কমেন্ট্রি বক্সে অরুণ লালের প্রত্যাবর্তন। শনিবার ইডেনের ঐতিহাসিক ম্যাচে।
ক্রিজ থেকে বেশ কিছুটা বেরিয়ে এসে ব্যাট ধরলেন ঋদ্ধিমান সাহা। উল্টো দিকের বোলারদের হাত থেকে তখন গোলাপি বল যেন গোলার মতো বেরোচ্ছে।
মেঘলা আকাশ। ঘাসে ভরা উইকেট। চকচকে, উজ্জ্বল গোলাপি কোকাবুরার ছটফটানি ব্যাটসম্যানদের শিরদাঁড়ায় যেন বরফজলের স্রোত বইয়ে দিচ্ছে। ভারতীয় টেস্ট দলের নিয়মিত নাম ঋদ্ধিমান সাহার ওই স্টান্স দেখল সারা দেশ। রেকর্ডও হয়ে থাকল প্রথম ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটারের প্রথম গোলাপি অভিজ্ঞতা।
কেন এমন স্টান্স? গোলাপি বল যা মারাত্মক সুইং করছিল, তা এড়াতেই অনেকটা এগিয়ে থেকে ব্যাট করা ঋদ্ধির। রাতে ইডেন থেকে বেরবার সময় বলে গেলেন, ‘‘এই কারণটা তো আছেই। বোলাররা যাতে ব্যাক অব দ্য লেংথে বোলিং করতে বাধ্য হয়, সে জন্যও এগিয়ে ব্যাট করছিলাম। এতে এলবিডব্লিউ, বোল্ড হওয়ার চান্সটাও কম থাকে।’’ ভারতীয় দলের হয়ে নিয়মিত টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা থেকেই এটা শিখেছেন তিনি। উল্টো দিকে থাকা অনুষ্টুপ মজুমদারও তাঁকে অনুসরণ করেই ৮৩ রান তুলে ফেললেন।
অ্যাডিলেডে সাড়ে তিন দিনে শেষ হওয়া দিন-রাতের প্রথম টেস্টে সবচেয়ে বেশি ব্যক্তিগত রানটা ছিল ৬৬, পিটার নেভিলের। ২২৪-এর বেশি ওঠেনি কোনও ইনিংসেই। ভারতের বুকে গোলাপি বলের প্রথম ম্যাচেও প্রায় সে রকমই অবস্থা। পেসাররাই দাপাচ্ছেন, কাঁপাচ্ছেন। রবিবার ভারতীয় দলের পেসার মহম্মদ শামির হাতে বল পড়লে উল্টো দিকের ব্যাটসম্যানদের কী হাল হবে, সেটা রবিবারের শহরের একটা বড় আকর্ষণ হয়ে উঠতে পারে।
ম্যাচটা সিএবি সুপার লিগের ফাইনাল। মোহনবাগান বনাম ভবানীপুর ক্লাব। কিন্তু শনিবাসরীয় ইডেনে কখনওই সেটা মুখ্য ব্যাপার বলে মনে হয়নি। বরং রাতের মোহময়ী আলোয় এমন সনাতন ‘হোয়াইটসে’ ক্রিকেটারদের দেখে মনে হয়েছে এ যেন নতুন বোতলে পুরনো মদ। ইডেনের ১৫২ বছরের ইতিহাসে যা অভূতপূর্ব, অভাবনীয়ও বটে। জগমোহন ডালমিয়ার যুগে যা ভাবা যায়নি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যুগে তা দেখল ইডেন।
ক্রিকেটের এই নতুন রূপ দেখার টানে সদ্য ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ জিতে এসে যিনি সারাক্ষণ কমেন্ট্রি বক্সে বসে লক্ষাধিক শব্দ বলে গেলেন, সেই অরুণ লালের চোখদুটো যেন জ্বলে উঠল গোলাপি বলের কথা শুনে। বললেন, ‘‘আশা করিনি এত ভাল লাগবে। ফ্লাডলাইটস, সাদা পোশাক, গোলাপি বল— সব মিলিয়ে কি অসাধারণ একটা ব্যাপার ঘটছে। এটা যদি টেস্টের ভবিষ্যৎ হয়, তা হলে তো টেস্ট ক্রিকেটের মেয়াদ আরও একশো বছর বেড়ে গেল।’’
প্যাকার-বিপ্লবের সময় ক্রিকেট হয়ে উঠেছিল রঙিন। সূর্য ডোবার পরও জ্বলে উঠেছিল ফ্লাড লাইট। আর এ দিন ইডেনে ক্রিকেটের সেই চেনা সাদা রঙ ফিরে এল। ফের সেই ফ্লাড লাইটের আলোর নীচে।
এই হোয়াইটস আর ফ্লাড লাইটের অনুঘটক যে, সেই গোলাপি বলই এ দিন ইডেনের রাজা। সে এল, দেখল আর জিতে নিল সবার মন। আর ক্রিকেটের আধুনিকপন্থীদের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিল, ‘‘আপনি থাকছেন স্যর’’।
দু’দিন আগেই ডিন জোন্সের মন্তব্যের রেশ রেখে বলা যায়, সত্যিই যেন ‘সেক্সি’ হয়ে উঠল সুন্দরী ‘ডে’জ’ ক্রিকেট। এখন তাকে আরও আকর্ষনীয় দেখাচ্ছে।
কয়েক মাস পর এই আবহে বিরাট কোহালির ব্যাট থেকে ছিটকে বেরনো গোলাপি যখন সারা মাঠে ছুটবে, এই পরিবেশের নমনীয়তা যখন ছিন্নভিন্ন করতে চাইবে ট্রেন্ট বোল্ট বা মিচেল স্টার্কের আগ্রাসন, তখন ক্রিকেটপ্রেমীরা না ক্রিকেটপাগল হয়ে যান। এমন ‘আশঙ্কা’ কিন্তু করছেন বিশেষজ্ঞরা।
চব্বিশ ঘন্টা আগে গোলাপি বলের সম্ভাব্য নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে যে এক ঝাঁক সন্দেহ ছিল, শনিবার এক দিন-রাতের খেলাতেই সেগুলো প্রায় উধাও।
গোলাপি কোকাবুরার চওড়া শক্ত সিম, প্রবল সুইং আর বাউন্স যেমন বোলারদের মুখে হাসি ফোটাতে পারে, তেমনই ব্যাটসম্যানদের দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে তুলতে পারে। ঋদ্ধিমানই যেমন বলছিলেন, ‘‘গোলাপি বলের টেস্ট যদি এমন সবুজ উইকেটে শুরু হয়, তা হলে তা ব্যাটসম্যানদের পক্ষে অবশ্যই চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠতে চলেছে।’’
খেলার বয়স যখন ৫৭ ওভার। তখনও ম্যাচের দুই আম্পায়ারকে টিভিতে বলতে শোনা গেল, ‘‘কী আশ্চর্য, এখনও বলের শেপ, সিম, রঙ কিছুই তেমন বিকৃত হয়নি।’’ এই সময়ের মধ্যে যে বলের উপর কম অত্যাচার হয়েছে, তা বলা যাবে না বোধহয়। একটা ছয় ও চোদ্দটা চার মারা হয়ে গিয়েছে তখন ব্যাটসম্যানদের।
ইডেনের সবুজ উইকেটে পরে বল যখন তুমুল নড়ছে, ব্যাটসম্যানদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। দু-একটা ‘ব্যানানা সুইং’-ও হতে দেখা গেল। ক্লাব হাউসের বক্সে তখন বাংলার ক্যাপ্টেন মনোজ তিওয়ারি। পরে বললেন, ‘‘সূর্য ডোবার পর বল আরও বেশি সুইং করছে দেখছি। মেঘলা আবহাওয়ার জন্য তা হতে পারে। তবে গোলাপি বলের এটাই বৈশিষ্ট। আর বক্স থেকেই যেখানে স্পষ্ট বল দেখা যাচ্ছে বলটা, সামনে থেকে তো আরওই ভাল দেখা যাবে। আমার মনে হয় গোলাপি বল নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। ম্যাচটা না খেলতে পেরে বরং আমার খারাপ লাগছে। যারা খেলছে, ভাগ্যবান।’’
দুটো সেশন হয়ে যাওয়ার পর অনুষ্টুপ মজুমদার বলেন, ‘‘বল দেখতে এমন কিছুই অসুবিধা হচ্ছে না। সাদা বলের চেয়েও ভাল দেখতে পাচ্ছি।’’ দিনের শেষে মোহনবাগান ২৮৬ অলআউট। তার আগে ভবানীপুরের অন্যতম সফল পেস বোলার গীত পুরীকে বলতে শোনা গেল, ‘‘বলটা তো বেশ হাল্কা। সিমটাও বেশ চওড়া। ফলে বোলিং করতেও বেশ সুবিধা হচ্ছে।’’ তাঁর হাত থেকে বল ছুটছিলও তীব্র বেগে।
বৃষ্টিতে ৪১ মিনিট বন্ধ থাকা প্রথম সেশন দেখে রঞ্জিজয়ী বাংলা দলের ক্যাপ্টেন সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘এই বলে খেলতে হলে ব্যাটসম্যানদের টেকনিকে আরও পাকা হতে হবে।’’ সেটাই আজ বোঝা হয়ে গেল।
রবিবার ভারতীয় টেস্ট দলের আর এক সদস্য মহম্মদ শামির গোলাপি বলে পরীক্ষা। ঋদ্ধির মতো হয়তো দেখাবেন গোলাপি বলের আরও নতুন ম্যাজিক। রবিবার সন্ধ্যাটা জমে যেতে পারে তার জন্যই।
তবে শামি বল হাতে তোলার আগেই বোধহয় সবুজ পতাকা দেখে নিল গোলাপি বল।
ছবি: উৎপল সরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy