রোহন গাওস্কর যখন আরবসাগরের মায়া কাটিয়ে গঙ্গার ধারে ইডেন গার্ডেন্সে তাঁর রঞ্জি ট্রফির আস্তানা গাড়েন। তখন ১৯৯৫। সেই সময় বলা হয়েছিল, বাংলা ক্রিকেটের সর্বকালীন সেরা বিজ্ঞাপন হয়ে গেল যে স্বয়ং সুনীল গাওস্করের ছেলে মুম্বইয়ের হয়ে রঞ্জি ট্রফি না খেলে বাংলাতে আসছে। কে জানত দু’হাজার ষোলোর শেষে আরও বড় চমক অপেক্ষা করে রয়েছে। কোনও বাঙালি ছেলে মুম্বইয়ের হয়ে খেলার সুযোগ পাবে তাও কি না মাত্র সতেরো বছর বয়সে। আর সরাসরি রঞ্জি ট্রফির সেমিফাইনালে!
ছেলেটির নাম পৃথ্বী সাউ। বাবা- ঠাকুরদারা থাকতেন ধর্মতলা স্ট্রিটের কাছে। পৃথ্বীর জন্মের বেশ কয়েক বছর আগে বাবা চলে যান মুম্বইয়ে। পৃথ্বী বাংলা লিখতে-পড়তে পারেন না। কিন্তু মুম্বই ক্রিকেটমহলে এই খুদে বিস্ময়কে বাঙালি ক্রিকেটার হিসেবেই চেনে। যে ভাবে রঞ্জি সেমিফাইনালে শক্তিশালী তামিলনাড়ুর বিরুদ্ধে পৃথ্বীকে দলে নেওযা হল তা দেখে অনেকের সচিন তেন্ডুলকরের স্মৃতি মনে পড়ছে।
সচিন অবশ্য ঢুকেছিলেন পনেরো বছর বয়সে। পৃথ্বী ঢুকলেন সতেরোতে। অবসরের পর এত ব্যস্ত হয়ে গিয়েছেন সচিন যে মুম্বইয়ে অনেক কম থাকেন। পৃথ্বীর সঙ্গে ইদানীং দেখা সাক্ষাৎ অনেক কম। যখনই দেখা হয়েছে প্রচুর উৎসাহ দিয়েছেন। সঙ্গে টিপসও।
বছর পাঁচেক আগে আনন্দবাজার প্রতিবেদককে তেন্ডুলকর বলেছিলেন, ‘‘বিশাল সম্ভাবনা। কিন্তু এখুনি পৃথ্বীকে নিয়ে বেশি কিছু লিখবেন না। মিডিয়ার মনোযোগ ওর ক্ষতি করতে পারে।’’ পার্টনারশিপে সচিনের যাঁর সঙ্গে টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি রান, সেই রাহুল দ্রাবিড়ও দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছেন পৃথ্বীকে। ভারতের যে অনূর্ধ্ব-১৯ দল এশিয়া কাপ জিতল তার অন্যতম সদস্য ছিলেন পৃথ্বী। পাঁচ ইনিংস মিলিয়ে রান করেছেন ১৯১। যা তাঁর ইদানীং রানের পাশে কিছুই নয়। তবুও স্যর রাহুলকে খুব আকৃষ্ট করেছে।
পৃথ্বীর মাত্র দু’বছর বয়সে তাঁর মা মারা যান। তাঁর বাবা একইসঙ্গে রমেশ ও অজিত তেন্ডুলকরের ভূমিকা পালন করেছেন। অথচ সিনিয়র সাউ বর্তমানে কর্মহীন। পৃথ্বীর ক্রিকেট চালানোই সম্ভব ছিল না যদি না মাত্র তাঁর দশ বছর বয়সে থেকে পৃথ্বীর মোটা টাকার স্পনসরশিপের ব্যবস্থা করে না দিতেন এক ক্রিকেট সাংবাদিক।
পৃথ্বী আগে যেখানে থাকতেন সেখান থেকে আড়াই ঘণ্টা আসতে হত প্র্যাকটিস করতে। মুম্বই ক্রিকেটমহলের স্নেহশীল অভিভাবকরা তাই ছেলেটির থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন সান্তা ক্রুজে।
সচিনের সঙ্গে অদ্ভূতরকম মিল। এই সতেরো বছর বয়সেও ক্রিকেটই ধ্রুবতারা। মোবাইল ব্যবহার করেন না। ওটা বাবার কাছে থাকে। সাক্ষাৎকারও দেন না। এমনকী সিনেমা দেখারও সময় নেই। বছর পাঁচেক আগে মুম্বইয়ের তিন প্রতিশ্রুতিমান ক্রিকেটারকে শাহরুখ খানের বাড়িতে পাঠানো হয়েছিল। শাহরুখ নিজেই এদের সঙ্গে দেখা করে উৎসাহ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শোনা যায়, পৃথ্বী সে রকম কিছু বলতে পারেননি। কারণ শাহরুখের কোনও ফিল্ম তখনও দেখেননি।
বুধবার রাতে মুম্বইয়ে ফোনে যোগাযোগ করলে পৃথ্বীর প্রথম কোচ প্রশান্ত শেট্টি বললেন, ‘‘যে পরিমান রান ও গত কয়েক মাসে করেছে তাতে ওকে ঠেকিয়ে রাখা নির্বাচকদের পক্ষে কঠিন ছিল।’’ নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান মিলিন্দ রেগে ঘরোয়া আড্ডায় বলেছেন, সেমিফাইনালের চূড়ান্ত এগারোর ক্যাপ্টেন আর কোচ বাছবেন, কিন্তু পৃথ্বীর খেলায় তিনি খুব সন্তুষ্ট।
রাজকোটের শক্তিশালী তামিলনাড়ুর সঙ্গে এই ম্যাচ মুম্বই ক্রিকেট খুব বড় করে দেখছে। রাজকোটের উইকেট এ বার মোটেও চিরাচরিত ব্যাটিং সারফেস নয়। বরঞ্চ ঘাসে মোড়া। সেমিফাইনালে পৃথ্বীর দিকে মুম্বই ক্রিকেট আরও বেশি করে তাকিয়ে আছে কারণ পরবর্তী প্রজন্মের মুম্বই ক্রিকেটে মশালবাহী তিনজনের মধ্যে বাকি দু’জন আপাতত অন্ধকারে।
আর্মান জাফার গত পাঁচ ম্যাচে মাত্র ৪৪ রান করেছেন। সরফরাজ খান আন্তঃরাজ্য ছাড়পত্র নিয়ে চলে গিয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশে। সেই টিম থেকেও বাদ পড়েছেন। এ বার বঙ্গসন্তান সেমিফাইনালে কী করেন, ক্রিকেট ভারত আগ্রহের সঙ্গে দেখবে।