Advertisement
E-Paper

এই লড়াই কতদিন চালাতে পারবেন কে জানে!

তাঁর প্যাডেলে পা, চিলের মতো তাকিয়ে আছেন সামনের দিকে। খুটবেড়ের মিলনতারা হুহু উড়ছেন। মির্জাপুর থেকে খুটবেড়ে হয়ে বেলডাঙার গ্রামটা এখন নতুন নাম পেয়েছে, মিলনতারার গ্রাম। লিখছেন অনল আবেদিন বেলডাঙার ওই গ্রামের সরকারি একটা নাম আছে বটে, মির্জাপুর। কিন্তু সে নামে চেনে ক’জন। মির্জাপুর থেকে খুটবেড়ে যাত্রার কথায় আসা যাক।

অনল আবেদিন

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৬:৫৪
ছবি: সঞ্জীব প্রামাণিক ও গৌতম প্রামাণিক

ছবি: সঞ্জীব প্রামাণিক ও গৌতম প্রামাণিক

কয়েক দশক আগেও মুর্শিদাবাদ জেলায় লোকের মুখে মুখে ঘুরত গ্রামটার নাম, খুটবেড়ে।

বেলডাঙার ওই গ্রামের সরকারি একটা নাম আছে বটে, মির্জাপুর। কিন্তু সে নামে চেনে ক’জন। মির্জাপুর থেকে খুটবেড়ে যাত্রার কথায় আসা যাক।

স্বাধীনতার পর জমিদারি প্রথার অবলুপ্তি ঘটে। তার পরও অনেক গ্রামে ‘জোতদার রাজ’ কায়েম ছিল। সেই জোতদার ও ধনী চাষিদের নেতৃত্বে গ্রামে সালিশি সভা বসত। গ্রামের কেউ কোনও ‘ভুল’ করলে তার বিচার হত সেই সালিশি সভায়। বিচার বলে বিচার! জোতদার ও গ্রামের ধনী চাষিদের নির্দেশে ‘অপরাধী’কে খুটবেড়ে দিয়ে বেধড়ক মারা হত। ‘খুটবেড়ে’ হল প্রায় হাতদুয়েক লম্বা একটি বাঁশের লাঠি। সেই লাঠি দিয়ে মারা হত। এমনকী, বাড়ির মহিলাদেরও ওই লাঠি দিয়ে মারা হত সালিশিতে।

এমন এক ‘পিছিয়ে পড়া’ গ্রামেই জন্ম তাঁর, মিলনতারা খাতুন। সিনেমার ‘কোনি’র মতো মির্জাপুরের মিলনতারারও লড়াইটা ছিল দারিদ্রের সঙ্গে। তবে কোনির মতো লড়াই করার মানসিক জোর ছিল মিলনতারার। অমিল কেবল একটি জায়গায়। সিনেমার কোনি এক জন ‘খিদ্দা’কে (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) পেয়েছিল। মিলনতারার তেমন কেউ নেই। পরিবারের প্রায় সকলেই নিরক্ষর। এমন এক পরিবারের সন্তান মিলনতারার লড়াইটা তাই আরও কঠিন হয়ে পড়েছিল। বাধা অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। সাইকেল রেসিংয়ে পাঁচ বার এবং কবাডিতে সাত বার জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতায় রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। রাজ্যস্তরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন বেশ কয়েকবার।

তবে খেলাধুলোয় কৃতিত্ব দেখাতে গিয়ে সমাজের প্রতি ‘দায়িত্বের’ কথা ভোলেননি মিলনতারা। তাঁর মতো কঠিন লড়াই উত্তরসূরিদের লড়তে যাতে না হয়, সে ব্যাপারে সজাগ তিনি। কয়েক বছর ধরে বেলডাঙার দেবকুণ্ড গ্রামের দু’টি মাদ্রাসার ছেলেমেয়েদের সাইকেল রেসিং এবং কবাডির প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি। পরিবর্তে সামান্য সাম্মানিক অর্থ পান। মিলনতারার ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এ পর্যন্ত অন্তত ১০ জন ওই দুই প্রতিযোগিতায় জাতীয় স্তরে অংশগ্রহণ করেছেন।

মিলনতারার জীবন-বৃত্তান্ত সিনেমাকে হার মানাবে। বাবা লেখাপড়া জানতেন না। তাঁর প্রায় সাত বিঘা জমি ছিল। তাতে চাষবাস করেই সংসার চলত। মিলনতারারা চার বোন এবং এক ভাই। তাঁর তিন দিদির বিয়ে দিতে গিয়ে সেই জমির অনেকটাই বিক্রি করে দিতে হয়েছিল। যেটুকু ছিল, মিলনতারার ভাই পথদুর্ঘটনায় আহত হলে তাঁর চিকিৎসায় সেটুকুও বিক্রি করে দিতে হয়। তারপর থেকে আর আর্থিকভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি পরিবারটি। লড়াই এখনও চলছে। বছর চব্বিশের মেয়েটি বলছেন, ‘‘বছরদুয়েক আগে বেলডাঙা থানার সামনে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছিল ভাই। সেই সময় একটি ট্রাক ওকে ধাকা মারল। পা কেটে বাদ দেওয়ার উপক্রম হয়েছিল। অনেকদিন ধরে ওর চিকিৎসা চলে। প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা খরচ করতে হয়েছিল। জমি বিক্রি না করলে অত টাকা কোথায় পেতাম! ওই দুর্ঘটনায় আমরা আক্ষরিক অর্থেই সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছি।’’

‘খুটবেড়ে’ গ্রামে প্রাথমিক স্কুল বিশেষ ছিল না। এমন এক গ্রামে মেয়েদের পড়াশোনার চল যে থাকবে না, তা অনুমান করাই যায়। মিলনতারা নিজেও পড়াশোনার চেয়ে খেলাধুলোয় বেশি আগ্রহী ছিলেন। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়ঝাঁপ দিয়ে বেড়াতেন। কবাডিতে সকলকে তাক লাগিয়ে দিতেন। জাগলিং, শটপাটে দড় ছিলেন তিনি। এর মধ্যেই এক দিন ল্যান্স আমস্ট্রংয়ের কথা জানতে পারেন। সাইকেল রেসিংয়ে তাঁর কৃতিত্ব অনুপ্রাণিত করেছিল তাঁকে। তারপরই সাইক্লিস্ট হওয়ার লড়াইয়ে নেমে পড়েন তিনি। কখনও বাবার ভাঙা সাইকেল, কখনও প্রতিবেশী কাকুর কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া সাইকেলেই চলত অনুশীলন। কিন্তু রেসিংয়ের সাইকেল, জুতোর তো অনেক দাম। কিন্তু অত টাকা পাবেন কোথায়!

সে-এ আরেক লড়াই। মিলনতারা কথায়, ‘‘প্রতিযোগিতায় নামার কিছুক্ষণ আগে আয়োজকদের কাছ থেকে রেসিং সাইকেল মিলত। ওই ভাবেই প্রতিযোগিতা গুলোয় অংশ নিতে পেরেছিলাম।’’ তবে এ ভাবে যে অলিম্পিক্সে যোগদানের স্বপ্ন পূরণ হবে না, হয় তো বুঝেছিলেন তিনি। মিলনতারা বললেন ‘‘এটা একটা অসম যুদ্ধ। বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব না ভেবে হাল ছেড়ে দিলাম। হাই মাদ্রাসার ছেলেমেয়েদের সাইক্লিং ও কবাডির প্রশিক্ষণ দিচ্ছি।’’

তবে রাজ্য সাইক্লিং অ্যাকাডেমির অন্যতম কর্তা বাণী বসুর সহায়তায় মিলনতারা কয়েকটি রেসিং সাইকেল পেয়েছেন। কিন্তু তারপরও হ্যাপা অনেক। ছাত্রছাত্রীদের অনুশীলনের কোনও মাঠ নেই। এলাকার স্কুল কিংবা কলেজ কর্তৃপক্ষকে বলে তাঁদের মাঠে কয়েক ঘণ্টার জন্য অনুশীলন চলে। মিলনাতারা জানালেন, রেসিংয়ের পোশাক পরে মেয়েরা অনুশীলন করায় অনেক সময় তাদের বিদ্রুপের মুখে পড়তে হচ্ছে।

এই লড়াই কতদিন চালাতে পারবেন কে জানে! মিলনতারা জানালেন, এর মধ্যে একবার কলকাতা পুলিশে চাকরির পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কিম্তু উচ্চতা কম থাকায় আটকে যান। তাঁর দুরবস্থার কথা জানতে পেরে লালগোলা থানার ওসি বিপ্লব কর্মকার একটি টোটোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তাঁকে। পাশে পেয়েছেন একটি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষিকা মুর্শিদা খাতুনকেও। মিলনতারার সাম্মানিক ভাতা সম্প্রতি এক হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে দেড় হাজার টাকা করেছেন তিনি। সঙ্গে স্কুলে দুপুরে মিলনতারা খাবার বন্দোবস্তও। বেলডাঙার থানার ওসি সমিত তালুকদার মিলনতারাকে একটি অ্যাকাডেমি খোলার ব্যাপারে সাহায্য করছেন।

এ ভাবেই স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে চলেছেন মিলনতারা। মনে রেখেছেন সেই উক্তিও— ফাইট কোনি ফাইট।

ছবি: সঞ্জীব প্রামাণিক ও গৌতম প্রামাণিক

Dream Cycle Milantara Khatun
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy