Advertisement
০৪ মে ২০২৪

রোনাল্ডোর স্বপ্নপূরণের পিছনে অনামী নায়কের সোনার হাত

রুই প্যাট্রিসিও নিয়ে এমনি লিখতে বসলে, কিছুই লেখার থাকবে না! উইকিপিডিয়ায় তাঁকে নিয়ে মেরেকেটে দেড়খানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। গোটা ফুটবল-জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন এমন একটা ক্লাবে, যারা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার কথা সেরা সুখস্বপ্নেও ভাবতে পারবে না। খেলেন তো স্পোর্টিং লিসবনে।

রুই প্যাট্রিসিও।

রুই প্যাট্রিসিও।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
প্যারিস শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৬ ০৩:৫০
Share: Save:

রুই প্যাট্রিসিও নিয়ে এমনি লিখতে বসলে, কিছুই লেখার থাকবে না!

উইকিপিডিয়ায় তাঁকে নিয়ে মেরেকেটে দেড়খানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। গোটা ফুটবল-জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন এমন একটা ক্লাবে, যারা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতার কথা সেরা সুখস্বপ্নেও ভাবতে পারবে না। খেলেন তো স্পোর্টিং লিসবনে। আর দ্বিতীয় চাঞ্চল্যকর বিষয়— তাঁর ফুটবল কেরিয়ারের শুরুটা ম্যানুয়েল ন্যয়ারের মতো। গোলকিপার হিসেবে নয়, স্ট্রাইকার পজিশনে।

কিন্তু ইউরো ফাইনালের রাতের পর রুই প্যাট্রিসিও নিয়ে লিখতে গেলে হাজার-হাজার শব্দ লেখার থাকবে। তখন বরং ম্যানুয়েল ন্যয়ারদেরই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না!

রবিবার রাতে আইফেল টাওয়ার ফ্যান জোনে ম্যাচ শেষে ফরাসিদের দেখে মনে হচ্ছিল, গত বছর নভেম্বরের পর দ্বিতীয় ‘জঙ্গিহানা’টা এই কিছুক্ষণ আগে হয়ে গিয়েছে! বিহ্বল, বজ্রাহত হয়ে সব দাঁড়িয়ে। গত একশো কুড়ি মিনিটের উপাখ্যান যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। এক ফরাসিকে দেখলাম উত্তেজিত চিত্কার করছেন। মাঝে-মাঝে ‘রুই’ ‘রুই’ নামটা উড়ে আসছে। গালিগালাজ? হবে হয়তো। বিপক্ষের এগারো ফুটবলার নয়, স্রেফ দু’টো হাত যদি জাতীয় শোকের বন্দোবস্ত করে, অসহ্য রাগ মগজে চেপে বসবে না?

পাশে দাঁড়ানো এক ফরাসি আবার প্রবল অবিশ্বাসে ক্রমাগত মাথা নাড়াচ্ছিলেন। এবং ইমানুয়েল পরিচয় শোনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখালেন না। গভীর দুঃখে বলতে লাগলেন, “কার জেতার কথা ছিল, আর কে জিতল। পোস্টে লেগে বল বেরিয়ে যাচ্ছে। গোলকিপার প্রত্যেকটা শট বাঁচাচ্ছে। ভাবতে পারছি না, একটা টিম স্রেফ ডিফেন্স করে কাপ নিয়ে বেরিয়ে গেল। আর গ্রিজম্যানরা ওদের থেকে হাজার গুণ ভাল হয়েও কি না মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়ছে।”

পর্তুগিজ সমুদ্র ঠেলতে ঠেলতে বেরনোর সময় দেখা গেল, তীব্র হতাশায় রাস্তাতেই বসে পড়েছেন কিছু ফরাসি তরুণী। মাথায় হাত, স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় বাস্তব মেনে নিতে বড় কষ্ট হচ্ছে। আঁতোয়া গ্রিজম্যান থেকে দিদিয়ের দেশঁ— তাঁরাও শোকতাপ গোপন করতে পারছেন কোথায়? স্ফুলিঙ্গের মতো হতাশা ছিটকে ছিটকে বেরোচ্ছে, আর সব শেষে থাকছে ওই নামটা।

রুই প্যাট্রিসিও।

চেহারা খুব সাধারণ। লিসবনের সবচেয়ে ছোট বাজারে ছেড়ে দিলেও আলাদা করে চেনার উপায় থাকবে না। এত দিন কেউ তো তাঁকে ধর্তব্যের মধ্যে রাখেওনি। ইউরো কাপে গোলকিপারদের মধ্যে সর্বাধিক আলোচনা দু’জনকে নিয়ে হয়েছে— ইতালির জিয়ানলুইগি বুফন এবং জার্মানির ম্যানুয়েল ন্যয়ার। বুফন জার্মানির বিরুদ্ধে যা পারেননি, ন্যয়ার ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যা পারেননি, প্যাট্রিসিও ঠিক সেটাই করে গেলেন ফাইনালে পোগবাদের ফ্রান্সের বিরুদ্ধে। টিমের অধিনায়ককে চব্বিশ মিনিটের মধ্যে হারিয়ে অকুতোভয় কিপিং-স্কিলে, ন্যয়ার-বুফনদের ছাপিয়ে এক রাতের জন্য লেভ ইয়াসিন হয়ে উঠে। সিসোকোর শট যে ভাবে তিনি বাঁচালেন, জিরুঁর গরগরে আক্রমণ যে ভাবে প্রতিহত করলেন বারবার, গ্রিজম্যানের হেড পর্যন্ত গোলে ঢুকতে দিলেন না, ন্যয়ারদের দুনিয়ায় এর পর তাঁর জায়গা হয়ে যাওয়া উচিত।

ফাইনাল জিতে পর্তুগাল কোচ প্যাট্রিসিওর স্তুতি-প্রশংসায় কোনও কার্পণ্য করেননি। স্যান্টোস বলেছেন, “পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে পেনাল্টি শ্যুটআউটের সময় দুর্দান্ত খেলেছিল, আজ আবার খেলল।” দেশঁ বলে ফেলেছেন, “গ্রিজম্যান কম সুযোগ তৈরি করেনি। কিন্তু ওকে এমন এক গোলকিপারের বিরুদ্ধে লড়তে হল যে নিজের সেরা ফর্ম নিয়ে নেমেছিল। অবিশ্বাস্য সব সেভ করেছে রুই।”

আঁতোয়া গ্রিজম্যান— তিনিও যন্ত্রণাবিদ্ধ ভাবে বলে দিয়েছেন, রোনাল্ডো দু’টো টুর্নামেন্ট (ইউরো এবং চ্যাম্পিয়ন্স লিগ) জিতে যাওয়ার পর নিজে ব্যালন ডি’অরের আশা আর রাখেন না। “খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি চেয়েছিলাম সতীর্থদের ট্রফিটা দিতে। সুযোগও পেয়েছিলাম। কিন্তু ওদের গোলকিপারও দারুণ খেলে দিল।”

স্যান্টোস, দেশঁ, গ্রিজম্যানরা বলবেনই। কেউ সুখে বলবেন, কেউ দুঃখে। কিন্তু অবাক লাগে ভাবলে যে, কেউ কেন এত দিন প্যাট্রিসিও নিয়ে একটা শব্দও খরচ করেনি? কেন কেউ তাঁর সাদামাঠা জীবন ঘেঁটে প্রতিভার বিচ্ছুরণ গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে চায়নি?

অথচ কেরিয়ারের বিচারে কম আকর্ষণীয় তিনি নন। এটা ঘটনা যে, বিতর্ক, কথাবার্তা থেকে শতহস্ত দূরে থাকতে পছন্দ করেন পর্তুগিজ গোলকিপার। বিতর্কিত কথাবার্তা সম্প্রতি প্যাট্রিসিওকে এক বারই বলতে শোনা গিয়েছে। ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ইউরো ফাইনালের আগে। সমালোচনা-সমালোচনায় টিমকে বিদ্ধ হতে দেখে পর্তুগিজ গোলকিপার যখন মেজাজ হারিয়ে বলে ফেলেছিলেন, “টুর্নামেন্টটা লোকে শুরুতে জেতে না, জেতে শেষে!”

কিন্তু ওই এক বারই। আর নেই। মানুষ হিসেবে তিনি নরম ধাতের, প্রচারবিমুখ হতে পারেন, কিন্তু তাঁর কিপিং-দক্ষতা প্রচারের ঝাড়বাতি দাবি করে। পর্তুগালের প্রিমিয়ার লিগে প্যাট্রিসিওর শুরুটাই কিন্তু পেনাল্টি বাঁচানো দিয়ে! প্যাট্রিসিও তার পর থেকে স্পোর্টিং লিসবনেই কাটিয়ে দিয়েছেন। আড়াইশোটার বেশি ম্যাচ খেলা, ক্লাবকে ট্রফি দেওয়াও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তবু অন্য ক্লাব তাঁকে ভাবেনি। মাঝে একবার জল্পনা শোনা গিয়েছিল তাঁর ইন্টার মিলান যাওয়া নিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা জল্পনাতেই আটকে থেকে যায়। ফ্রান্স— তারাও তো ভাবেনি তাঁকে নিয়ে। দেশঁরা রোনাল্ডোকে ভয় পেয়েছিলেন স্বাভাবিক নিয়মে। একটা রুই প্যাট্রিসিও যে সব ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারেন, ভাবতে পারেননি।

ভাবা উচিত ছিল। বোঝা উচিত ছিল। যে ইউরো নকআউটে তুলে দেয় ওয়েলস-আইসল্যান্ডের মতো তথাকথিত অনামী টিমকে, যে ইউরো আবিষ্কার করে ক্লাবহীন কানুর ‘ক্রুয়েফ টার্ন’, যে ইউরো দেখে কোনও এক গুডজনসনের দেশের ফুটবল-প্রপিতামহ হয়ে ওঠা, সেই ইউরোর ফাইনালে প্যাট্রিসিও-প্রতিরোধের বদলে গ্রিজম্যান-গর্জনই যে বড় আশ্চর্যের হত!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rui Patricio Ronaldo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE