Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
ব্যাট নয়, সাত বছর পর পেন হাতে

সচিনের বদলা ঘিরে আলোড়িত ক্রিকেটবিশ্ব

বাড়ি বয়ে এসে সত্যিই তিনি সচিন তেন্ডুলকরকে ক্যাপ্টেন করতে চেয়েছিলেন কি না, তার চূড়ান্ত মীমাংসা হয়তো ভবিষ্যতে কোনও দিন হবে। কিন্তু এখনকার মতো গ্রেগ চ্যাপেল সত্যিই এত দিনকার অনিচ্ছুক তেন্ডুলকরকে ‘ক্যাপ্টেন’ হতে রাজি করিয়ে ফেলেছেন। একটা টিমই যেন খাড়া হয়ে গেছে। সৌরভ, ভিভিএস লক্ষ্মণ, হরভজন সিংহ, সহবাগ, যুবরাজ, জাহির... নেতৃত্বে স্বয়ং সচিন। বিরোধী দল? কে আবার, গ্রেগ চ্যাপেল! কে জানত, এত বছর বিতর্ক থেকে সহস্র যোজন দূরত্বে থাকা তেন্ডুলকর নিজের মধ্যে এমন গরগরে রাগ লুকিয়ে রেখেছিলেন। আর প্রথম সুযোগেই সেই তীব্র আক্রোশ আত্মজীবনীতে এ ভাবে প্রকাশ করবেন! ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’ তাঁর বইয়ের নাম।

গৌতম ভট্টাচার্য
মুম্বই শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৪ ০২:২৮
Share: Save:

বাড়ি বয়ে এসে সত্যিই তিনি সচিন তেন্ডুলকরকে ক্যাপ্টেন করতে চেয়েছিলেন কি না, তার চূড়ান্ত মীমাংসা হয়তো ভবিষ্যতে কোনও দিন হবে। কিন্তু এখনকার মতো গ্রেগ চ্যাপেল সত্যিই এত দিনকার অনিচ্ছুক তেন্ডুলকরকে ‘ক্যাপ্টেন’ হতে রাজি করিয়ে ফেলেছেন।

একটা টিমই যেন খাড়া হয়ে গেছে। সৌরভ, ভিভিএস লক্ষ্মণ, হরভজন সিংহ, সহবাগ, যুবরাজ, জাহির... নেতৃত্বে স্বয়ং সচিন। বিরোধী দল? কে আবার, গ্রেগ চ্যাপেল!

কে জানত, এত বছর বিতর্ক থেকে সহস্র যোজন দূরত্বে থাকা তেন্ডুলকর নিজের মধ্যে এমন গরগরে রাগ লুকিয়ে রেখেছিলেন। আর প্রথম সুযোগেই সেই তীব্র আক্রোশ আত্মজীবনীতে এ ভাবে প্রকাশ করবেন! ‘প্লেয়িং ইট মাই ওয়ে’ তাঁর বইয়ের নাম। যা অ্যাডভান্স বুকিংয়ের অর্ডারে প্রকাশকদের দাবি অনুযায়ী সর্বকালীন রেকর্ডের দিকে ছুটছে।

কিন্তু বিক্রি তো নিছকই বাণিজ্যিক একটা শব্দ। স্রেফ একটা পরিচ্ছেদের উদ্ধৃতিতেই ক্রিকেট জগতে এমন হইচই ফেলে দিয়েছেন সচিন যে, অস্ট্রেলিয়ার কোনও কোনও সাংবাদিকের মনে হচ্ছে লাগাতার যদি আরও চলতে থাকে, ভারত-অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট-সম্পর্ক নিয়ে না হইহই পড়ে যায়! মুম্বইয়ে এসে যা শুনলাম, শুধু গ্রেগ নন, অস্ট্রেলিয়ার আরও দিকপাল কিছু ক্রিকেটার সচিনের বইয়ের চাঁদমারিতে রয়েছেন!

মঙ্গলবার সকালে ব্রিসবেনে যখন গুরু গ্রেগকে ধরা গেল, তিনি প্রথমে কোনও প্রতিক্রিয়া দিতে চাননি। বলেন, “এই মুহূর্তে কিছু বলব না।” তার পর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ওপর অস্ট্রেলীয় প্রচারমাধ্যমের চাপ বাড়া শুরু হয়। তখন ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার চাকুরে তিনি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার ওয়েবসাইটে সচিনের বক্তব্য খণ্ডন করে বলেন, আদৌ কখনও রাহুলকে সরিয়ে সচিনকে অধিনায়ক হওয়ার প্রস্তাব দেননি। সচিনের বাড়ি তিনি গিয়েছিলেন মাত্র এক দিন। তা-ও সহকারী কোচ আর ফিজিও সঙ্গে নিয়ে।

মঙ্গলবার মুম্বইয়ে ভারতের তখনকার নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান দিলীপ বেঙ্গসরকর বললেন, “চ্যাপেলের অফারের কথা কাগজে পড়ে আশ্চর্য লাগল। ক্যাপ্টেন ঠিক করে তো নির্বাচকেরা। ও কে বাড়ি বয়ে ক্যাপ্টেন্সির অফার দেওয়ার? আমি এই ঘটনার কথা কখনও আগে শুনিনি। অবশ্য বন্ধ ঘরে কথা হলে জানবই বা কী করে!” রবি শাস্ত্রী সেই সময় বোর্ডের কোচ নির্ধারক কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনিও সকালে কাগজ দেখে খুব আশ্চর্য। তবে চ্যাপেল বনাম সচিন একের বিরুদ্ধে এক দাবির লটারিতে পরিষ্কার সচিনের দিকে। হরভজন সিংহ যেমন এ দিন এবিপি-কে বললেন, “জানতাম না ঘটনার কথা। কিন্তু সচিন যখন বলছে, তখন তার বিশ্বাসযোগ্যতাটা নিয়ে কোনও প্রশ্নই উঠতে পারে না।”

বান্দ্রা-কুর্লা কমপ্লেক্সের মাঠে এ দিন দেখা হল প্রাক্তন ভারতীয় স্পিনার নীলেশ কুলকার্নির সঙ্গে। নীলেশ সচিনের নেতৃত্বে নিয়মিত মুম্বই টিমে খেলা ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া সফরেও গিয়েছিলেন। তা নীলেশ বলছেন, “মাস্টার চব্বিশ বছর মুখ বন্ধ করে ক্রিকেট খেলেছে। এখন ও চালানো মানে বাকিরা লাইসেন্স পেয়ে গেলাম, আমরা যারা এত বছর ওকে ফলো করে এসেছি।”

পরিস্থিতি ঠিক তেমনই। শিষ্যরা এক-এক করে চ্যাপেলের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হচ্ছেন। এ দিন ভাজ্জি আর লক্ষ্মণ। বুধবার খুব সম্ভবত আরও নাম বাড়বে। লক্ষ্মণ এ দিন তাঁর বাড়ির সামনে সমবেত সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, “চ্যাপেলের আমলের মতো খারাপ ড্রেসিংরুম পরিবেশ আর কখনও ভারতীয় দলে দেখিনি।” বলেছেন, “মুখ খুলে বিতর্ক তৈরির জন্য নিন্দা নয়। এত দিন মুখ বন্ধ রেখে ক্রিকেট খেলার জন্য সচিনকে সাধুবাদ দেওয়া উচিত।”


আত্মজীবনী প্রকাশের আগের দিন বিশেষ ডিনার পার্টিতে সচিন। মঙ্গলবার মুম্বইয়ে।

ভাজ্জি আরও তীক্ষ্ন। যেন বছরটা ২০০৭ সালই, এমন ভঙ্গিতে বলেছেন, “শয়তানটা শেষ করে দিচ্ছিল ভারতীয় ক্রিকেটকে। সৌরভকে বিনা দোষে টিম থেকে সরিয়ে দিল। তখন আমি প্রতিবাদ করায় বোর্ডকে দিয়ে আমাকে ধ্যাতানি খাওয়াল। নিজে ডেকে বলল। তার পর হাত দিল সচিনকে সরাতে। কত বড় সাহস! আজ সচিন মুখ খোলায় সবাই বুঝছে কী অন্ধকার সময় আমাদের পেরোতে হয়েছিল। প্লেয়ারদের মধ্যে এর কথা ওকে বলে ঝগড়া লাগিয়ে দিত। ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি নিয়ে চালাচ্ছিল। সচিন এত বছর পর ওর মুখোশটা খুলে দিয়েছে, বেশ করেছে।”

অনেকে আবার আশ্চর্য এত দিনের নির্বিবাদী সচিন এত আক্রমণাত্মক হওয়ায়। বিষেণ বেদী টুইট করেছেন, ‘অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, কারও সাহায্য নিয়ে আত্মজীবনী লিখলে অনেক সময় নিজের কথা এ দিক সে দিক হয়ে যায়। সচিনের মুখেও তেমন শব্দ বসানো হয়নি তো?’ ইঙ্গিতটা যাঁর দিকে, সেই সহ-লেখক বোরিয়া মজুমদার বললেন, “বেদী নিজের মনের কথা বলতেই পারেন। কিন্তু বাস্তব এ-ই যে, প্রথম দিন থেকেই সচিন বলছিল গ্রেগ চ্যাপেল নিয়ে ওর মনের কথা বলবেই। ওকে আমার সামান্যতম খোঁচাতেও হয়নি।”

এমনিতে ভারতবর্ষে আর কোনও বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানের আগে এই পর্যায়ের ঢক্কানিনাদ, এত গোপনীয়তা, এত সাজসজ্জা হয়েছে কি না সন্দেহ। বুধবার রাত আটটায় বইয়ের সম্পূর্ণ অংশ প্রকাশ করা হবে। তার আগে সাংবাদিকেরা তার বয়ান জানতে পারলেও বলতে বা লিখতে পারবেন না। বই একই সঙ্গে প্রকাশ করবেন গাওস্কর, বেঙ্গসরকর, বাসু পরাঞ্জপে, দ্রাবিড়, সৌরভ, লক্ষ্মণ, শাস্ত্রী।

এর মধ্যে দ্রাবিড়কে সামলানোটা সামান্য স্পর্শকাতর হতে পারে। যেহেতু বইয়ে মুলতান ডিক্লেয়ারেশন নিয়েও সাফ-সাফ কথা থাকছে। চ্যাপেল-বিতর্কেও দ্রাবিড় আর সচিন দুই বিপরীত শিবিরের মানুষ। মেরুর নাগরিকত্ব আজও বদলেছে বলে কেউ শোনেনি।

তবে দ্রাবিড়কে তো তবু পরম সমাদরে সচিন ডেকেছেন। তালিকায় নামই নেই কপিল আর আজহারের। আর একজনের নাম নেই আশ্চর্যজনক ভাবে। এখনকার ভারত অধিনায়কের। পরের দিন আমদাবাদে যে ইন্ডিয়ান টিম খেলবে, তার নেতৃত্বে তো বিরাট কোহলি!

মহেন্দ্র সিংহ ধোনি কাল আমন্ত্রিত-তালিকায় নেই কেন? অনেকেরই চোখে পড়ছে। ধোনি কি শেষ মুহূর্তে ডাক পাবেন, না কি সচিনের আচমকা ওয়ান ডে থেকে অবসর নিতে বাধ্য হওয়া আর টেস্ট জীবন দক্ষিণ আফ্রিকায় ইচ্ছেমতো শেষ করতে না পারার কারণকে তিনি আজও ক্ষমা করতে পারেন না?

চ্যাপেল নামক সাত বছর আগের ঘটনাই যদি এই রকম প্রতিহিংসার আগুন জ্বালিয়ে রাখে, এগুলো তো টাটকা। একটা দেড় বছর। একটা এক বছর।

এক-এক সময় মনে হচ্ছে বই নয়, ব্যাট হাতেই অনেক জবাব মিটিয়ে দেওয়ার ইনিংস যেন কাল মুম্বইয়ে খেলতে নামছেন তেন্ডুলকর। ওই তো বইয়ের পাতা থেকে চিত্‌কারও ভেসে আসছে স্যা-চি-ন, স্যা-চি-ন!

ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য

আমার কোচিং জীবনে একবারই সচিনের বাড়ি গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল টিমের সহকারী কোচ এবং ফিজিও। ওই সময় সচিনের রিহ্যাব চলছিল। ক্যাপ্টেন্সি নিয়ে কোনও কথাই হয়নি।

গ্রেগ চ্যাপেল

সচিনকে আমি অনেক দিন ধরেই চিনি। ও যখন ঘটনাটার কথা বলছে, তখন নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছিল। সচিনকে অবিশ্বাস করার কোনও প্রশ্ন নেই।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়

ভারতীয় ক্রিকেটকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল চ্যাপেল। ওই সময় ভারতীয় টিমের ড্রেসিংরুমের পরিবেশ সবচেয়ে খারাপ ছিল। আমাকেও চ্যাপেল হুমকি দিয়েছিল। সচিন যা বলছে, তা অবশ্যই বিশ্বাস করি।
ভিভিএস লক্ষ্মণ

কারও সাহায্য নিয়ে আত্মজীবনী লিখলে অনেক সময় নিজের কথা এ দিক সে দিক হয়ে যায়। সচিনের মুখেও তেমন শব্দ বসানো হয়নি তো?
বিষেণ সিংহ বেদী

ঘটনাটা জানতাম না। সচিন যখন বলছে, বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নই নেই। শয়তানটা শেষ করে দিচ্ছিল ভারতীয় ক্রিকেটকে। সচিন ওর মুখোশটা খুলে দিয়ে বেশ করেছে।
হরভজন সিংহ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE