২ হোল্ডেন স্ট্রিট, কেনসিংটন পার্ক, অ্যাডিলেড। বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত ঠিকানা এখন তালাবন্দি। ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য
কোনটা বেশি ট্র্যাজিক? অ্যাডিলেড ওভালে ঠিক ঢোকার মুখে জড়ো হওয়া রাশি রাশি ফুল, ব্যাট এমনকী ক্রিকেট বলে ফিল হিউজের অঘোষিত মেমোরিয়াল? না অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের লাল কেল্লার তালা ঝুলতে থাকা এক বিষণ্ণ পাষাণপুরীতে রূপান্তরিত হওয়া?
২ হোল্ডেন স্ট্রিট, কেনসিংটন পার্ক, অ্যাডিলেড। অবশ্য শুধুই অজি ক্রিকেটের লালকেল্লা নয়, বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে সম্ভ্রম জাগানো ঠিকানা! স্যর ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান নামক কেউ লাল সুরকির এই প্রশস্ত দোতলা বাড়িতেই জীবনের শেষ একান্নটা বছর কাটিয়েছেন। মৃত্যুপরবর্তী তাঁর বাড়িতে এখন কে কে থাকেন, সিডনি বা অ্যাডিলেড ক্রিকেট মহলে ব্র্যাডম্যান ঘনিষ্ঠরাও তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছিল না। ডনের ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতনি সব আলাদা আলাদা বাড়িতে এখন থাকেন শুনছিলাম। কেউ কেউ অ্যাডিলেড শহর ছেড়েও চলে গিয়েছেন। অথচ ওই বাড়িতেই অজস্র স্মৃতিচিহ্ন লুকিয়ে রয়েছে স্যর ডনের। বাইরের ঘরে বিলিয়ার্ডস টেবলের তলায় একটা ট্রাঙ্ক আছে বলে শোনা যায়। বডিলাইন সিরিজে খেলা ব্যাট-সহ সেখানে এমন অনেক কিছু গচ্ছিত, যা ক্রিকেট প্রত্নতাত্ত্বিক এবং নিলামে কিনতে উৎসাহী দু’পক্ষেরই চোখ চকচক করাবে।
তা এ দিন চাক্ষুষ দেখা গেল, গেটে একটা মোটা তালাই শুধু ঝুলছে না, বাড়িতে ঢোকার মুখটা নোংরা। গেটের উপর হাল্কা ঝুল জমেছে। এমনিতে শহর হিসেবে অ্যাডিলেড যেমন ঝকঝকে আর আধুনিক, কেনসিংটন পার্কের মতো অভিজাত পাড়ায় ঝুল জমাতে দীর্ঘ দিন অবহেলার ‘কৃতিত্ব’ লাগবে। অ্যাডিলেড মাঠের ব্র্যাডম্যান জাদুঘর এবং ডনের সংগ্রহশালা বাউরালদু’পক্ষই কিন্তু বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে সম আগ্রহ দেখিয়েছিল। অস্ট্রেলীয় সরকার তো এক পায়ে খাড়া। চেয়েছিল অধিগ্রহণ করে ওটাই সরকারি ব্র্যাডম্যান সংগ্রহশালা করবে। ভারতে আজও সর্বকালের সবচেয়ে স্মরণীয় ব্যক্তিত্বের ভোটে গাঁধী জিতবেন। তেন্ডুলকর আসবেন অনেক পরে। অথচ অস্ট্রেলিয়ায় নিঃসন্দেহে এক নম্বরে ব্র্যাডম্যান। মৃত্যুর মাত্র বারো বছরের মধ্যে তাঁর বাড়ি গ্যারিঞ্চার আদি বাড়ির মতোই যন্ত্রণাক্লিষ্ট দেখানোর একটাই ব্যাখ্যা। ছেলে জন ব্র্যাডম্যান বাড়ি এই ভাবে নিজের জিম্মায় রেখে দিতে চান। গোঁয়ার্তুমি তিনি কিছুতেই ছাড়বেন না।
ব্র্যাডম্যান-প্রসঙ্গ উঠছে কারণ মঙ্গলবার অ্যাডিলেডে বিশ্বের সর্বকালের সবচেয়ে শোকগ্রস্ত টেস্ট ম্যাচ শুরুর প্রাক্কালে হঠাৎ দক্ষিণ অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট কর্তারা ফিল হিউজকে “ট্র্যাজিক ব্র্যাডম্যান” বলতে শুরু করেছেন। এমনিতে অস্ট্রেলীয় মহাদেশে ব্র্যাডম্যান হলেন তাবৎ বিষয়ে যোগ্যতা অর্জনকারীদের একটা স্কেল। এত দিন তা দিয়ে প্রতিশ্রুতিমানদেরই মাপা হয়েছে। এই প্রথম বিষণ্ণতাকেও সেই স্কেলে ফেলা হল। সম্ভবত বোঝানো হল, এতই মর্মান্তিক তাঁর মৃত্যু যে বিষণ্ণতার ঘনত্বে ব্র্যাডম্যান তুল্য!
ফিল হিউজ নিয়ে এখানে যা সব ঘটছে সত্যি তার কোনও পূর্বসূরি নেই! জীবনের শেষ স্কোর ছিল ৬৩। তাই প্রথম দিন খেলা শুরুর আগে ঠিক ৬৩ সেকেন্ড ধরে নাকি হাততালি চলবে। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটাররা শুধু কালো রিস্টব্যান্ডই নয়, প্রত্যেকে জার্সিতে ৪০৮ নম্বর লাগিয়ে নামবেন। অ্যাডিলেড ওভালের বিভিন্ন প্রান্তে ৪০৮ নম্বর সাদা রং দিয়ে লেখা চলছে। খেলার ঠিক আগে প্রথম টেস্টে ভারতের নতুন অধিনায়ক বিরাট কোহলি আর অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপ্টেন মাইকেল ক্লার্ক হেঁটে যাওয়ার সময় বিশেষ ভাবে তৈরি একটা ভিডিও দেখানো হবে। যার ভাষ্য দিতে এমন অশক্ত শরীরেও রাজি হয়েছেন রিচি বেনো। কিন্তু এগুলো তো উপচার হিসাবে আসবে ধরাই হয়েছিল। অভূতপূর্ব যা ঘটতে চলেছে, তা হল, এই প্রথম টেস্ট স্কোয়াডে কোনও মৃত ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তি ঘটছে।
অ্যাডিলেড ওভালে অস্থায়ী স্মৃতিসৌধে হিউজের ছবির পাশে লাল ক্রিকেট বল থাকা নিয়ে বিতর্ক। ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য
কাল অ্যাডিলেড ওভালে অস্ট্রেলীয় অনুশীলনে হঠাৎ এসে উপস্থিত হন এ দেশের গভর্নর জেনারেল। মাইকেল ক্লার্কের টিমকে ছোট বক্তৃতাও দেন, যে ছেড়ে গ্যাছে তাকে ছেড়ে দিতে নেই। ও হল তোমাদের অঘোষিত থার্টিন্থ ম্যান। তার পর আজ শুনছি, ঘোষিত ভাবেই না কি ফিল হিউজ অ্যাডিলেড টেস্টের থার্টিন্থ ম্যান। টেস্ট ক্রিকেটের একশো সাঁইত্রিশ বছরে এমন কখনও ঘটেনি! ধোনির ভারত তো আরও চূড়ান্ত বিপরীত। টাইগার পটোডি মারা যাওয়ার পর মাসখানেকের মধ্যে দিল্লির প্রথম টেস্টে কেউ কালো ব্যান্ড অবধি বাঁধেনি। এটা আরও একটা বিপরীত! সব কিছুতে অস্ট্রেলীয়রা যেন আধিদৈবিক মাত্রা জড়ো করেছে। মাঠের বাইরে ফিলিপ হিউজের স্মৃতির উদ্দেশ্যে যাবতীয় উপহারের মধ্যে কেউ দুটো ক্রিকেট বল রেখে গ্যাছে বলে স্থানীয় ক্রিকেট অনুরাগীরা মাঠে এসে ক্ষোভ জানালেন, শেষ শ্রদ্ধায় লাল বল কেন থাকবে? ওটাই তো ঘাতক! আর মাইকেল ক্লার্ক? তিন সপ্তাহ আগেও চূড়ান্ত ধিকৃত হচ্ছিলেন ক্রিকেট মহলে। ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে সম্পর্কে এমন অবনতি ঘটেছিল যে, তাঁর অধিনায়কত্ব থাকবে কি না প্রশ্ন উঠছিল। হিউজোত্তর তিনি এমন শ্রদ্ধার বেদীতে যে চ্যানেল নাইনের অ্যাঙ্কররা বলছে, মাইকেল তোমায় খেলতেই হবে। ম্যাচ প্র্যাকটিস নেই তো কী! এমন মনের অবস্থায় খেলাটাই হবে তোমার থেরাপি। এটাও অভূতপূর্ব! অ্যাডিলেড মাঠের সাত কিলোমিটচারের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় সম্পদের বাড়িতে তালা ঝুলছে। কেউ জানেও না। সবাই হিউজ নিয়ে মত্ত।
অথচ মাঠের বাইরে অ্যাডিলেড শহরে আর কোথাও কিছু নেই। এখানে আসার আগে সিডনি বিমনানবন্দরেও দেখে এলাম এক্সমাস ট্রিতে সর্বত্র সাজানো। লোকে উপচে পড়ে ফি বছরের মতো শপিং করছে। চার দিকে বিশাল আলোকসজ্জা। ম্যাক্সভিলের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার দিন অবধি দেশ যা শোকার্ত ছিল, ছিল। আবার ফিরে গিয়েছে পরিচিত জীবনে। সফরকারী দলও প্রায় দু’সপ্তাহ ব্যাপী টানা সৌজন্যের পর এ বার আড়ালে-আবডালে বলা শুরু করেছে, হচ্ছেটা কী? অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী তো আকস্মিক মারা যাননি যে সব কিছু এমন বন্ধ করে দিতে হবে? এত আদেখলামো কেন?
ভারতীয় ম্যানেজমেন্ট যথেষ্ট বিরক্তই যে ভাবে অস্ট্রেলিয়া সিরিজ শুরুর সময় আরও পিছিয়ে দিতে চাইছিল। তারা চাইছিল ব্রিসবেন টেস্টটা সবশেষে খেলতে। ভারত জোর দেয় না, ব্রিসবেন সবার পরে আর অ্যাডিলেডে এখনই খেলতে হবে। তারিখ এগিয়ে এনে। ভারতে অবস্থিত ক্রিকেট মহল থেকে কেউ কেউ এ দিন লং ডিসট্যান্স ফোনে বললেন, “মৃত্যু মর্মান্তিক সন্দেহ নেই কিন্তু লাম্বা মারা যাওয়ার পর অস্ট্রেলিয়া কিছু করেছিল কি? লাম্বা তো অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ওয়ান ডে-তে ম্যান অব দ্য সিরিজ হওয়ার দশ বছরের মধ্যে মারা গিয়েছিল। অ্যালান বর্ডার কি একটাও মেসেজ পাঠিয়েছিল?” ফোনে আবার ভারতেরই কোনও কোনও ক্রিকেট ব্যক্তিত্বকে পাওয়া গেল যাঁরা একমত নন। তাঁদের মতে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলো সে সময় থাকলে লাম্বার মৃত্যু নিয়েও ক্রিকেটবিশ্ব ব্যাপী একই রকম তোলপাড় হত!
যাঁরাই ঠিক হন, ক্রমশ অনেকের মনে হতে শুরু করেছে, ফিল হিউজ অধ্যায় এ বার একটু বাড়াবাড়ি হয়ে সোপ অপেরার দিকে যাচ্ছে।
অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট মহল যা মানতে অবশ্যই রাজি হবে না। বিশ্বকাপের জন্য একেবারে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়া অ্যাডিলেড ওভালকে তারা আগামী ক’দিন ফিল হিউজ স্মৃতি সংগ্রহশালা হিসাবে দেখতেই বদ্ধপরিকর। বিশ্বে সত্যি কখনও এমনতর টেস্ট ম্যাচ হয়নি। শুধু মাত্রাটা আরও চড়া হলে ‘বিষণ্ণতার ব্র্যাডম্যান’ উপাধিটা ম্যাচের ত্রয়োদশ ব্যক্তির সঙ্গে বেশি দিন থাকবে না।
ডন অবশ্য এমনিতেও ‘ব্র্যাডম্যান’ উপাধিটা বেশি দিন কারও কাছে ঐতিহাসিক ভাবে রাখতে দেননি। সে প্রতিশ্রুতিমান ক্রিকেটার হোক। কী অকালে ঝরে যাওয়া হতভাগ্য ট্যালেন্ট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy