Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

বদলার মহারণে প্রোটিয়া বধের লক্ষ্যে বিরাটবাহিনী

অতীতের সব ভারতীয় দলের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে এসে চরম ব্যর্থ হওয়াকে তুলে ধরে চ্যানেল বলে চলেছে, পঁচিশ বছর ধরে কোনও ভারতীয় দল কখনও সিরিজ জিতে ফেরেনি এখান থেকে।

বিরাট কোহলি এবং ফাফ ডুপ্লেসি

বিরাট কোহলি এবং ফাফ ডুপ্লেসি

সুমিত ঘোষ
কেপ টাউন শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৮ ০৪:১৪
Share: Save:

বাতাসে একটা গন্ধ আছে। কেউ যেন বলছে, এই টিমটা অন্য রকম। এরা পারবে।

না হলে সিরিজের যে রকম প্রোমো বানিয়েছে টিভি সম্প্রচারকারী চ্যানেল, তার কী ব্যাখ্যা হতে পারে?

অতীতের সব ভারতীয় দলের দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে এসে চরম ব্যর্থ হওয়াকে তুলে ধরে চ্যানেল বলে চলেছে, পঁচিশ বছর ধরে কোনও ভারতীয় দল কখনও সিরিজ জিতে ফেরেনি এখান থেকে। এ বার হবে বদলার সিরিজ! এমনকী, সচিন তেন্ডুলকরের স্টাম্প ছিটকে যাওয়া এবং তা দেখে এক ভক্তের টিভি বন্ধ করে দেওয়ার দৃশ্যও রাখা হয়েছে। সেই সচিন তেন্ডুলকর, যাঁকে এ দেশে ক্রিকেট ঈশ্বর মানা হয়েছে এতকাল।

দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের গায়ে ‘বদলা’ শব্দটা বসানো হচ্ছে, শুনলে অতীতের অনেক ভারত অধিনায়কের বুকের মধ্যেও ছ্যাৎ করে উঠতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকা বলতেই তাঁদের যে মনে পড়বে মুখের পাশ দিয়ে, নাকের পাশ দিয়ে ক্রমাগত লাল বলের উড়ে যাওয়া। দক্ষিণ আফ্রিকা বলতে তাঁদের মনে পড়বে কোনও এক অ্যালান ডোনাল্ডের মুখে সাদা ক্রিম লাগিয়ে দৌড়ে আসা এবং বাউন্সি পিচে আগুন ঝরানো।

নানা প্রজন্ম ধরে দক্ষিণ আফ্রিকায় লজ্জার সব স্কোরবোর্ড ভারতীয় দলের জন্য অপেক্ষা করে থেকেছে। ১৯৯৬-এর ডারবানে ডোনাল্ডের সামনে বিপর্যস্ত হয়ে ১০০ এবং ৬৬ অলআউট। ২০১০-এর সেঞ্চুরিয়নে ডেল স্টেনের আগুনের সামনে মাত্র ৩৮.৪ ওভারে ১৩৬ রানে পুড়ে ছারখার হয়ে যাওয়া। ভুল লেখা হয়নি। ৩৮.৪ ওভার-ই। ওয়ান ডে-র মতো ৫০ ওভারও টেকেনি ইনিংস। পঁচিশ বছরে মাত্র দু’টো টেস্টই দক্ষিণ আফ্রিকায় এসে জিততে পেরেছে ভারত। সিরিজ জেতা তো দূর অস্ত্‌।

ভারতের টিভি যেমন দেখাচ্ছে, তেমন দক্ষিণ আফ্রিকাও বলতে পারে— আমরা বদলা চাই। দু’বছর আগে তারা যখন ভারত সফরে গিয়েছিল, দুরন্ত ঘূর্ণি বানিয়ে অশ্বিন-জাডেজাকে লেলিয়ে দিয়েছিল ভারত। চার টেস্টের সিরিজ ০-৩ দুরমুশ হয়ে মুখ কালো করে ফিরতে হয়েছিল এ বি ডিভিলিয়ার্স, হাসিম আমলা-র মতো সফল, গর্বিত ক্রিকেটারদের।

এ বারে তাই পাল্টা স্লোগান তাঁরা তুলতেই পারেন যে, আমাদের দেশে গতির কড়াইয়ে ব্যাটাদের ভাজা ভাজা করো। বৃহস্পতিবার সাংবাদিক সম্মেলনে এসে দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক ফ্যাফ ডুপ্লেসি যেমন বলে দিলেন, ‘‘ভারতের সঙ্গে আমাদের হিসেব চোকানোর আছে।’’ এর পর বিরাট কোহালির খুব প্রশংসা করতে করতেও বললেন, ‘‘বিরাট খুব ভাল ব্যাটসম্যান। কিন্তু আমাদের কাজ হবে ওকে আটকে রাখা। আমাদের কিছু প্ল্যান আছে। সেগুলো গোপনই থাক।’’ বোঝাই যাচ্ছিল, ডুপ্লেসির ইঙ্গিত কোন দিকে। পরিষ্কার বার্তা দিয়ে দিতে চাইলেন তিনি অতিথিদের যে, দু’বছর আগে দেশের মাটিতে ডিজাইনার পিচ বানিয়ে আমাদের হারিয়েছিলে। এ বার রিটার্ন গিফ্‌ট দেব আমরা। ঘূর্ণির বদলে গতি আর বাউন্সের আগুন। নাও, সামলাও।

আশ্চর্যের হচ্ছে, ডুপ্লেসির হুমকির পরেও বাতাস থেকে গন্ধটা উড়ে যায়নি। কোথাও যেন নিঃশব্দে বাজছে সেই ইতিবাচক বাজনা— এই টিমটা অন্য রকম। এরা পারবে।

প্রশ্ন হল, কীভাবে পারবে? কেন পারবে? টিম কোহালির স্বপক্ষে সবচেয়ে বড় যুক্তি হচ্ছে, এখনকার ভারতীয় দল অনেক শক্তপোক্ত। মহম্মদ আজহারউদ্দিন পর্যন্ত আনন্দবাজার-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এগিয়ে রেখেছেন ভারতকে। একসঙ্গে বহুদিন ধরে কোহালি, মুরলী বিজয়, শিখর ধবন, চেতেশ্বর পূজারা, রোহিত শর্মা-রা খেলছেন। টিমটার রিংটোন সেট হয়ে গিয়েছে। কোহালির জেদি, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ অধিনায়ক আছেন। ক্রিকেটের ভাষাটাই যিনি পাল্টে দিচ্ছেন, তিনি ‘ঘরে বাঘ, বিদেশে বেড়াল’ তকমা গায়ে নিয়ে ঘুরতে চাইবেন বলে মনে হয় না। রবি শাস্ত্রীর মতো দুর্দান্ত ‘মোটিভেটর’ এবং ডাকাবুকো চিফ কোচ আছেন। যিনি সারাক্ষণ ক্রিকেটারদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের উচ্চতর শৃঙ্গ আরোহণ করার সাহস যুগিয়ে চলেছেন।

শাস্ত্রী-কোহালিদের বৃহস্পতিবারই একটা দুঃসাহসিক ‘স্ট্রোক’ নিতে দেখা গেল। ম্যাচের আগের দিন টিম প্র্যাক্টিসেই এল না। শুধু কোচিং টিমকে নিয়ে মাঠে এসে পিচ দেখে গেলেন শাস্ত্রী। আর কোহালি এমন বড় সিরিজ শুরুর আগে প্রাক-ম্যাচ প্রেস কনফারেন্সেই এলেন না। যা কোনও টেস্ট সিরিজের আগে দেখা গিয়েছে বলে মনে করা যাচ্ছে না। মানে প্রথম দিনেই খেপিয়ে রাখলেন মিডিয়াকে। সমালোচনা নিয়ে কতটা উদাসীন থাকলে তবেই এমনটা করা যায়। ডুপ্লেসির ‘হিসেব চোকানোর’ জবাবও তাই তোলা থাকল।

কেপ টাউনের স্থানীয় জনতার কাছে ক্রিকেটের চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এখানকার খরা। প্রায় দু’বছর ধরে জলের অভাবে জীবন কঠিন হয়ে উঠেছে। এ বার অবস্থা আরও মারাত্মক। সরকার থেকে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে, প্রত্যেকের জন্য দিনে সব কিছু মিলিয়ে ৮৭ লিটার জল বরাদ্দ। তার বেশি ব্যবহার করলে সরকারের প্রতিনিধি এসে জলের ট্যাপ বন্ধ করে দিয়ে যাবে। সমস্যা এমনই চরম আকার ধারণ করেছে।

নিউল্যান্ডসে দক্ষিণ আফ্রিকা প্র্যাক্টিস চলাকালীন এক স্থানীয় ব্যক্তি বলছিলেন, মাঠের পাশেই ঝর্ণা থেকে সবাই জল আনতে ছুটছে। কিন্তু জলের অভাবে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও ক্রিকেট নিয়ে উৎসাহ অবাক করে দেওয়ার মতো। সমস্ত টিকিট শেষ। হালফিলে কোনও টেস্টকে ঘিরে এমন আগ্রহ বিশ্বের কোথাও দেখা যায়নি।

খরার কারণে পিচের চেহারা দক্ষিণ আফ্রিকান থেকে ভারতীয় হয়ে যাবে, ভারতীয় টিম অবশ্য এমন অলীক কল্পনায় ভেসে যেতে নারাজ। তারা ধরে নিচ্ছে, দক্ষিণ আফ্রিকার সেই বাউন্সি, সিমিং উইকেটেই অগ্নিপরীক্ষা তাঁদের। আর বৃহস্পতিবারই তো দেখে নেওয়া গেল কেপ টাউনে কত তাড়াতাড়ি আবহাওয়া পাল্টে যেতে পারে। সারা দিন ধরে চড়া রোদের পরে পড়ন্ত বিকেলে মেঘ উড়তে থাকল টেবল মাউন্টেনের গা দিয়ে। সারা দিন যে টেবল মাউন্টেন স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছিল,তা-ই মুহূর্তে চলে গেল মেঘের আড়ালে।

প্রাক-ম্যাচ প্রস্তুতি যদি কোনও ইঙ্গিত হয়, তা হলে দু’টো দল দু’টো মেরুতে। একটা দল প্রথম একাদশ গড়া নিয়ে বিভ্রান্ত। অন্যদের প্রথম একাদশ মোটামুটি চূড়ান্ত। একটা দল ম্যাচের আগের দিনও কঠোর অনুশীলন করল। অন্যটা প্রাক-ম্যাচ অনুশীলনের পাঠই রাখল না। ম্যাচের আগের দিন বিশ্রাম নিয়ে টেস্ট খেলতে নামছে পরিপূর্ণ এনার্জি নিয়ে।

শুনতে অবিশ্বাস্যই লাগবে যে, বিভ্রান্তিতে ভোগা প্রথম দলটা দক্ষিণ আফ্রিকা। দ্বিতীয়টা ভারত। অর্থহীন প্রস্তুতি ম্যাচ বাতিলের পরে নতুন অভিনবত্ব কোহালি-রা নিয়ে এলেন, এত বড় টেস্ট সিরিজ শুরুর আগের দিন গোটা দল হোটেলে থেকে গিয়ে।

ক্রিকেটে নতুন দিশা খুলে দিল ভারতীয় দল? নাকি নিজের পায়ে নিজেরা কুড়ুল মারল? ঠিক হল না ভুল? আরও বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়া এটা নাকি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস? নতুন বছরের নিউল্যান্ডস বলে দেবে!

ভারতের মাটিতে ঘূর্ণি বানিয়ে ডিভিলিয়ার্সদের ধ্বংস করে দিওয়ালি পালন করেছিল কোহালির ভারত। এ বার কি গতির চক্রব্যূহে ফেলে অতিথিদের শেষ করে শোধ তুলবে দক্ষিণ আফ্রিকা? বদলার সিরিজ তকমাটা একদম ঠিক আছে। কারা বদলা নিতে পারে, সেটাই দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE