Advertisement
০৪ মে ২০২৪

রোহিত কম্পনে ইডেনে ভেঙে পড়ল নাইট দুর্গ

আইপিএল সত্যি বড় নির্মম। ক্রিকেট যদি মহান অনিশ্চয়তার খেলা হয়, নিঃসন্দেহে এ তার সেরা প্রামাণ্য নথি। কবে কে ঘি দিয়ে ভাত খেয়েছে, কবে কাকে মহাবলশালী দেখিয়েছে, ক্রিকেটের এই ফর্ম্যাটে তা শুধু মূল্যহীন নয়।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:২৪
Share: Save:

কলকাতা নাইটরাইডার্স ১৮৭-৫
মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ১৮৮-৪ (১৯.১ ওভারে)

আইপিএল সত্যি বড় নির্মম। ক্রিকেট যদি মহান অনিশ্চয়তার খেলা হয়, নিঃসন্দেহে এ তার সেরা প্রামাণ্য নথি। কবে কে ঘি দিয়ে ভাত খেয়েছে, কবে কাকে মহাবলশালী দেখিয়েছে, ক্রিকেটের এই ফর্ম্যাটে তা শুধু মূল্যহীন নয়। অবান্তর। সাত দিন আগে যাকে যে ফর্ম্যাট বিশ্বজয়ের মধুচন্দ্রিমা উপহার দেবে, সাত দিন পর একই মাঠে তাকে নিঃস্ব করে ছেড়ে দিতে পারে।

আন্দ্রে রাসেল যেমন। এপ্রিলের প্রথম রবিবারে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের সোনার দিনে ‘ক্লাউড নাইনে’ বিচরণ করছিলেন। আইপিএল উদ্বোধনীতেও মেগাহিট। অথচ আজ, দিল্লি ডেয়ারডেভিলস ম্যাচের তিন দিনের মধ্যে তাঁকেই সবচেয়ে হতমান, সবচেয়ে শোকের মূর্ত প্রতীক দেখাচ্ছে। রোহিত শর্মার শেষ বাউন্ডারিটা যখন কেকেআরের আশাবাদের শেষ প্রদীপটাও নিভিয়ে দিল, তীব্র হতাশাবিদ্ধ ক্যারিবিয়ানকে দেখা গেল পিচের উপর বসে পড়তে। মাথায় হাত, বিধ্বস্ত দৃষ্টি। স্বাভাবিক। যে রাসেলের হাতে বল তুলে দিয়ে দিল্লি ডেয়ারডেভিলস ম্যাচ বার করে নিয়েছেন গম্ভীর, সেই একই লোক আজ দিয়েছেন ৪ ওভারে ৫২!

আবার রোহিত শর্মাকে দেখুন। দু’দিন আগে পর্যন্ত লোকটাকে টি-টোয়েন্টির সবচেয়ে মূমূর্ষ প্রতিভূ দেখিয়েছে। গোটা বিশ্বকাপে স্রেফ সেমিফাইনাল বাদ দিলে একটা ম্যাচেও রান পাননি। তার উপর ওয়াংখেড়েতে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির পুণের কাছে স্রেফ উড়ে যেতে হয়েছে। অথচ দু’দিনের মধ্যে সেই একই লোক পুরস্কার-বিতরণী মঞ্চে উঠছেন, ম্যাচ সেরার স্মারক নিতে।

অবশ্য কেকেআর যে বুধবার রাতের ইডেনকে শোকস্তব্ধ করে দিয়ে চলে গেল, তার এক এবং একমাত্র কারণ মরাঠির ভাগ্য পরিবর্তন নয়। ইডেনে ম্যাচ পড়লে এবং সেখানে রোহিত শর্মা নামে কেউ খেললে, শিরোনাম যে কাকে দিয়ে করতে হবে তা আজ আর আলাদা করে বলার দরকার পড়ে না। সেই রঞ্জি অভিষেক থেকে তো চলছে। টেস্ট অভিষেকে সেঞ্চুরি। ওয়ান ডে-তে ২৬৪ রানের বিশ্বরেকর্ড। আইপিএল সেঞ্চুরি। কেকেআরের বিরুদ্ধে বুধবার যখন আরও একটা অসাধারণ শিল্পের ইনিংস খেলছেন রোহিত, নাইটদের হাত থেকে একটু-একটু করে নিয়ে যাচ্ছেন ম্যাচ, একটা স্ট্যাটস চোখে পড়ল। ইডেনে রোহিতের মুম্বই জার্সিতে নামা সাত বার। রান ৩৮৭। ইডেন আর রোহিতের ‘প্রেমপর্ব’ যে ভাবে দিনের পর দিন দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তাতে ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া’-কে গত দু’ দশেকর সেরা রোম্যান্টিক সিনেমা বলা যাবে কি না সন্দেহ!

ম্যাকক্লেনাঘানের ম্যাচ ঘোরানো তিনটে ছয়ের একটা। ছবি উৎপল সরকার, বিসিসিআই

তবু রোহিত একা নন। বরং কেকেআর যে ১৮৭ তুলেও প্রায় এক ওভার বাকি থাকতে ম্যাচ হেরে গেল, তার ময়নাতদন্তে নামলে প্রভাব বিচারে সর্বপ্রথম নাম আসবে এক অস্ট্রেলীয়র। ম্যাচ শেষে গম্ভীর বলছিলেন, “আমাদের নিয়মিত উইকেট তুলতে হত। কিন্তু সেটাই হল না। বল হাতে আমাদের শুরুটাই ভাল হল না।” কেকেআর অধিনায়ক কোথাও রিকি পন্টিংয়ের নাম করলেন না। কিন্তু তিনি না বললেও এটা ঘটনা যে, পন্টিংয়ের মোক্ষম ধূর্ততায় নাইট প্ল্যানিং এ দিন পুরো এফোঁড়-ও ফোঁড় হয়ে গেল।

মুম্বই ইনিংস তখন মধ্যভাগে। হার্দিক পাণ্ড্য আউট হয়ে গিয়েছেন। রোহিত উইকেটে থাকলেও আস্কিং রেটকে টেনে নামাতে পারছেন না। বরং কেকেআরের দুই চায়নাম্যান নিয়মিত ডট করে-করে ম্যাচকে আবার কেকেআরের দিকে নিয়ে আসছেন। আচমকাই এ সময় দেখা গেল, রোহিতের পার্টনার হিসেবে জস বাটলার বা কায়রন পোলার্ড নন, মিচেল ম্যাকক্লেনাঘান আসছেন! যিনি কি না আদতে পেসার। আসলে তখন দু’দিক থেকে স্পিনার দিয়ে করাচ্ছিল কেকেআর। এবং কেন মিচেল, কোন যুক্তিতে মিচেল, অতশত কাটাছেঁড়া করার আগেই দেখা গেল, চারটে বলের মধ্যে তিনটে উড়ে পড়েছে গ্যালারিতে!

৮ বলে ২০ করে গেলেন মিচেল। কিন্তু গেলেন নতুন এক চর্চার জন্ম দিয়ে যে, আইপিএলে পন্টিং নতুন এক ক্রিকেট-দর্শনের খোঁজ দিয়ে গেলেন কি না। যে দর্শন বলে, আস্কিং রেট বাড়তে থাকলে সেরা ব্যাটসম্যানকে ঠেলে দিতে হবে মানে নেই। বরং পিঞ্চ হিটার পাঠিয়ে সেটাকে নামিয়ে সেরাদের রাখো শেষ কাজটুকুর জন্য। কেকেআর বোলিং তার পর থেকে এমন কাঁপতে থাকল যে দেখলে মনে হবে, সন্ধে সওয়া সাতটার ভূকম্পন আবার ফিরে এসেছে বোধহয়। মিচেল গেলেন, বাটলার নামলেন এবং এক-এক ওভার থেকে সতেরো-আঠারো করে বেরোতে থাকল।

নাইটরা এ দিন কিছু ভুলও করেছে। যেমন সুনীল নারিনকে খেলিয়ে দেওয়া যেত। ক্যারিবিয়ান স্পিনার গত রাতে টিমের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু টিম তাঁকে নামাল না। রাতে সাংবাদিক সম্মেলনে এসে মণীশ পাণ্ডে বলে গেলেন, “অত ট্র্যাভেল করে নারাইন গত রাতেই এসেছে। টায়ার্ড ছিল। আমরা চেয়েছিলাম, ওকে বিশ্রাম দিয়ে পরের ম্যাচে নামাতে। যাতে অনেক তাজা ভাবে নামতে পারে।” কিন্তু সেটা তো দিল্লি ম্যাচের আগে রাসেলও এসেছিলেন। তাঁকে খেলিয়ে গম্ভীর ম্যাচও বার করে নিয়েছিলেন। কে বলতে পারে, কেকেআর এ দিন নারিনকে খেলিয়ে দিলে জয়ী তাজ পরে মাঠ ছেড়ে বেরোত না? আসলে অ্যাকশন শুধরে হোক, অ্যাকশন পাল্টে হোক, নামমাহাত্ম্যে নারিন আজও নারিন। শেষ ৬ ওভারে ৬৬ দরকার এই অবস্থায় সামনে একটা নারিন থাকলে জেতা অত সহজ হত না রোহিতদের। আরও একটা ব্যাপার— ফিল্ডিং। সাধারণত এমন রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে ফিল্ডিং খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। একটা বাউন্ডারি, একটা ওভার থ্রো ম্যাচ শেষ করে দিতে পারে। কেকেআরে এ দিন দু’টোই হয়েছে। বিশেষ করে শেষ দিকে ইউসুফ পাঠান যেটা ছাড়লেন। চ্যাম্পিয়ন টিম কিন্তু এত ভুল করে না।

অতঃকিম?

আইপিএলে ইতিহাসগত ভাবে যে ম্যাচটা সবচেয়ে নাটকীয়, সবচেয়ে রোমাঞ্চকর হয় কেকেআরের এ বার সেটা জেতা হল না। রোহিত শর্মার রাজকীয় ইনিংস ইডেন দেখল, কিন্তু বিয়োগান্ত পটভূমিতে। সব মিলিয়ে, নববর্ষের শুরুটা কেকেআর বা শহরের শুভ হল না। টেনশনের কারণ আরও একটা আছে। রাত বারোটার ইডেন স্কোরবোর্ড যা দেখাচ্ছিল।

ঘরের মাঠে ফিরতে-ফিরতে নাইটদের সেই ৪ মে। তার আগে সব অ্যাওয়ে ম্যাচ। এক নয়, দুই নয়, একসঙ্গে ছ’টা!

সংক্ষিপ্ত স্কোর: কলকাতা নাইট রাইডার্স ১৮৭-৫ (গম্ভীর ৬৪, মণীশ ৫২), মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ১৮৮-৪ (রোহিত ৮৪ ন.আ., বাটলার ৪১)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rohit Sharma IPL 2016 KKR MostReadStories
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE