চিন্তিত ক্যাপ্টেন কোহালির বোর্ড মিটিং। বৃহস্পতিবার রাজকোটে। ছবি: টুইটার।
দুপুর-দুপুর জনৈক ক্রিকেটপ্রেমীর একটা টুইট ভেসে উঠল।
‘টু সেভ দ্য গেম ইন্ডিয়া নিড আ বিগ ড্যাডি হান্ড্রেড ফ্রম ওয়ান অব দ্য টপ ফোর। ইফ দে লুজ দিস ম্যাচ, ইট উইল বি ইংল্যান্ডস্ সিরিজ টু লুজ!’
মর্মার্থ— ভারতকে টেস্ট বাঁচাতে হলে ব্যাটিং লাইন আপের প্রথম চারের কাউকে না কাউকে খেলতে হবে। করতে হবে বড় সেঞ্চুরি। কারণ, রাজকোট টেস্ট হেরে গেলে, সিরিজের রিমোট ইংল্যান্ডের হাতে চলে যাবে। যা করবে, ইংল্যান্ড করবে। ভারতের হাতে কিছু আর থাকবে না। আদতে আবেগপ্রবণ একটা টুইট। যার শেষ অংশটুকু অনায়াসে ঝেড়ে ফেলা যায়। পাঁচ টেস্টের দীর্ঘ সিরিজে একটা টেস্ট ও রকম কিছু ঠিক করে দেয় না। কিন্তু প্রথম অংশটা? তাকে উপেক্ষা করা যায় কি? ওটা তো জলজ্যান্ত সত্যি। আজকের পর রাজকোট টেস্টে প্রত্যাবর্তন ঘটাতে গেলে সত্যিই ভারতের প্রথম চারের কাউকে না কাউকে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। একশো-দেড়শো রানের ইনিংস খেলতে হবে। বিজয় না পারলে গম্ভীর। গম্ভীর না পারলে পূজারা। পূজারা না পারলে বিরাট।
কিন্তু কাউকে না কাউকে কাজটা করতেই হবে।
কেউ কেউ বলতে পারেন, এখনই এত আশঙ্কার কী আছে? ইংল্যান্ড যা পেরেছে, ভারত তা কেন পারবে না? বিশেষ করে রাজকোট পিচে। যা সাধারণত পাটা হয়ে থাকে। রবীন্দ্র জাডেজার ট্রিপল সেঞ্চুরি আছে এখানে। আর বৃহস্পতিবার ভারত যেটুকু খেলেছে, ভাল খেলেছে। স্পিন বোলিং গম্ভীর বরাবর দুর্দান্ত খেলেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটজীবন দু’বছর কারাগারে বন্দি থাকার পরেও দেখা গেল, সেই শিল্পে আজও মরচে ধরেনি। একবার বাদ দিলে মইন আলিকে যথেষ্ট ভাল খেললেন। মুরলী বিজয়— তাঁর ব্যাটিংয়েও অনিশ্চয়তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। তা হলে? এত টেনশন?
আছে, কারণ আছে। প্রথমে ব্যাট করে পাঁচশো তোলা এক জিনিস। আর ঘাড়ে পাঁচশো নিয়ে তা টপকে যাওয়া আর এক। পাটাতেও তা কঠিন প্রশ্নপত্র। চাপটাই তো আলাদা হয়। স্কোরবোর্ডে বিনা উইকেটে একশো তুলেও ব্যাটসম্যান দেখে, টার্গেট বোর্ডে তার পরেও চারশো ঝুলছে। তখন মনঃসংযোগ নষ্ট হয়, সে ভুল করে, নিজেকে ঠেলে দেয় মৃত্যুগুহায়। আর রাজকোট পিচ যে তৃতীয় দিনেও একই রকম নিস্পন্দ থেকে যাবে, গ্যারান্টি কে দেবে? এ দিন বিকেল থেকে একটু টার্ন করা শুরু হয়েছে। ক্রিকেটারদের কথা ধরলে, তৃতীয় দিন থেকে ঠিকঠাক শুরু হবে। এবং মইন আলি-আদিল রশিদ-জাফর আনসারির স্পিন-ট্র্যাঙ্গেলের মধ্যে ভারতের আসল যুদ্ধ শুরু হবে তখনই। তার পর থাকবে বেন স্টোকসের রিভার্স সুইং, যা বর্তমানে বিশ্ব বন্দিত। সবচেয়ে বড় কথা, ভারতকে এ সবই করতে হবে একজন ব্যাটসম্যান কম নিয়ে। বিরাট কোহালি কিন্তু রোহিত শর্মার শূন্যস্থান পূরণ করে এ টেস্টে নামেননি।
অতএব, সহজ নয়।
রবীন্দ্র জাডেজা এ দিন সাংবাদিক সম্মেলনে এসে তীব্র আফসোস করছিলেন টস হারা নিয়ে। বেশ কয়েক বার তাঁকে বলতে শোনা গেল যে, টসটাই ম্যাচ নিয়ে চলে গেল! বললেন বটে, কিন্তু জাডেজার যুক্তিকে খণ্ডন করা যায়। সিরিজের প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডের পাঁচশো তুলে দেওয়ার নেপথ্যে নিষ্প্রাণ রাজকোট সারফেসকে আংশিক কৃতিত্ব দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু কখনওই সম্পূর্ণ নয়। স্টোকসকে কিন্তু চার-চার বার পিচের জন্য ছাড়েনি ভারত। ছেড়েছে কদর্য ফিল্ডিংয়ের নমুনা পেশ করে।
বুধবারও পড়েছিল। কুকের দু’টো। হামিদের একটা। কিন্তু দ্রুত তাঁরা আউটও হয়ে গিয়েছিলেন। ম্যাচে তার প্রভাব মারাত্মক পড়েনি। কিন্তু আসামী একই অপরাধ বারবার করলে, কত বার তার ক্ষমা হয়? ভারতেরও হয়নি। স্টোকসের ক্রিকেটীয়-ধর্ম আদতে সহবাগ-ঘরানার। পিচ-টিচ বোঝার দরকার নেই। নামো আর চালাও। বাংলাদেশে যে টেস্টটা জিতেছিল ইংল্যান্ড, তা জিতিয়েছিলেন এই স্টোকস। সেই স্টোকসকে এ দিন চার বার ছাড়ল ভারত। তিন বার ক্যাচ মিস, একবার স্টাম্পিং! আর চার বারের মধ্যে তিন বার তাঁকে ছাড়লেন কে?
না, ঋদ্ধিমান সাহা!
শুধু ভারতবর্ষের কেন, কেউ কেউ বর্তমানে বিশ্বেরই সেরা কিপার বলে মনে করেন বাংলার ঋদ্ধিমানকে। কিন্তু প্রতিপক্ষের টানা অত্যাচার যে তাঁর মতো কিপারকেও কতটা ত্রস্ত করে দেয়, প্রমাণ পাওয়া গেল এ দিন। ঋদ্ধিমান প্রথম যখন স্টোকসকে ছাড়লেন, ইংরেজ ব্যাটসম্যান তখন ৬০। ক্যাচটা একটু কঠিন ছিল। বাঁ দিকে ঝাঁপিয়েও ঋদ্ধিমান পারলেন না। কিন্তু এক ওভারের পরেরটা? এক কথায়, অভাবনীয়। ক্যাচের হাইট ঠিক ছিল, অতটা ঝাঁপাতেও হয়নি, কিন্তু তবু পরে গেল! স্টোকস তখন ৬১। তৃতীয়টা পড়ল ঠিক সেঞ্চুরির মুখে। নব্বইয়ের ঘরে স্টোকস শটটা খেলেই চোখ বুজে ফেলেছিলেন। খুলে দেখলেন, অহেতুক নিজে ধরতে গিয়ে কী ভাবে বল পর্যন্ত পৌঁছতেই পারলেন না বিরাট কোহালি! আর শেষটা— স্টাম্পিং। যদিও একটু কঠিন ছিল। রবিচন্দ্রন অশ্বিনের বলে। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ইংরেজের সেঞ্চুরি সমাপ্ত ভারতের লাঞ্ছনার পথ আরও প্রশস্ত করে!
স্টোকস শেষ পর্যন্ত থামলেন ১২৮ রানে। প্রাপ্যের চেয়ে ৬৮ বেশি করে। জনি বেয়ারস্টো— তাঁরও দেওয়া একটা ক্যাচ ধরতে সেকেন্ডের ভগ্নাংশ দেরি হয়ে গেল রবীন্দ্র জাডেজার। স্টোকস-বেয়ারস্টো জুটি শেষ পর্যন্ত ৯৯ রান জুড়ল। কিন্তু ওই সব ‘অতিরিক্ত’ রানের চেয়েও ভারতের কাছে কালান্তক হয়ে থাকল ভিন্ন একটা ব্যাপার। রান নয়, স্টোকসদের রান তোলার গতি। ভাবা যায়, দ্বিতীয় দিনের প্রথম সেশনে ইংল্যান্ড কি না ১৩৯ জুড়ে ফেলল! স্কোরবোর্ডে ৩১১ নিয়ে শুরু করে কি না লাঞ্চের মধ্যে ঢুকে পড়ল সাড়ে চারশোয়। ওভার পিছু ৪.৬৩ গড় রেখে, ভারতের জন্য তিন-তিনটে খোলা দিন ছেড়ে! ক্রিকেট ইতিহাস বলছে, সফররত টিমের এক ইনিংসে তিন ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরির মতো নারকীয় ঘটনায় ভারত শেষ আক্রান্ত হয়েছে আজ থেকে সাত বছর আগে। রাজকোট থেকে আড়াইশো কিলোমিটার দূরের মোতেরায়। কিন্তু অপমানের নুন-ছিটে বোধহয় আজকেরটায় বেশি। কারণ, সে দিন টিমটার নাম শ্রীলঙ্কা ছিল। যারা উপমহাদেশের টিম, পরিবেশ জানে-চেনে। কিন্তু ইংল্যান্ড এ দেশে তো ঢুকেছে বাংলাদেশের কাছে এক সেশনে দশ উইকেট হারিয়ে। সেখানে জো রুট সেঞ্চুরি। মইন আলি সেঞ্চুরি। বেন স্টোকস সেঞ্চুরি। উইকেট যতই পাটা হোক, অহংয়ে এটা মারাত্মক আঘাত তো বটেই। পরে আরও একটা পরিসংখ্যান বেরোল। ভারতে আজ পর্যন্ত কেউ পাঁচশো তুলে নাকি হারেনি। অর্থ জলবত্-তরলং। ইতিহাসগত ভাবে রাজকোট টেস্ট কোহালি বড়জোর বাঁচাতে পারেন। কিন্তু জিততে পারবেন না।
সব দেখলে-শুনলে তাই বড় খারাপ লাগে। কোন আশাবাদ নিয়ে শুরু হয়েছিল রাজকোট টেস্ট, আর দু’দিনের মধ্যে তা কোথায় দাঁড়িয়েছে। টেস্ট জয়ের স্বপ্নের ফুল এখন শুকিয়ে ভারতের সামনে দুশ্চিন্তার কাঁটা বেশি। তৃতীয় দিনে ভাল না করা ছাড়া গতি নেই, নইলে নামতে হবে পঞ্চম দিনের পিচে, হার বাঁচাতে। বড় অলীক লাগে তাই দু’দিন আগে প্রাক্-যুদ্ধ সাংবাদিক সম্মেলনে বিরাট কোহালিকে ভারতীয় সাংবাদিকের করা অদ্ভুত প্রশ্নটা।
ক্যাপ্টেন, কত দিন লাগবে টেস্ট শেষ করতে? পুরো পাঁচ, নাকি আরও কম!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy