Advertisement
E-Paper

‘কোহালিরাও ইতিহাস তৈরি করতে পারে’

টেস্ট ক্রিকেটের ১৪১ বছরের ইতিহাসে মাত্র এক বারই কোনও দল ০-২ পিছিয়ে থাকা অবস্থা থেকে অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে পাঁচ টেস্টের সিরিজ জিতে নিতে পেরেছে। ১৯৩৬-৩৭ মরসুমে ডন ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়া। সে বারও স্যর ডনের দলের প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড। খুব ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট নিবেদিত প্রাণ ইলিংওয়ার্থ বিলক্ষণ সেই ইতিহাসের কথা জানেন। এত দিন ধরে যা কোনও দল পারেনি, তা কোহালিরা করে দেখাবেন বলে মনে হওয়ার কারণ?

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৮ ০৪:২৫
ট্রেন্ট ব্রিজ জয়ের পরে কোহালির গর্জন। ফাইল চিত্র

ট্রেন্ট ব্রিজ জয়ের পরে কোহালির গর্জন। ফাইল চিত্র

সাতচল্লিশ বছর আগে অজিত ওয়াড়েকরের দল যখন ওভালে ইতিহাস সৃষ্টি করছে, তিনি ছিলেন প্রতিপক্ষ অধিনায়ক।

ক্রিকেটের সদা বিতর্কিত এবং সর্বকালের অন্যতম সেরা সেই ইংরেজ অধিনায়ক মনে করছেন, বিরাট কোহালির এই ভারতীয় দলেরও নতুন ইতিহাস তৈরি করার যোগ্যতা রয়েছে। তিনি— রেমন্ড ইলিংওয়ার্থ (রে ইলিংওয়ার্থ নামেই বেশি পরিচিত) শনিবার সকালে ফোনে আনন্দবাজারকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বললেন, ‘‘যে রকম লড়াকু মনোভাব দেখিয়ে ভারত ফিরে এসেছে, আমি বলব, সিরিজ এখন ফিফটি-ফিফটি। ইংল্যান্ডকে খুব ভাল খেলতে হবে সিরিজ বাঁচাতে গেলে। তেমনই বলতে দ্বিধা নেই, ভারত যদি সিরিজ জেতে আমি অবাক হব না।’’

টেস্ট ক্রিকেটের ১৪১ বছরের ইতিহাসে মাত্র এক বারই কোনও দল ০-২ পিছিয়ে থাকা অবস্থা থেকে অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে পাঁচ টেস্টের সিরিজ জিতে নিতে পেরেছে। ১৯৩৬-৩৭ মরসুমে ডন ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়া। সে বারও স্যর ডনের দলের প্রতিপক্ষ ছিল ইংল্যান্ড। খুব ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট নিবেদিত প্রাণ ইলিংওয়ার্থ বিলক্ষণ সেই ইতিহাসের কথা জানেন। এত দিন ধরে যা কোনও দল পারেনি, তা কোহালিরা করে দেখাবেন বলে মনে হওয়ার কারণ?

৮৬ বছরের ইলিংওয়ার্থ বললেন, ‘‘ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে ওদের দেখে মনে হয়েছে, স্বয়ংসম্পূর্ণ একটা দল। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং— সব দিক দিয়ে দারুণ অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দেখলাম। বিশেষ ভাবে আমার নজর কেড়েছে ওদের ফিল্ডিং। আমি কখনও কোনও ভারতীয় দলকে এত ভাল ফিল্ডিং করতে দেখিনি।’’ দ্রুত যোগ করলেন, ‘‘ভারতের স্লিপ ক্যাচিং দারুণ হয়েছে। একটা কী দু’টো ক্যাচ স্লিপ কর্ডন দিয়ে গলেছে ঠিকই কিন্তু সেগুলো বেশ কঠিন ছিল। একটা দল সামগ্রিক ভাবে ভাল হলে তাদের ভাল ফল করার সম্ভাবনাটাও অনেক বেড়ে যায়।’’

কী ভাবে তুলনা করবেন ১৯৭১-এর ওয়াড়েকরের ভারতের এবং এখনকার কোহালির ভারতের? ইলিংওয়ার্থ বলে দিলেন, ‘‘কোনও তুলনাই হবে না কারণ সম্পূর্ণ দু’ধরনের দল। আমাদের সঙ্গে যে ভারতীয় দলটা খেলেছিল, তাদের কোনও পেস বোলারই তো ছিল না। ওদের অস্ত্র ছিল স্পিন। আমার মনে আছে ওভালে চন্দ্রশেখর দ্বিতীয় ইনিংসে ভাল বল করে ভারতকে জিতিয়েছিল।’’ অনেকের মতো তিনিও যে ভারতীয় পেস বোলিংয়ের উত্থান দেখে বিস্মিত, বোঝা গেল যখন বললেন, ‘‘এখনকার ভারতীয় দলটা দারুণ সব ফাস্ট বোলারে ভর্তি দেখছি। ওরা ইংল্যান্ডের পেসারদের চেয়েও জোরে বল করছে। পেসাররাই এখন ভারতকে ম্যাচ জেতাচ্ছে। এটা অবশ্যই চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন ভারতীয় ক্রিকেটে।’’

স্মরণীয়: ওভালে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ওয়াড়েকর।

ইলিংওয়ার্থকে নিয়ে জনপ্রিয় নানা কাহিনির মধ্যে একটি হচ্ছে, আউট হয়ে ফিরে ড্রেসিংরুমে সব সময়ই কোনও না কোনও যুক্তি লেগে থাকত তাঁর। এক বার আউট হয়ে ড্রেসিংরুমে ফিরে বলেছিলেন, ‘‘ব্যাটা আম্পায়ারটা আমাকে লেগ গার্ড ভুল দিয়েছিল।’’ মাঠে বা মাঠের বাইরে হার গ্রহণ করতে পারতেন না। এখনও যেন সেই ‘অদম্য ইলি’-ই আছেন। ১৯৭১-এ ভারতের ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই ঠোঁটকাটা ভঙ্গিতে বলে দিলেন, ‘‘অবশ্যই ভারতের দিক থেকে খুব ঐতিহাসিক মুহূর্ত ছিল। ইংল্যান্ডে ওটাই ছিল ওদের প্রথম সিরিজ জয়। কিন্তু সিরিজটা আমাদের ২-১ জেতা উচিত ছিল। লর্ডস আর ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে প্রথম দুই টেস্টে বৃষ্টি এসে ম্যাচ ভেস্তে দেয়।’’

স্কোরবোর্ড বলবে, লর্ডসের প্রথম টেস্টে ১৮৩ রানের টার্গেটের সামনে দ্বিতীয় ইনিংসে ভারত ১৪৫-৮ থাকা অবস্থায় বৃষ্টি নামে। ম্যাঞ্চেস্টারে দ্বিতীয় টেস্টেও চাপে ছিল ভারত। ইলিংওয়ার্থ সেঞ্চুরি করেছিলেন। অষ্টম উইকেটে পিটার লিভারের সঙ্গে ১৬৮ রান যোগ করেছিলেন ইংল্যান্ড অধিনায়ক। চতুর্থ ইনিংসে ভারতের জন্য টার্গেট ছিল ৪২০ রানের। চতুর্থ দিনের শেষেই ওয়াড়েকরের দল ৬৫-৩ হয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থায় বৃষ্টির জন্য পঞ্চম দিনের খেলা বাতিল হয়ে যায় একটিও বল না হয়ে।

যদিও এত দিন পরে বৃষ্টির কথা টেনে এনে ভারতের কৃতিত্বকে খাটোও করতে চান না সেই সিরিজে ইংল্যান্ডের অধিনায়ক। দ্রুত তাই যোগ করছেন, ‘‘স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, সেই ভারতীয় দলে বেশ কিছু ভাল ক্রিকেটার ছিল। সানি গাওস্কর ছিল। ম্যাঞ্চেস্টারে দারুণ ইনিংসও খেলেছিল গাওস্কর। আমার বন্ধু ফারুক ইঞ্জিনিয়ার ছিল। সেই সিরিজে ভাল খেলেছিল ফারুক। বোলিংয়ে অবশ্যই স্পিনাররা ছিল। চন্দ্রশেখর ছিল।’’ ওল্ড ট্র্যাফোর্ডেই ছিল সানির সেই মহাকাব্যিক ৫৭। গাওস্কর নিজে যেটাকে তাঁর ক্রিকেট জীবনের সেরা ইনিংস মনে করেন।

সেই সিরিজেই লর্ডসে সুনীল গাওস্করের সঙ্গে ইংল্যান্ডের ফাস্ট বোলার জন স্নো-র ধাক্কা লাগা নিয়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে যায়। রান নিতে ছুটছিলেন গাওস্কর। তাঁর পথের মাঝখানে চলে আসেন স্নো। ক্ষুব্ধ ইংরেজ প্রশাসকেরাও মনে করেছিলেন স্নো দোষী। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে স্নোকে তাঁরা বসিয়ে দেন তৃতীয় টেস্ট থেকে। যদিও পরে তিনি দলে ফেরেন এবং ওভালে খেলেন। ইলিংওয়ার্থ বরাবর পাশে দাঁড়িয়েছেন তাঁর বিতর্কিত ফাস্ট বোলারের। এ দিনও বললেন, ‘‘ঘটনাটাকে বাড়তে দেওয়া হয়েছিল। সিরিজের শুরুতেই ও রকম একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ায় সকলে খুব অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিল।’’ ট্রেন্ট ব্রিজে শিখর ধওয়ন এবং বেন স্টোকসের মধ্যে একই রকম ঘটনা হতে পারত। দু’বার রান নিতে ছোটা ধওয়নের সঙ্গে ধাক্কা লাগে স্টোকসের। কিন্তু তাঁরা নিজেরাই তৎক্ষণাৎ হাত মিলিয়ে মিটিয়ে নেন। সানি-স্নোর বিতর্কের পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেননি।

অফস্পিন বল করে ৬১ টেস্টে ১২২ উইকেট নিয়েছেন ইলিংওয়ার্থ। ওয়ান ডে এবং টি-টোয়েন্টি জমানায় জন্মালে খুবই হয়তো কাজে আসতে পারত তাঁর কৃপণ স্পিন বোলিং। তাঁর ‘ইকনমি রেট’ অর্থাৎ ওভার প্রতি রান দেওয়ার হার ১.৯ সর্বকালের অন্যতম সেরা। ছয় বা সাত নম্বরে ব্যাট করতে নেমে অনেক লড়াকু ইনিংস খেলেছেন। দু’টো টেস্ট সেঞ্চুরিও আছে। কিন্তু ব্যাটিং বা বোলিং নয়, ক্রিকেট দুনিয়া তাঁকে মনে রাখবে ধুরন্ধর অধিনায়ক হিসেবে। অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে অ্যাশেজ পুনরুদ্ধার করে নিয়ে এসেছিলেন।

ইংল্যান্ডের অন্যতম সেরা অধিনায়কের কেমন লাগছে বিরাট কোহালিকে? ইলিংওয়ার্থ বললেন, ‘‘কোহালি ভাল ক্যাপ্টেন। ইতিবাচক ক্যাপ্টেন। আগ্রাসী থাকতে ভালবাসে। সেটা ঠিকই আছে। এ রকম কঠিন সিরিজে মাঠের মধ্যে আগ্রাসী তো থাকতেই হবে।’’ যোগ করলেন, ‘‘কোহালি ক্যাপ্টেন হিসেবে এই সিরিজে যা যা করছে, আমি ক্যাপ্টেন থাকলেও সে রকমই করতাম। দু’একটা ছোটখাটো ব্যাপার বাদ দিলে খুব বড় কোনও খুঁত খুঁজে পাচ্ছি না।’’ আর ব্যাটসম্যান কোহালি? যাঁর সঙ্গে সেরাদের তুলনা শুরু হয়ে গিয়েছে? দ্রুত জবাব এল, ‘‘অসাধারণ! ইংল্যান্ডের আবহাওয়ায় এসে সুইং বোলিংকে শাসন করা মোটেও সহজ পরীক্ষা নয়। সেই পরীক্ষায় ও ফুল মার্কস নিয়ে পাশ করে যাচ্ছে। খুব প্রতিজ্ঞাবদ্ধ দেখাচ্ছে
আপনাদের ক্যাপ্টেনকে।’’

এমনিতে ইন্টারভিউ দিতে রাজি করানো দূরের কথা, ১৯৭১-এর ওয়াড়েকরের প্রতিপক্ষ অধিনায়ককে যোগাযোগ করে ওঠাই প্রায় অসম্ভব কাজ। এই বয়সেও হার্টের রোগ নিয়ে এবং ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও মাঠে ছুটে ছুটে চলে যান ক্রিকেট দেখতে। এ দিনও ফোন করার সময়ে বাড়ি ছিলেন না। হঠাৎই ফিরে এসেছিলেন কিছু একটা জিনিস নিতে। কলকাতা থেকে সিরিজ কভার করতে আসা সাংবাদিক অনেক বার ফোন করে সাক্ষাৎকারের অনুরোধ করছেন শুনে সময় দিতে রাজি হলেন। কিন্তু শুরুতেই বলে নিলেন, ‘‘খেলার মাঝখানে এসেছি। খুব তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে।’’ আর শেষ করলেন জো রুটের জন্য সাবধান বার্তা দিয়ে— ‘‘ইংল্যান্ডকে যদি সিরিজ জিততে হয়, ভারতের রানমেশিন কোহালিকে থামানোর রাস্তা খুঁজে বের করতেই হবে!’’

Ray Illingworth Cricket Test India England
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy