সমিত গোহেল। বিশ্বরেকর্ডের ইনিংস।
ববি অ্যাবেলের নামটা শুনতে-শুনতে সমিত গোহেলের দুপুর হয়ে গিয়েছিল।
ওড়িশার বিরুদ্ধে রঞ্জি কোয়ার্টার ফাইনালে অপরাজিত ৩৫৯ রানের মহাকাব্যিক ইনিংসটা মঙ্গলবার যখন খেলছিলেন গুজরাতের যুবক, জানতেনও না ববি অ্যাবেলকে। একশো সতেরো বছরের ধুলোমাখা এক ক্রিকেট-নথি জানা বোধহয় একটু কঠিনও। ১৮৯৯ সালে সারের হয়ে ওপেন করতে নেমে ৩৫৭ নট আউট থেকে গিয়েছিলেন অ্যাবেল। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে যা রেকর্ড ছিল। পরের একশো বছরে একজন ওপেনারও পারেননি ৩৫৭ করে ‘ক্যারিং দ্য ব্যাটের’ কীর্তি গড়তে। একশো সতেরো বছর পর এক ওপেনার পারলেন। ৩৫৭ ভেঙে ৩৫৯ করতে।
ইনি সমিত গোহেল। গুজরাত ওপেনার। যাঁর নামের পাশে আজকের পর থেকে বিশ্বরেকর্ড। ববি অ্যাবেলকে হারিয়ে। একশো সতেরো বছরের এক ক্রিকেট-নথিকে উড়িয়ে। নতুন এক ক্রিকেট-ইতিহাসের জন্ম দিয়ে।
বিশ্বরেকর্ড— শব্দটা শুনলে এখনও কেমন যেন ঘোর-ঘোর লাগছে গুজরাতি যুবকের। মঙ্গলবার রাতে ফ্লাইটে বসার সময়ও ফোনে আনন্দবাজারকে সমিত বলছিলেন, ‘‘শুনে প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। কোচ বললেন। ক্যাপ্টেন পার্থিব বলল। কিন্তু তবু বিশ্বাস হয়নি। নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছিল না। পরে বুঝলাম যখন সত্যি সত্যি হয়েছে, মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল।’’ বলতে বলতে কয়েক সেকেন্ডের নৈঃশব্দ, তার পর ফের জুড়ে দেওয়া, ‘‘পরে দেখলাম, কত মিডিয়া দাঁড়িয়ে। সবাই আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়। বললাম। কিন্তু এখনও আমি ব্যাপারটা পুরোপুরি বিশ্বাস করে উঠতে পারিনি।’’
আমদাবাদ থেকে পঁচাত্তর কিলোমিটার দূরের আনন্দে জন্মে। বিরাট যে বিত্তশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ, তা নয়। তবে মোটামুটি স্বচ্ছ্বল বলা চলে। বাবা মধ্যবিত্ত মানের রিয়েল এস্টেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে। ‘‘টাকা-পায়সা মারাত্মক ছিল না আমাদের। কিন্তু তাই বলে কখনও আমার ক্রিকেটের সঙ্গে আপস করেনি পরিবার। প্যাড, গ্লাভস, ব্যাট যখন যা প্রয়োজন হয়েছে বলতেও হয়নি। চলে এসেছে,’’ বলতে থাকেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নয়া বিশ্বরেকর্ডের মালিক।
কিন্তু প্রতিবন্ধকতা তবু দাঁতনখ বার করে আক্রমণ করেছে সমিতের ক্রিকেটে। গুজরাতের ডান হাতি ওপেনারের টেকনিক নিয়ে প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু সংশয় দেখা দিয়েছিল মানসিকতা নিয়ে। স্কোরিং শট খেলা নিয়ে দোটানায় পড়ে যেতেন। লোকে নামই দিয়ে দিয়েছিল, ‘স্ট্রোকলেস ওয়ান্ডার’। দেবেই। ওড়িশার বিরুদ্ধে এই রঞ্জি কোয়ার্টার ফাইনালের আগে ২৭ ম্যাচে ৩৬ স্ট্রাইক রেট ছিল সমিতের, লোকে তো এর পর বলবেই।
‘‘আমার খেলাটা পাল্টে দেয় পার্থিব ভাই (পটেল) আর টিমের কোচ, বিজয় (পটেল) স্যার,’’ ফোনে বলছিলেন সমিত। ‘‘পার্থিব ভাই আমাকে বলে যে, তোর টেকনিক এত ভাল। তুই এই সমস্যাটা কাটিয়ে না উঠতে পারলে আর কে পারবে?’’ রাহুল দ্রাবিড়ের ব্যাটিংয়ের অন্ধ ভক্ত। বছর কয়েক আগে জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে দ্রাবিড়ের সঙ্গে দেখাও হয়েছিল। কিন্তু কোথাও যেন মনে হয়, দ্রাবিড় নয়, পার্থিব পটেল অনেক বেশি প্রভাবশালী থেকে গিয়েছেন সমিতের জীবনে। নায়ক বললেনও যে, পার্থিবের পরামর্শের পর জীবন বদলে গিয়েছিল। ‘‘এখন আর শট খেলার সময় আউট হয়ে যাব, ভাবি না। সোজা খেলে দিই। রেজাল্টও তো পাচ্ছি।’’ রেজাল্টই বটে! ৪৫ বাউন্ডারি আর এক ছক্কায় ৭২৩ বলে ৩৫৯ নটআউট, রেজাল্টের তো শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্য নথি। তাঁর দানবীয় ব্যাটিংয়ে গুজরাতের দ্বিতীয় ইনিংস শেষ হয় ৬৪১ রানে। যা রঞ্জি সেমিফাইনালে তুলে দিল দলকে।
কিন্তু এ বার? এর পর?
সমিত ঠিক করে ফেলেছেন, বিশ্বরেকর্ড শব্দটাকে মঙ্গলবারের পর আর জীবনে ঢুকতে দেবেন না। পাল্টাতে দেবেন না নিজের জীবন। কথাগুলো শুনলেও ভাল লাগবে। ‘‘বিশ্বরেকর্ড করেছি, ঠিক আছে। কিন্তু আমি এত দিন যে রকম ছিলাম, তেমনই থাকব। যে খাটাখাটনিটা করতাম, সেটা করতে থাকব। এখন প্রথম লক্ষ্যটা গুজরাতকে রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন করা। তার পর সেই লক্ষ্যটা যার জন্য প্রত্যেক ক্রিকেটার বাঁচে!’’
আসলে সমিত গোহেল জানেন, আসল ক্রিকেটযুদ্ধটা তাঁর আজ থেকে শুরু হল। এত দিনের ও সব ‘স্ট্রোকলেস ওয়ান্ডারের’ অপবাদ, এর পাশে নেহাতই শিশুপাঠ্য মাত্র!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy