ইডেনেই কেরিয়ারের শেষ টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক জয়ের স্মৃতি এখনও টাটকা রাজুর।
উপমহাদেশের বাইরে অশ্বিনকে আগ্রাসী মেজাজে দেখা যায় না। পরিসংখ্যানেই তা প্রতিফলিত।
বেঙ্কটপতি রাজু: উপমহাদেশের বাইরে অধিকাংশ স্পিনারকেই তো সাদামাটা দেখায়। ব্যতিক্রম অনিল কুম্বলে আর হরভজন সিংহ। এর কারণ হল, বলটাই পাল্টে যায়। দেশে এসজি বলে খেলে অভ্যস্ত আমরা। বাইরে কোকাবুরায় খেলতে হয় বেশির ভাগ সময়। তা ছাড়া কন্ডিশনও পাল্টায়। ফলে, কোথাও গিয়ে বিশ্বাসে চিড় ধরে। দেশের মাঠে পাঁচ-ছয় উইকেট করে পেলেও উপমহাদেশের বাইরে তো তা সম্ভব নয়। তখন তিন-চার উইকেটেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। পাল্টে যায় স্পিনারের ভূমিকা। মানসিকতা পাল্টাতে হয় স্পিনারকে।
ভারতে স্পিনাররাই টেস্ট জেতার চাবিকাঠি। উপমহাদেশের বাইরে পেসাররা হয়ে ওঠেন প্রধান অস্ত্র। স্পিনারদের নিতে হয় সাহায্যকারীর ভূমিকা। এটা হজম করা এক জন স্পিনারের পক্ষে কতটা কঠিন?
বেঙ্কটপতি রাজু: হ্যাঁ, এটা টাফ তো বটেই। এর সেরা উদাহরণ নেথান লায়ন। ও যখন উপমহাদেশে আসে, জানে লম্বা স্পেল করতে পারবে। শুধু ধৈর্য ধরে তা করতে হবে। ও বেশি পরীক্ষার পথে যায় না। ও জানে, ভারতে স্পিনাররা প্রধান অস্ত্র, পেসাররা থাকে সাপোর্টিং রোলে। আবার, আমাদের স্পিনারদের ক্ষেত্রে উল্টো ঘটে। তখন স্পিনারা দুটো-তিনটে উইকেট পেলেই চলবে।
বছরের শেষে অস্ট্রেলিয়া সফরে যাওয়ার কথা ভারতের। সেখানে যদি এক জন স্পিনারকে খেলাতে হয়, কার প্রথম এগারোয় থাকা উচিত?
বেঙ্কটপতি রাজু: পুরোটাই কন্ডিশনের উপর নির্ভরশীল। অস্ট্রেলিয়া জানে, ভারতের হাতে ভাল স্পিনার রয়েছে। আবার পেস বোলিং বিভাগও শক্তিশালী ভারতের। তাই সবুজ উইকেট দেওয়ার আগে দু’বার ভাবতে হবে অজিদের। নিউজিল্যান্ড সফরে ভারতের অবস্থা দেখে অবশ্য জোরে বোলিংয়ের সহায়ক উইকেট দিতে প্রলুব্ধ হতে পারে ওরা। কিন্তু ভুললে চলবে না আমাদের পেস অ্যাটাকও পাল্টা দিতে পারে। যদি এক জন স্পিনার খেলাতে হয়, তা হলে দেখতে হবে অস্ট্রেলিয়া দলে কতজন বাঁ-হাতি। বেশি বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান ওদের দলে থাকলে অফস্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন এগিয়ে থাকবে। অবশ্য বিকল্পও আছে হাতে। কুলদীপ আছে, জাডেজা আছে। কিন্তু উইকেট পাওয়ার নিরিখে দলের এক নম্বর স্পিনার অবশ্যই অশ্বিন।
মহম্মদ আজহারউদ্দিন, সচিন তেন্ডুলকর, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। ক্রিকেটজীবনে তিন অধিনায়ককেই দেখেছেন। কে কেমন অধিনায়ক?
বেঙ্কটপতি রাজু: কেরিয়ারের শুরুর দিকে আমাদের কোচ ছিলেন অজিত ওয়াদেকর। তিনি যখন অধিনায়ক ছিলেন, তখনও স্পিনে বেশি ভরসা রেখেছিলেন। কোচ হওয়ার পর অধিনায়ক আজহারের সঙ্গে স্পিনারদের উপরই ভরসা রেখেছিলেন। তখন আমরা তিন স্পিনারে খেলতাম। অনিল কুম্বলে, রাজেশ চৌহান আর আমার উপর ভরসা ছিল আজহারের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায় স্ট্র্যাটেজি। সৌরভ অধিনায়ক হয়ে কুম্বলে-হরভজন জুটির উপর আস্থা রেখেছিল। সৌরভের মনে হয়েছিল, এই জুটিই ম্যাচ জেতাবে। যেটা বলতে চাইছি তা হল, প্রত্যেক ক্যাপ্টেনের দৃষ্টিভঙ্গি থাকে আলাদা। সব অধিনায়কই নিজের মতো করে এগোতে চায়। এখন আবার অশ্বিন-জাডেজা জুটি টেস্টে সফল। মোদ্দা কথা হল, স্পিন আক্রমণে বৈচিত্র থাকা দলের পক্ষেই ভাল। আর কম্পিটিশন থাকাটাও দরকার। এতে পারফরম্যান্সে উন্নতি ঘটে।
আরও পড়ুন: ‘ক্ষমতা রয়েছে কিন্তু ভিতরের আগুনটা দেখতে পাচ্ছি না ওদের মধ্যে’
আপনার হোয়াটসঅ্যাপে দেখলাম কুম্বলের সঙ্গে ছবি। একসঙ্গে খেলার সেই দিনগুলো কি মিস করেন এখনও?
বেঙ্কটপতি রাজু: কুম্বলে আর আমি মোটামুটি একই সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেছিলাম। একটা সিরিজ আগে অভিষেক ঘটেছিল আমার। আমরা ক্রিকেটার হিসেবে প্রচণ্ড সিরিয়াস ছিলাম। এখন দেখছি হরভজন, আশিস নেহরারা বলছে কুম্বলের কথা যে ওই ছিল সত্যিকারের ম্যাচ-উইনার। কথাটা একেবারে খাঁটি। আসলে গ্রেট ক্রিকেটাররা কথা বলে না, তাঁরা পারফর্ম করে। কুম্বলেও তাই। বড় কথাবার্তা বলে না কোনও দিন। কুম্বলের জন্য সতীর্থদের কাজটা সহজ হয়ে উঠত। ওর দিকেই পুরো ফোকাস থাকত। ম্যাচ জেতাবে কুম্বলে, এটাই ছিল প্রত্যাশা। আমি বা আমরা থাকতাম সাপোর্টের জন্য। এতে আমাদের উপর চাপ থাকত না। ও রান দিত না। ভাল লাইনে বিরামহীন বল করে যেত। বিপক্ষকে চিন্তায় রাখত। ফলে, আমাদের স্বাধীনতা থাকত নিজেদের মতো চেষ্টা করার। কুম্বলেই ছিল ম্যাচ-উইনার। একটা কথা এখানে জরুরি, ফাস্ট বোলার হোক বা স্পিনার, জুটির ক্ষেত্রে বোঝাপড়া গুরুত্বপূর্ণ। বোলিংয়ের কম্বিনেশন যাই হোক, অন্যের সাফলে খুশি হওয়া দরকার। অন্যকে অভিনন্দন জানানো দরকার।
আপনার শেষ টেস্ট ইডেনে। ২০০১ সালে স্টিভ ওয়ের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেই ঐতিহাসিক টেস্টে জয়ের রোমাঞ্চ এখনও টের পান?
বেঙ্কটপতি রাজু: গ্রেট ভিক্টরি। সেই টেস্ট জয় পাল্টে দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটকে। আমরা সর্বত্র জিততে পারি, এই বিশ্বাস এসেছিল। এর পরই আমরা বিদেশে জিততে শুরু করি। সেই আত্মবিশ্বাস এসেছিল ইডেনের জয় থেকেই। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যখন নেতৃত্বে আসে, তখন তরুণদের উপর ভরসা রেখেছিল। সেই তরুণরাই জেতাতে শুরু করে। ওটা ছিল ঐতিহাসিক মুহূর্ত। আমার শেষ টেস্ট। দীর্ঘ দিন পর খেলছিলাম আমি।
তিন বছর পরে প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল টেস্টের আসরে।
বেঙ্কটপতি রাজু: হ্যাঁ। আমার সৌভাগ্য যে জীবনের শেষ টেস্ট ছিল ইডেনে। লোকে ইডেনে খেলার স্বপ্ন দেখে। আর আমি শেষ করেছি ওখানে খেলে। এবং সেটাও ওই রকমের একটা অসাধারণ ম্যাচে। মার্ক ওয়ার উইকেট নিয়েছিলাম। হিস্টোরিক ম্যাচ। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জয় যে ভাবে বদলে দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটকে, অনেকটা সে ভাবেই এই টেস্ট জয় প্রভাব ফেলেছিল। ১৯ বছর কেটে গিয়েছে ওই টেস্ট জয়ের। কিন্তু এখনও তার রোমাঞ্চ টের পাই। সেই জয়ের সুবাস ঘিরে থাকে।
বর্তমানে আসি। প্রাক্তন নির্বাচক হিসেবে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির অবস্থান কী ভাবে দেখছেন?
বেঙ্কটপতি রাজু: ধোনি গ্রেট ক্রিকেটার। সচিন তেন্ডুলকরের মতোই। এবং একটা কথা সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যে, খেলতে হবে। সচিন তো রঞ্জিতেও খেলত। নির্বাচকদের ভাবনায় থাকার জন্য খেলার মধ্যে থাকা জরুরি। এত বছর খেলার পর তোমার পরিকল্পনা কী, সেটা সংশ্লিষ্ট পক্ষকে জানিয়ে দেওয়া উচিত। যদি কোনও সিদ্ধান্তে আসতে চাও, তা হলে সবাইকে জানিয়ে দাও। সে ক্ষেত্রে সবার কাছেই পরিস্থিতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দেখুন, ২০০৭ সালে অনেক সিনিয়র ক্রিকেটার ছিল। কিন্তু মহেন্দ্র সিংহ ধোনি ক্যাপ্টেন হয়েছিল ফর্মের জন্য। ধোনি প্রচুর ম্যাচ খেলেছে, প্রচুর জিতিয়েছে। ও যদি খেলতে চায়, তা হলে ম্যাচে নামুক। পারফরম্যান্স করুক। ফিটনেস দেখা হোক। ব্যাপারটা সিম্পল। এটা নিয়ে বেশি কথার দরকারই নেই। (হাসি)