়েন্ডার-নাদাল আলিঙ্গনের ফ্রেমটাই আসল। গোলিয়াথ তো ডেভিডকে হারাবেই। কিন্তু এখানে তো আলেকজান্ডারের কাছে রাজার মতো লড়ে পুরুর পরাজয়ের উজ্জ্বল ছবি।

নইলে নাদাল কেন বলে যাবেন, ‘‘লিয়েন্ডার বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম গ্রেট ডাবলস প্লেয়ার!’’ আর লিয়েন্ডার-ই বা কেন বলবেন, ‘‘ভারত আজ নিজের দেশে ডেভিস কাপে হেরে গেলেও সমস্ত ভারতবাসীর উচিত নাদালকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানানো। সবাই তো নাদালের অসাধারণ সিঙ্গলস ম্যাচ দেখেন। আপনারা আজ উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছিলেন রাফায়েল নাদালের অসাধারণ ডাবলস ম্যাচ দেখার।’’

একেবারে খাঁটি কথা!

ছবি: উৎপল সরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

davis cup leander paes
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE