প্রাচ্য। পাশ্চাত্য। লাতিন।
বেজিং। লন্ডন। রিও।
বিশ্বের তিন প্রান্তে আট বছর ব্যাপী এক অভিযান। সোনার হ্যাটট্রিক দিয়ে শুরু। সোনার হ্যাটট্রিক দিয়ে শেষ। আর সব কিছুর মাঝে একটা নাম— উসেইন বোল্ট। যাত্রাশুরুর লগ্নে নামটা সে ভাবে কেউ চিনত না। আর যাত্রাশেষে নামটা পাকাপাকি ভাবে ইতিহাসে।
কোন বিশেষণে ধরা যায় এই যাত্রাকে? অবিশ্বাস্য? অলৌকিক? অসাধারণ?
শব্দ হাতড়াচ্ছে গোটা বিশ্ব। কিন্তু যাঁকে ঘিরে এই হট্টগোল, তিনি নিজে নিজের জন্য বিশেষণ ঠিক করে ফেলেছেন। অমরত্বের লক্ষ্যে ব্রাজিল এসেছিলেন। সেই লক্ষ্যপূরণ করে উঠে উসেইন বোল্টের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, ‘‘দেখে নিন। আমিই সর্বশ্রেষ্ঠ!’’
চারশো মিটার রিলেতে সোনা জিতে অলিম্পিক্সকে বিদ্যুৎগতির ফেয়ারওয়েল জানিয়েছেন জামাইকান স্প্রিন্টার। অ্যাথলেটিক্সের ইতিহাসে এমন সব নজির রেখে গিয়েছেন, যা একশো বছরেও কেউ ভাঙতে পারবে বলে বিশ্বাস করতে পারছে না বিশ্ব।
‘‘নিজেকে নিয়ে গর্ব হচ্ছে। আমার উপর যা চাপ ছিল, ভাবা যায় না। তবে এই মুহূর্তগুলোর জন্যেই তো বেঁচে থাকা। এর সৌন্দর্য আলাদা,’’ ভিকট্রি ল্যাপ এবং সতীর্থদের সঙ্গে নাচের সেশন শেষে বলছিলেন বোল্ট। বলছিলেন, তাঁর সেলিব্রেশন এখানেই থেমে থাকবে না। ‘‘বাড়ি যাব, সারা রাত জেগে থাকব। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলব, মজা করব। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, ট্রিপল ট্রিপল! এটা কি সত্যি? কী অসাধারণ অনুভূতি!’’
কী মনে হচ্ছিল শেষ বারের মতো অলিম্পিক্স ফিনিশিং লাইন পেরিয়ে? ‘‘এখন প্রচণ্ড আনন্দ হচ্ছে। বিশ্বাস করতে পারছি না। কিন্তু রেসের সময় ফিনিশিং লাইন যত কাছে আসছিল, তত বেশি আবেগে ডুবে যাচ্ছিলাম। আর লাইনটা পেরিয়ে এত রকম অনুভূতি হচ্ছিল, বলে বোঝানো যাবে না। শুধু মনে হচ্ছিল, আমি করতে পারলাম!’’
এত আনন্দ, ইতিহাস ছোঁয়ার এত উচ্ছ্বাসের মধ্যে অবশ্য কিছুটা বিতর্ক থেকে যাচ্ছে। বোল্ট নয়, তাঁর রিলে সতীর্থ নেস্তা কার্টারকে ঘিরে। যাঁর নতুন ডোপ পরীক্ষায় ধরা পড়েছে যে, তিনি নিষিদ্ধ পদার্থ নিয়েছিলেন। যদি চূড়ান্ত পরীক্ষায় নেস্তা পাশ না করতে পারেন, তা হলে বেজিং অলিম্পিক্সের রিলে সোনা তাঁদের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া হবে। আর বোল্টের অলিম্পিক্স সোনার সংখ্যা নয় থেকে কমে দাঁড়াবে আট। ট্রিপল ট্রিপলের ইতিহাসের মালিকও তিনি থাকবেন না। এ দিন ব্রিটিশ প্রচারমাধ্যমের একাংশ এই প্রসঙ্গ নিয়ে হঠাৎ বিতর্ক বাধিয়ে দেয়। কিন্তু ঘটনা হচ্ছে, ব্যাপারটা গত জুনের। এখন পর্যন্ত নেস্তার বিরুদ্ধে ডোপিংয়ের অভিযোগ প্রমাণ করা হয়নি।
এবং বোল্ট-মোহে আচ্ছন্ন বিশ্বের প্রতিক্রিয়া যদি প্রামাণ্য হয়, তা হলে এটাই মনে হবে যে, এ সব নিয়ে ভাবার ইচ্ছে বা অবকাশ তার নেই।
রিলেতে বোল্টের আর এক সতীর্থ ইয়োহান ব্লেক যেমন মজে রয়েছেন নিজস্ব স্বপ্নে। কী? না, বোল্টকে টোকিওর ট্র্যাকে তিনি নামাবেনই নামাবেন। ‘‘উসেইন অমরত্ব চায়। ও তো অমরই। কিন্তু আমি ওকে ২০২০ অলিম্পিক্সে নামতে উৎসাহ দেব।’’ সে প্রসঙ্গে বোল্ট নিজে আশ্চর্য রকম নিশ্চুপ। বরং তিনি বারবার বলেছেন, তাঁর ভক্তদের প্রচণ্ড মিস করবেন। অলিম্পিক্স ভিলেজের বন্ধুদের মিস করবেন। এবং রিলে জয়োত্তর তাঁর প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হবে, এই শেষ। এর পর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ বা অন্য কোনও টুর্নামেন্টের ট্র্যাক তাঁর সোনালি পায়ের বিদ্যুতের স্পর্শ পেতে পারে। কিন্তু অলিম্পিক্স মঞ্চ এই শেষ বারের মতো তাঁর জাদু দেখে নিল।
আর তাই গোটা বিশ্ব একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। বোল্টের জন্য উপযুক্ত বিশেষণ খোঁজার প্রতিযোগিতায়। কেউ বলছে, অপ্রতিরোধ্য। কেউ বলেছে, অপরাজেয়। কেউ বলছে, অবিস্মরণীয়। তর্ক উঠছে, বোল্টকে মাপা হবে কোন মানদণ্ডে? উচ্চতার মান যদি ডাবল ডেকার বাস হয়, ব্যাপ্তি মাপতে তোলা হয় ফুটবল মাঠের উদাহরণ, তা হলে বোল্ট-বিদ্যুতের চোখধাঁধানো ঔজ্জ্বল্য বোঝানো যাবে কী ভাবে?
বোল্ট নিজে বলেছেন, তিনি পেলে এবং মহম্মদ আলির সঙ্গে এক পংক্তিতে বসতে চান। সর্বশ্রেষ্ঠ জামাইকান হিসেবে তাঁর সঙ্গে টানা হচ্ছে সঙ্গীতশিল্পী বব মার্লির তুলনাও।
আর এটাই হয়তো বোল্টের মহাকাব্যিক সাফল্যের আসল নির্যাস। যে, তাঁর সঙ্গে তুলনা টানার মতো প্রতিদ্বন্দ্বীই পাওয়া যাচ্ছে না তাঁর নিজ-ক্ষেত্রে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর নাম যত দিন উঠবে, পাল্টা উঠবে লিওনেল মেসির নাম। বিরাট কোহালির সঙ্গে তুলনা হবে সচিন তেন্ডুলকরের। কিন্তু বোল্ট? আগামী শতাব্দী তাঁর কোনও রক্তমাংসের প্রতিদ্বন্দ্বীর জন্ম দিলেও দিতে পারে। যার সঙ্গে বোল্টের কীর্তি মেপে দেখা যাবে। কিন্তু আজ, এবং আজ থেকে আরও অনেক যুগ পর্যন্ত বোধহয় বোল্টের একমাত্র তুলনা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে।
আয়নার প্রতিফলন আর কবে কাকে ধরা দিয়েছে!