Advertisement
০২ মে ২০২৪

মুম্বই ঘরানার হয়েও কিছুটা ব্যতিক্রম পৃথ্বী

সাধারণত আমরা দেখি, সিনিয়র ওপেনারই ইনিংসের শুরুতে স্ট্রাইক নেয়। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার পৃথ্বীকে দেখে মনে হচ্ছিল, আত্মবিশ্বাসে টগবগ করছে।

হুঙ্কার: পেরেছি আমি। সেঞ্চুরিতে পৌঁছে পৃথ্বীর লাফ। বৃহস্পতিবার রাজকোটে, টেস্টের প্রথম দিনে। এপি

হুঙ্কার: পেরেছি আমি। সেঞ্চুরিতে পৌঁছে পৃথ্বীর লাফ। বৃহস্পতিবার রাজকোটে, টেস্টের প্রথম দিনে। এপি

সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৮ ০৩:৩২
Share: Save:

ভারতের ইনিংসের শুরুতেই একটা ব্যাপার দেখে অবাক হয়েছিলাম। নন স্ট্রাইকার এন্ডে যাচ্ছে কে এল রাহুল। আর স্ট্রাইক নিতে চলেছে জীবনের প্রথম টেস্ট খেলতে নামা পৃথ্বী শ!

সাধারণত আমরা দেখি, সিনিয়র ওপেনারই ইনিংসের শুরুতে স্ট্রাইক নেয়। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার পৃথ্বীকে দেখে মনে হচ্ছিল, আত্মবিশ্বাসে টগবগ করছে। শ্যানন গ্যাব্রিয়েলের প্রথম ওভারের দ্বিতীয় বলেই যখন ব্যাকফুটে কভার আর পয়েন্টের মধ্যে দিয়ে ঠেলে তিনটে রান নিয়ে নিল, মনে হচ্ছিল, এই ছেলে যেন পঞ্চাশ টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে নেমেছে। আপনি যদি কখনও মুম্বইয়ের শিবাজি পার্কের দিকে যান, তা হলে দেখবেন, একটা বড় মাঠে একসঙ্গে গোটা চারেক ক্রিকেট ম্যাচ চলছে। যেখানে একটা ম্যাচের ডিপ ফাইন লেগ অন্য ম্যাচের থার্ডম্যানের সঙ্গে গল্পও করতে পারে। কিন্তু প্রতিটা ম্যাচে একটা বৈশিষ্ট্য চোখে পড়বে। খুব ভাল একটা পিচ। মুম্বইয়ে লাল মাটি হওয়ার ফলে সুন্দর বাউন্স থাকে, ব্যাটে ভাল বল আসে। যে কারণে মুম্বই ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানরা প্রচুর রান করতে পারে। ছোট থেকেই ভাল স্ট্রোক খেলা শিখে যায়। মুম্বই ক্রিকেট ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যাবে, ওখান থেকে বেশির ভাগ ব্যাটসম্যানই বেরিয়েছে। যেমন, সুনীল গাওস্কর, দিলীপ বেঙ্গসরকর, রবি শাস্ত্রী, সঞ্জয় মঞ্জরেকর, সচিন তেন্ডুলকর। এ বার এই তালিকায় ঢুকে পড়ল পৃথ্বীও।

মুম্বই ঘরানা বলতে আমরা কী বুঝি? শুধুই যে ক্লাসিকাল, কপিবুক ব্যাটিং, তা কিন্তু নয়। সঙ্গে থাকে একটা ইস্পাত কঠিন মানসিকতা। যে মানসিকতাকে মুম্বইকররা বলে ‘খরুশ’। পৃথ্বীর মানসিকতাও এই তালিকাভুক্ত। যে ছেলে কাকভোরে উঠে বিরার থেকে ভিড় ট্রেন ঠেঙিয়ে বান্দ্রা আসত প্র্যাক্টিস করবে বলে, তার মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার জায়গা নেই। এই ছেলে হারতে জানে না। ঠিক ওর পূর্বসূরিদের মতো।

কিন্তু মুম্বই ঘরানার হয়েও কোথায় যেন একটু ব্যতিক্রম পৃথ্বী। আমি যাঁদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলেছি, সেই গাওস্কর, বেঙ্গসরকরদের মধ্যে একটা জিনিস দেখতাম। প্রথম দিকে অফস্টাম্পের বাইরের বলে ব্যাট দেব না। বলের গন্ধ শুঁকে ছেড়ে দেব। প্রথম এক ঘণ্টা বোলারের, বাকিটা আমার। গাওস্করের একটা ইনিংসের কথা আমার মনে আছে। ১৯৮১ সালে বাংলার বিরুদ্ধে ৩৪০ রান করেছিলেন। প্রায় আড়াই দিন ধরে ব্যাট করে। প্রথম দিকে বোলারদের সম্মান দিয়েছিলেন, পরে শাসন করেছিলেন।

কিন্তু এই আঠারো বছরের পৃথ্বী প্রথম ওভারেই যে শটটা খেলল, তাতে পরিষ্কার, ও শুরু থেকেই বোলারদের শাসন করতে চায়। এগারো নম্বর ওভারে দেবেন্দ্র বিশুকে মিড অনের ওপর দিয়ে ওয়ান ড্রপ শটে বাউন্ডারি পেল। এই ঘরানাটা আমি বলব, বীরেন্দ্র সহবাগ ঘরানা। টেস্ট ক্রিকেটে ওপেনিংয়ের সংজ্ঞাটাই বদলে দিয়েছে বীরু। যার প্রভাব পড়েছে এই নতুন প্রজন্মের ওপর। না হলে মুম্বইয়ের কোনও ওপেনার টেস্টে এ রকম খেলছে ভাবাই যায় না। আমি এখানে সচিনের ওয়ান ডে ব্যাটিংয়ের কথা আনছি না।

জীবনের প্রথম টেস্ট খেলতে নেমে পৃথ্বী যে সব শট নিয়েছে, তা ভাবা যায় না। এমনিতে রাজকোটের এই মাঠটা ওর প্রিয়। রঞ্জি অভিষেকে এখানেই তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করেছিল। এ বার টেস্টেও পেল। পছন্দের মাঠে যেন আরও মনখোলা ব্যাট করল। ৯৯ বলে সেঞ্চুরিতেই বোঝা যাচ্ছে কতটা সাবলীল ছিল। ভারত যে প্রথম দিনই চার উইকেটে ৩৬৪ রান তুলে ফেলল, চারের ওপরে রান রেট রেখে, তার কারিগর কিন্তু পৃথ্বীই। এখন বিরাট কোহালি এই রানটাকে এভারেস্টে পৌঁছে দেন কি না, সেটাই দেখার। এমনিতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোনও বোলার দাগ কাটতে পারেনি টেস্টের প্রথম দিনে। দ্বিতীয় দিন বিরাট আর ঋষভ পন্থের ব্যাট চললে আর দেখতে হবে না।

পৃথ্বী একটু হাই ব্যাকলিফ্টে খেলে। স্টান্স নেওয়ার সময় ব্যাটটা একটু উঁচুতে তোলা থাকে। তা ছাড়া ব্যাকফুটেও খুব শক্তিশালী। যেটা সাধারণত অধিকাংশ মুম্বই ব্যাটসম্যানের মধ্যে দেখা যায় না। গাওস্কর, বেঙ্গসরকররা— সবাই সামনের পায়ে এগিয়ে এসেই শট খেলা পছন্দ করতেন। এখানেও ব্যতিক্রম পৃথ্বী। আরও একটা ব্যাপার দেখলাম। পৃথ্বীর পিছনের পা কিন্তু লেগ স্টাম্প বা লেগ স্টাম্পের বাইরে চলে যাচ্ছে। যেটা ব্যাকরণসম্মত নয়। কিন্তু তাতেও ওর স্ট্রোক খেলায় সমস্যা হয়নি। এই জন্যই মনে হচ্ছে, পৃথ্বীকে কোনও কোচ তৈরি করেনি। ও ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা।

মুম্বই ক্রিকেটের একটা বড় গুণ হল, ওরা কোনও ব্যাটসম্যানের স্বাভাবিক টেকনিকটা বদলায় না। যেমন গ্রিপ নেওয়ার সময় সচিনের ডান হাতটা ব্যাটের হ্যান্ডলের অনেক নীচের দিকে থাকত। কোনও কোচ সেটা বদলায়নি। পৃথ্বীর ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে। কলকাতা-সহ দেশের অনেক জায়গায় কিন্তু এ রকমটা হয় না। এ ছাড়া মুম্বই ক্রিকেটারদের সাহায্য করার জন্য অনেকেই এগিয়ে আসে। পৃথ্বীকে যেমন নীলেশ কুলকার্নির সংস্থা টাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল খুব কম বয়সে। পরে অন্যান্য সাহায্যও পেয়েছিল। আমাদের এখানে কর্পোরেট সংস্থাগুলো এখনও জুনিয়র ক্রিকেটে সে ভাবে নজর দেয়নি।

টেকনিক্যালি প্রায় নিখুঁত। সুইপ ছাড়া দেখলাম প্রায় সব শটই খেলল। ব্যাকফুটে খুব শক্তিশালী। মানসিকতায় একশোয় একশো দিতেই হবে। এই হল চুম্বকে পৃথ্বী-প্যাকেজ। এ বার শুধু একটা জিনিস দেখতে চাই। ৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে কী রকম খেলে পৃথ্বী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE