অনুশীলনের ফাঁকে কি তৈরি হচ্ছে স্ট্র্যাটেজি? মঙ্গলবার ফতুল্লায় শাস্ত্রী-বিরাট। অস্ত্রে শান হরভজনের। ছবি: দেবাশিস সেন
নারায়ণগঞ্জ নিকটবর্তী এই অঞ্চলের গরিমা আজ বোধহয় শুধু অতীতই বহন করে। একটা সময় এখানে চৌধুরী পরিবারের রাজত্ব ছিল। ফতুল্লা ঐশ্বর্য শোনা যায় তখন কিছু কম ছিল না। সে দিন আর এ দিনে বড় তফাত। সময়ের খেয়ালে বিলুপ্ত এখন অনেক কিছু। চৌধুরীদের পুরনো রাজত্ব নেই। তার রাজঐশ্বর্যও নেই। লোকে বলে, পদ্মাপারের বাণিজ্যিক অঞ্চলের মধ্যে ফতুল্লা এখনও অন্যতম। বলে যখন, হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু ফতুল্লা স্টেডিয়ামের পার্শ্ববর্তী এলাকা অন্তত কোনও প্রাচুর্যের খোঁজ দেবে না।
স্টেডিয়ামের অবস্থানও কেমন যেন বেখাপ্পা ঠেকবে। দিগন্তবিস্তৃত হাইওয়ে এক দিকে। ও দিকে স্টেডিয়ামে ঢোকার প্রধান গেট। আবার মিডিয়া সেন্টারের গেট দিয়ে যদি ঢুকতে যান, প্রচুর ধুলোবালি হজম করতে হবে। জায়গায়-জায়গায় সবুজের আধিক্য আছে। স্থানীয়দের আতিথেয়তা আছে। তবু কিছু একটা যেন থেকেও নেই।
সমাপতন মনে হতে পারে। এক কালের চৌধুরী সাম্রাজ্যের ঐশ্বর্য-ভূমিতেই বুধবার গোড়াপত্তন হচ্ছে নতুন ক্রিকেট-রাজত্বের।
বিরাট-রাজত্বের।
কেউ কেউ বলতে পারেন, সেটা কী করে সম্ভব? গত বছর সিডনিতে সরকারি ভাবে টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে বিরাট কোহলির তো অভিষেক হয়ে গেল (অ্যাডিলেডে অধিনায়ক ছিলেন আহত ধোনির জায়গায় স্টপ গ্যাপ হিসেবে)। ফতুল্লা টেস্ট পরিসংখ্যানে তৃতীয়। কোনও ভাবে অধিনায়ক বিরাটের প্রথম টেস্ট নয়। কিন্তু ওসমান আলি স্টেডিয়ামের প্রেস কনফারেন্স রুমে ঝকঝকে চোখমুখ নিয়ে যে ছেলেটা বসেছিল, তাকে তো দেখে মনে হল বুধবার টেস্ট অধিনায়ক হিসেবে প্রথম সে নামতে যাচ্ছে। ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেন্সি শব্দগুলো কানে গেলেই সে হেসে ফেলছে। মোহাচ্ছন্ন স্বরে বলে ফেলছে, “কোনও দিন ভাবিনি ছাব্বিশ বছরে ভারতের টেস্ট অধিনায়ক হয়ে যাব। ভাবতাম, দেশের হয়ে টেস্ট খেলব। কিন্তু ক্যাপ্টেন হয়ে যাব ভাবিনি...।” আবেগে ডুবতে ডুবতে বলছে, “কাল মাঠে যখন পা দেব, আলাদা অনুভূতি হবে। অ্যাডিলেড টেস্টে নেতৃত্ব দিলাম। কিন্তু জানতাম যে, এমএস নেই বলে ক্যাপ্টেন্সি করছি। সিডনি টেস্টে প্রথম নেতৃত্ব দিলাম। কিন্তু ফতুল্লা থেকে তো রেগুলার টেস্ট ক্যাপ্টেন আমি।”
সরল এবং সঠিক যুক্তি। কর্কশ পরিসংখ্যান যা-ই বলুক, গত অস্ট্রেলিয়া সফরের সিডনি টেস্ট ছিল সিরিজের অন্তিম। চার টেস্টের সিরিজ হয়েও আদতে ওটা ছিল ভাঙা টেস্ট। মহেন্দ্র সিংহ ধোনির টেস্ট ক্রিকেট থেকে আকস্মিক বিদায়ের চর্চায় যার গুরুত্ব হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মুশফিকুর রহিমের টিমের বিরুদ্ধে বুধবার থেকে যেটা শুরু হচ্ছে সেটা সংখ্যায় এক এবং একমাত্র হলেও আসলে পূর্ণাঙ্গ। যা ঢাক-কাঁসর-ঘণ্টায় আগমনী বাজনা তুলবে ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটে বিরাট-যুগের।
টেস্ট ক্রিকেটে ধোনি যুগের বিদায়-বাদ্য কি একই সঙ্গে আরও প্রকট, আরও স্পষ্ট হচ্ছে না?
মঙ্গলবার ঢাকার টিম হোটেল, মাঠ, সাংবাদিক সম্মেলন বিভিন্ন জায়গা ঘুরে যে ছড়ানো-ছেটানো ঘটনাবলী পাওয়া গেল, তাকে সযত্নে জুড়লে তো তেমনই দাঁড়াবে। ধোনি-রাজে যে যে ব্যাপার ছিল অদৃশ্য, বিরাট-রাজে তা সূর্যালোকের মতো স্পষ্ট।
সম্ভাব্য টিম কম্বিনেশন নিয়ে প্রশ্ন করলে এমএসডির থেকে পাওয়া যেত বড়জোর ‘কেন বলব’ বা কিছু না বলে একটা তির্যক হাসি।
সম্ভাব্য টিম কম্বিনেশন নিয়ে প্রশ্ন যেতে বিরাট উত্তরটা দিলেন সিকি সেকেন্ডে। সিক্স প্লাস ফাইভ। ছ’টা ব্যাটসম্যান (উইকেটকিপার-সহ), সঙ্গে পাঁচটা বোলার। এটা তাঁর পছন্দের। ফতুল্লা টেস্টে যার প্রয়োগ তিনি করতেই পারেন।
ধোনি-রাজের সময় কেউ কেউ বলতেন, টিম মিটিংয়ে খুব একটা বিশ্বাস রাখেন না ভারত অধিনায়ক।
বিরাট-রাজে দেখতে পাওয়া গেল দু’টো মিটিং হচ্ছে। সকালে বোলিং কোচ ভরত অরুণের সঙ্গে বোলারদের। সন্ধেয় শাস্ত্রী-বাঙ্গারের সঙ্গে ব্যাটসম্যানদের। যতই সেটা এক টেস্টের যুদ্ধ হোক। যতই প্রতিপক্ষকে টেস্ট ক্রিকেটে পরাক্রমী না দেখাক।
টিম ম্যানেজমেন্টের এক জন বলছিলেন, বিরাট একা নন। বিরাট প্লাস রবি। নতুন সংসারের মনন এঁরা দু’জন মিলে পাল্টে দিয়েছেন। এমনিতে ঢাকায় যা গরম, তাতে হোটেলে ক্রিকেটাররা শুয়ে-বসে থাকলেও কিছু বলার নেই। টিম মাঠে যাচ্ছে, কিন্তু রোদের তেজে প্র্যাকটিসের সময় কাটছাঁট করে ফিরে আসতে হচ্ছে। মঙ্গলবারও তাই হল। টিম গেল মাঠে। কিন্তু ইশান্ত শর্মাদের দিয়ে বল করানো হল না। অথচ ক্রিকেটাররা যে হোটেলে ফিরে যে যার ঘুরে ঢুকে যাচ্ছেন, সেটা নয়। কেউ জিমে চলে যাচ্ছেন। কেউ নাকি বসে পড়ছেন অ্যানালিস্টের সঙ্গে। টেস্ট একটা হলেও মনোযোগ দেখলে নাকি মনে হচ্ছে পাঁচ টেস্টের লম্বা সিরিজ সামনে অপেক্ষা করছে! উইকেট পাটা। বিরাট দেখে নাকি গাঁইগুঁই করেছেন। ঋদ্ধিমান সাহার উত্তুঙ্গ প্রশংসা আবারও করে গেলেন অধিনায়ক, শুনে বাংলা কিপার ভাবলেশহীন। ড্রেসিংরুমের দিকে যেতে যেতে বললেন, “ক্যাপ্টেন প্রশংসা করলে কার না ভাল লাগে? কিন্তু আমাকেও তো ভাল খেলতে হবে।”
বাংলাদেশ বোলিংকে শুরুতে সামলাবেন যাঁরা। ধবন-মুরলী। ছবি: এএফপি
এমনিতেই নাকি পাকিস্তান সিরিজের মতো দুর্জয় সাহস নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে টেস্টে নামার কথা ভাবছে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মিডিয়ার পক্ষ থেকে বলা হল, ফতুল্লায় টেস্ট দেওয়া হয়েছে কারণ মীরপুরের উইকেটে একটু-আধটু সুইং হয়। সেখানে ফতুল্লা সম্পূর্ণ পাটা। ভাল ব্যাট করলে ড্র আসবে। সে কোচ হাতুরাসিংঘে যতই ‘উইকেটের কিছু বুঝছি না’ বলে যান। বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহিম বলে গেলেন, ভারতের কুড়িটা উইকেট তোলার মতো বোলার তাঁদের আছে। সেটাও সত্যি কতটা সম্ভব কে জানে। শিখর, বিজয়, পূজারা, রাহানে, রোহিত, বিরাট— এই ছ’জনের মধ্যে যে কোনও পাঁচকে নামানোই রাত পর্যন্ত কাঙ্খিত মনে করছে ভারত। পূজারা যে ফর্মুলায় বসলেও বসতে পারেন। কিন্তু বাকি পাঁচ নামও উপমহাদেশীয় উইকেটে এক এক জন ব্যাটিং-মহীরূহ নন কি? সবার উপরে আবার বিরাট।
মুশফিকুর তো সোজাসুজি বলেই গেলেন, অধিনায়কত্ব চাপলে বিরাটের ব্যাটিংয়ে কী যেন একটা হয়। কী করে যেন সেটা আক্রমণাত্মক থেকে আপনাআপনি প্রবল আক্রমণাত্মক হয়ে যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy