Advertisement
০৬ মে ২০২৪
বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ভারতীয় টিম ডিরেক্টর

অভিশপ্ত সিঁড়িতে পৌঁছে স্তব্ধ হয়ে গেলেন শাস্ত্রী

ছিমছাম, অনিন্দ্যসুন্দর পবিত্র বাড়িটার সিঁড়িতে পড়ে থাকা গোলাপ পাপড়িগুলোর বয়স বোধ হয় একই থেকে গিয়েছে। আজও এত জীবন্ত লাগে! ধাপ-ধাপ সিঁড়ি নেমে গিয়েছে একের পর এক। মাঝামাঝি জায়গায় একটা ছবি ঝুলছে। গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি পড়ে আছেন, তারই প্রতিমূর্তি।

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে শ্রদ্ধা-বার্তা রবি শাস্ত্রীর। পাশে ভারতীয় টিম ম্যানেজার বিশ্বরূপ দে। সোমবার।—নিজস্ব চিত্র

বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে শ্রদ্ধা-বার্তা রবি শাস্ত্রীর। পাশে ভারতীয় টিম ম্যানেজার বিশ্বরূপ দে। সোমবার।—নিজস্ব চিত্র

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
ঢাকা শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৫ ০৩:১৮
Share: Save:

ছিমছাম, অনিন্দ্যসুন্দর পবিত্র বাড়িটার সিঁড়িতে পড়ে থাকা গোলাপ পাপড়িগুলোর বয়স বোধ হয় একই থেকে গিয়েছে। আজও এত জীবন্ত লাগে! ধাপ-ধাপ সিঁড়ি নেমে গিয়েছে একের পর এক। মাঝামাঝি জায়গায় একটা ছবি ঝুলছে। গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি পড়ে আছেন, তারই প্রতিমূর্তি। দেওয়ালের এক দিক থেকে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নামতে নামতে প্রায় সিঁড়ি ছুঁয়েছে। শ্রদ্ধার আলতো হাত রাখছে পড়ে থাকা গোলাপ পাপড়িতে।
শেখ মুজিবুর রহমানকে এখানেই গুলি করা হয়েছিল না? এই সিঁড়িতে? বন্দুকবাজদের হাত দু’বার কাঁপেনি সে দিন। মন বিচলিত হয়নি এতটুকু।
সেই সিঁড়ির এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে যে দীর্ঘদেহী, গমগমে গলা আর স্পষ্টবক্তা হিসেবে ভারত বিখ্যাত। কিন্তু আজ কিছু একটা যেন ভারতীয় ক্রিকেটের এই প্রখর ব্যক্তিত্বকেও নিশ্চুপ করিয়ে দিয়েছে। নিশ্চল দাঁড়িয়ে সিঁড়ির মুখটায়। চোখ নড়ছে না। মাথা উঠছে না। কানে যেন ঢুকছে না জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কথা।
রবি শাস্ত্রী স্তব্ধ।
রবি শাস্ত্রী নির্বাক।
রবি শাস্ত্রী এখন ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে দাঁড়িয়ে আছেন।

মাঝেমধ্যে শিউরে উঠছেন বঙ্গবন্ধুর অন্তিম পরিণতির মর্মস্পর্শী কাহিনি শুনে। অস্ফুটে বলে ফেলছেন, “এটা কী ভাবে কারও সঙ্গে ঘটতে পারে...!” জানতে চাইছিলেন, ঘটনাটা ঠিক কী ঘটেছিল? কখন ঘটেছিল? এক বার অস্থির হয়ে পাশে দাঁড়ানো ভরত অরুণকে ডেকে নিলেন দ্রুত। দেখালেন দেওয়ালের গায়ে বুলেটের দাগ। সেই অভিশপ্ত ঘরের দেওয়াল, যেখানে একই দিনে আক্রান্ত হতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অধিকাংশকে। চলে গিয়েছিল বেশ কিছু প্রাণ। ঘুরতে ঘুরতে আরও একটা ঘর। মুজিবুরের পুত্রবধূর শাড়ি রাখা ওখানে। রক্তের দাগ চল্লিশ বছর পরেও লেগে। শাস্ত্রী এ বার আর কাউকে ডাকতেও পারলেন না। বাংলার বিখ্যাত জননায়কের ছবিতে ফুল দেওয়ার সময় এল, প্রণামের হাত চলে গেল আপনাআপনি। মেসেজ বুকে বার্তা রেখে যাওয়ার অনুরোধে কলম চলতে লাগল নিঃশব্দে।

‘আমি প্রথম বার এখানে এলাম। ফিরে যাচ্ছি অসাধারণ অভিজ্ঞতা নিয়ে। বুঝতে পারলাম কেন ওঁকে সব সময় এক মহত্‌ মানুষ বলা হয়। এখানকার সব কিছু আমার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশে যাঁরা আসবেন, তাঁরা অবশ্যই এক বার আসবেন এখানে।’

মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো লাইন। আবেগের বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে লিখে ফেলা কিছু কথা। সবই হৃদয়-নিঃসৃত। যে আবেগ বাইশ গজের দুনিয়া থেকে তার এক অন্যতম সেরা চরিত্রকে টেনে বার করে দাঁড় করিয়ে দেয় এক অচেনা বৃত্তে। এক অচেনা জীবনের উঠোনে।

যে উঠোনে পুরনো সে দিনের পায়রাঘর আছে। ইংলিশ উইলো নেই।

যে উঠোনে সাবেক বাংলার গোয়ালঘর আছে। ঝাঁ-চকচকে টিম ইন্ডিয়া ড্রেসিংরুম নেই।

প্রথমে ঠিক ছিল, ভারতীয় টিমের ম্যানেজার বিশ্বরূপ দে-র সঙ্গে ডিরেক্টর শাস্ত্রী শুধু আসবেন। সকাল সওয়া এগারোটা নাগাদ দেখা গেল, গাড়ি থেকে আরও তিন জন নামছেন। ভরত অরুণ, সঞ্জয় বাঙ্গার এবং শ্রীধর। ভারতের পুরো সাপোর্ট স্টাফ টিম। আশেপাশে তখন একটাও ক্যামেরা নেই মুহূর্তকে আজীবনের জন্য বন্দি করে ফেলার।

কেউ এক জন শাস্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, আপনি কি পুরোটাই ঘুরে দেখবেন? নাকি কয়েকটা নির্বাচিত অংশ? ঝটিতি উত্তর দিলেন, “পুরোটা।” ছ’ফুটের টি-শার্ট পরিহিত তিপান্নর টিম ডিরেক্টর ততক্ষণে তেইশের যুবক। বাংলার চলমান ইতিহাসের বাসস্থানে পৌঁছে নিজেকে বদলে ফেলতে চাইছেন ইতিহাসের মনোযোগী ছাত্রে। টিভিতে মুজিবুরের বক্তৃতা একমনে শুনছেন। চলে যাচ্ছেন বিখ্যাত বারান্দায়, যেখানে দাঁড়িয়ে নাকি একটা সময় বক্তৃতা থেকে দেশবাসীর সঙ্গে সংযোগস্থাপন— সবই করতেন শেখ মুজিব। কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে মুজিবুরের বক্তৃতার ছবি দেখতে দেখতে ঘনিষ্ঠকে বলে ফেললেন, কলকাতার সঙ্গে ওঁর বরাবরই সম্পর্ক ভাল ছিল, না? মহাত্মা গাঁধীর সঙ্গে এক ফ্রেমে বঙ্গবন্ধুকে দেখে আবার মনে পড়ে গেল, কলকাতার এলগিন রোডে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু মিউজিয়ামেও একই ছবি তিনি দেখেছেন। পরিবেশ মৃদু হাল্কা করা মন্তব্যও একটা পাওয়া গেল। ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে মুজিবুরের ছবিটা যখন দেখলেন। শাস্ত্রী এ বার বলে ফেললেন, “এক জন সিগার। এক জন পাইপ। দু’জনে ভাল জমত নিশ্চয়ই!”

মনখারাপের মেঘলা আকাশ তাতে কিছুটা কাটে, কিন্তু রোদের তেজ পুরো বেরোয় না। বরং ওখান থেকে বেরিয়ে গুলশনে কেনাকাটা করতে যাওয়ার সময় শাস্ত্রী খুঁজে পেয়েছেন ভারত-বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মিল। বলে ফেলেছেন, এত অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা নাকি তাঁর আর কখনও হয়নি। সম্ভবও নয়। পরিচয়ে আপনি বাঙালি হোন বা অবাঙালি, ওই বাড়ি, সামনের সবুজ, ভিতরের বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত দেখলে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়াই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক না থাকাই স্বাভাবিক।

বাংলাদেশ বলে, বত্রিশ নম্বর ধানমণ্ডি তার আত্মার ঠিকানা।

বাংলাদেশ শুধু বলে না, বত্রিশ নম্বর ধানমণ্ডি তার চিরকালীন দুঃখেরও ঠিকানা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE