Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মোহালিকে মনে করাচ্ছে ব্যাটিং ব্যর্থতা আর ডিজাইনার পিচ

গুগলিটা ধরতে না পেরে বরুণ অ্যারন সবেমাত্র বোল্ড হয়েছেন। ইমরান তাহিরকে দেখা গেল, মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুড়তে-ছুড়তে সতীর্থদের দিকে দৌড় শুরু করে দিতে। ভারতে এসে ভারতের টুঁটি চেপে প্রথম ইনিংস ২০১ রানে শেষ, কম কথা নয়। দক্ষিণ আফ্রিকা নামবে এ বার। গোটা কুড়ি ওভার খেলতে হবে।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
নাগপুর শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৫ ০৪:০৫
Share: Save:

মোহালি, ৫ নভেম্বর, ২০১৫ ...

গুগলিটা ধরতে না পেরে বরুণ অ্যারন সবেমাত্র বোল্ড হয়েছেন। ইমরান তাহিরকে দেখা গেল, মুষ্টিবদ্ধ হাত ছুড়তে-ছুড়তে সতীর্থদের দিকে দৌড় শুরু করে দিতে। ভারতে এসে ভারতের টুঁটি চেপে প্রথম ইনিংস ২০১ রানে শেষ, কম কথা নয়। দক্ষিণ আফ্রিকা নামবে এ বার। গোটা কুড়ি ওভার খেলতে হবে। স্কোরটা যদি দিন শেষে বিনা উইকেটে পঞ্চাশ বা এক উইকেটে সত্তর তুলে রাখা যায়, টেস্টের দ্বিতীয় দিনে কে চাপের সমুদ্রে, গণনা অনাবশ্যক। কিন্তু নেমেই একটা গেল। দশ তুলতে না তুলতে দু’টো। পঞ্চাশ দূরের স্টেশন, দিন শেষে পকেটে টেনেটুনে আঠাশ।

শেষ পর্যন্ত? কেন, টেস্ট তিন দিনে শেষ!

জামথা, ২৫ নভেম্বর, ২০১৫...

সাইমন হার্মারের ওই টার্ন বোঝা অমিত মিশ্রের সাধ্য ছিল না। মিডল স্টাম্পে পড়ে প্যাডে চকিত ঢুকে এল। এবি ডে’ভিলিয়ার্স দৃকপাত না করে ততক্ষণে হার্মারকে জড়িয়ে ধরেছেন। প্রথম ইনিংসে ভারত আবার আড়াইশো পেরোয়নি, শেষ এ বার ২১৫ রানে। দিনের খেলা শেষ হতে আর দশ ওভার। হাতে দশ উইকেট রেখে দ্বিতীয় দিনে অবতরণের অর্থ, টেস্ট ভাগ্যকে অন্তত ‘ডিউসে’ নিয়ে ফেলা যাবে। আর ডিউস! নেমে এ বারও শুরুতে সেই একটা, দশ ওভারের মধ্যে দু’টো। ওপেনার ও ‘রাত-প্রহরী’। আর হ্যাঁ, দিন শেষে এ বার কুড়িও নয়।

শেষ পর্যন্ত? কেন, টেস্ট তিন...

কুড়ি দিন। কয়েকশো মাইল দূরত্বের দু’টো ক্রিকেট সেন্টার। দু’টো আলাদা সেট-আপ, ভিন্ন কিউরেটর। কিন্তু চিত্রনাট্য থেকে ম্যাচের গতিপ্রকৃতি, কোথাও গিয়ে যেন এক। প্রথম সেশন থেকে দুরন্ত ঘূর্ণি, সামলাতে গিয়ে দুঁদে ব্যাটসম্যানের নটরাজ-নৃত্য। সেঞ্চুরি কেন, হাফসেঞ্চুরিও আসছে না। বরং স্পিন-মাইনে পড়ে এক দিনে উড়ে যাচ্ছে বারোটা! দলজিত্‌ সিংহ ও অমর কারলেকর যতই দু’টো আলাদা ক্রিকেট সংস্থার কিউরেটরের নাম হোক, একটা ব্যাপার তাঁরা বুধবার বুঝিয়ে দিয়েছেন।

যাহা পঞ্জাব, তাহা নাগপুর!

কোনও টেস্টের প্রথম দিনে যদি বারোটা উইকেট পড়ে, পিচ ব্যাটসম্যান না বোলার কার বন্ধু, অনুমেয়। বরং এ দিন সকালে পিচ রিপোর্ট করতে গিয়ে সুনীল মনোহর গাওস্করের মন্তব্য শুনলে ক্রিকেট-রসিকদের ভাল লাগবে। গাওস্কর বললেন যে, নাগপুর পিচ দেখে তাঁর একটাই কথা মাথায় আসছে। এর কোল্ড-ক্রিম দরকার! উপমা হিসেবে অসাধারণ। কারণ খেলা শুরু হওয়ার আগে পিচের যা চেহারা দেখা গেল, গা শিরশিরিয়ে উঠতে পারে। ঠিক মধ্যিখানে অসংখ্য ক্ষুদ্র ফাটল। শুকনো, খসখসে একটা সারফেস, যা ক্রমাগত ইঙ্গিত দিচ্ছে আগামী পাঁচ দিনে কী দাঁড়াবে। মর্নি মর্কেল আজ বিরাট কোহলি-অজিঙ্ক রাহানে সহ যে তিন উইকেট তুললেন, তা সম্পূর্ণ নিজের ক্ষমতায়। পিচের ন্যূনতম আনুকূল্য তিনি পাননি। পিচ চরিত্র বুঝতে তাই সওয়া ছ’ফুটের আফ্রিকা পেসারের দুর্ধর্ষ তৃতীয় স্পেল ধরলে চলবে না। ধরতে হবে অন্য একটা ছবিতে। দিনের দশম ওভার। হার্মারের অফস্পিন পড়ে মাটির চাপড়া তুলে চলে গেল!

একটা প্রশ্ন তুলে।

দেশের মাটিতে ডিজাইনার উইকেট তৈরিতে কোনও অপরাধ নেই। দক্ষিণ আফ্রিকাও ডারবানে ভারতের বিরুদ্ধে নামলে স্কোয়ার টার্নার বানাবে না। কিন্তু টিমের ব্যাটিং? ভারত জিতছে ঠিকই, কিন্তু ব্যাটসম্যানদের রান কোথায়? গোটা সিরিজে আজ পর্যন্ত চারটে ইনিংস খেলে ফেলেছে ভারত। কিন্তু একটাও সেঞ্চুরি আসেনি। সর্বোচ্চ চেতেশ্বর পূজারার মোহালির সাতাত্তর। এ দিন তো অর্ধশতরানও কেউ পেরোতে পারলেন না। ইনিংসে সর্বোচ্চ রান হল আজকের ২১৫। ডিজাইনার উইকেটে টিমের সার্বিক লাভ তা হলে হচ্ছে তো? ভারত জিতছে ঠিকই, কিন্তু টিমের ব্যাটিংকে অসীম প্রতিবন্ধকতার গহ্বরে ফেলে দেওয়া হচ্ছে না তো?

সাংবাদিক সম্মেলনে বসে সঞ্জয় বাঙ্গার মোটামুটি ঝাঁঝরা হয়ে গেলেন। আপনি মনে করেন, এই উইকেটে ভাল টেস্ট-যুদ্ধ হওয়া সম্ভব? আপনার মনে হয় না ব্যাটসম্যানরা জঘন্য করছেন? রোহিত শর্মাকে আর কত দিন টেস্টে টানবে টিম? ভারতীয় ব্যাটিং কোচ প্রথমে ব্যাকফুটে, পরে আক্রমণাত্মক। বললেন যে, নাগপুর উইকেট যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। ব্যাটসম্যানের পক্ষে এ সব পিচে সব সময় রানের মৃগয়া করে যাওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। বরং মিডিয়াকে মেনে নিতে হবে যে, গোটা সিরিজটাই লো স্কোরিং হচ্ছে। ব্যাটিং নিয়ে অহেতুক দোষারোপের তাই কোনও মানে নেই।

বাঙ্গারের এই মতবাদের পক্ষে-বিপক্ষে দু’রকম বক্তব্যই পাওয়া যাচ্ছে। গাওস্কর যেমন এক টিভি চ্যানেলে বলেছেন, বিজয় বাদে ভারতীয়রা গড়পড়তার থেকেও খারাপ ব্যাটিং করেছে। কারও কারও ভিন্নমতও আছে। দিলীপ বেঙ্গসরকর ম্যাচটা দেখেননি। এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্যের রাস্তায় যেতে চাইলেন না। কিন্তু এরাপল্লি প্রসন্ন বললেন। ফোনে প্রাক্তন অফস্পিনার বললেন, “আমি মানছি এমন পিচে টিমের ব্যাটিং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু আমরা তো জিতছিও।” একটু থেমে ফের যোগ করলেন, “আর আমার মনে হয় না এতে ব্যাটসম্যানের আত্মবিশ্বাসে আঘাত লাগবে। কারণ ওরা জানে, এটাই ওদের স্ট্র্যাটেজি। নিজেরা দু’শো তুললে দক্ষিণ আফ্রিকাকে একশোয় শেষ করে দাও।” কিন্তু তার পরেও বাঙ্গারের একটা তত্ত্ব বিশ্বাস করা কঠিন। ওই যে, ভারতীয় ইনিংসের উইকেটগুলো নাগপুরের চ্যালেঞ্জিং উইকেট নিয়েছে।

স্বয়ং ক্যাপ্টেন কোহলি যেমন। অফস্টাম্প লাইনে পড়ে যে সব ডেলিভারি বাইরে যায়, তাতে সামান্য হলেও ভারতের টেস্ট অধিনায়কের দুর্বলতা আছে। গত ইংল্যান্ড সফরের নথি তার প্রামাণ্য। মর্নি মর্কেল এ দিন ভারতের তিন সেরা হিরে-জহরতকে তুললেন। যার মধ্যে মুরলী বিজয়েরটা ‘আনপ্লেয়বল’ ছিল। রাহানেরটাও মারাত্মক। কিন্তু কোহলি পারতেন বলটা ছেড়ে দিতে। শিখর ধবন যে ভাবে ব্যাক টু দ্য বোলার লোপ্পা তুলে গেলেন, তার পিছনেও পিচের ‘কুকীর্তি’ নেই। আর রোহিত শর্মা? গোটা তিরিশেক বল খেলে ২ করলেন, বিরাট খোঁচা দিয়েও দাঁড়িয়ে থাকলেন অসন্তুষ্ট ভাবে।

বাঙ্গারের তত্ত্ব আরও একটা জায়গায় কঠোর ধাক্কা খাবে। ঋদ্ধিমান সাহা নামের এক দেওয়ালে। সীমিত ক্ষমতা নিয়েও কিন্তু বঙ্গসন্তান দেখিয়ে গেলেন, ধৈর্য থাকলে এই পিচেও একশোটা বল খেলে দেওয়া যায়। ঋদ্ধি এ দিন রান বেশি করেননি। ৩২। কিন্তু তাঁর ওটুকু ব্যালান্সই ভারতের অ্যাকাউন্টে দু’শো রান জমা করেছে। মর্কেলের ঘণ্টায় একশো পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটারের আগুনে পেস, স্পিনের ছোবল বাঙালিকে কম আক্রমণ করেনি। তার পরেও ঋদ্ধি দেখিয়েছেন, কোনও এক হার্মারকে চার উইকেট দেওয়ার প্রয়োজন ছিল না।

যদিও হার্মারের এক-একটা উইকেট টেস্টের ভবিষ্যত্‌ সম্পর্কেও আন্দাজ দিয়েছে। বুঝিয়েছে, হার্মার নাচিয়ে গেলে অশ্বিন-জাডেজা-মিশ্র কতটা কাঁদাতে পারেন। আমলাদের সমস্যাও বাড়ছে। টিমের ব্যাটসম্যানরা এখন থেকেই ব্যাকফুটে অশ্বিনদের স্পিন ম্যানেজ করার ভুল প্রচেষ্টায় নেমে পড়েছেন। প্রথম ড্রিঙ্কস ব্রেকে যে উইকেটে মাঠ-কর্মীদের ঝাঁট দিতে হয়, সেখানে যা অচল। আরও আছে। টিমের এক নম্বর বোলার বিকেলের দিকে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। শোনা গেল, আইসপ্যাকও নিয়েছেন।

মর্নি মর্কেলের হ্যামস্ট্রিংয়ে টান ধরেছে। টেস্টে আর পারবেন কি না, কে জানে।

স্কোর

ভারত প্রথম ইনিংস: বিজয় এলবিডব্লিউ মর্কেল ৪০, ধবন ক ও বো এডগার ১২, পূজারা এলবিডব্লিউ হার্মার ২১, কোহলি ক ভিলাস বো মর্কেল ২২, রাহানে বো মর্কেল ১৩, রোহিত ক ডে’ভিলিয়ার্স বো হার্মার ২, ঋদ্ধিমান ক দুমিনি বো হার্মার ৩২, জাডেজা বো রাবাদা ৩৪, অশ্বিন বো তাহির ১৫, মিশ্র এলবিডব্লিউ হার্মার ৩, ইশান্ত ন.আ. ০, অতিরিক্ত ২১, মোট ২১৫। পতন: ৫০, ৬৯, ৯৪, ১১৫, ১১৬, ১২৫, ১৭৩, ২০১, ২১৫। বোলিং: মর্কেল ১৬.১-৭-৩৫-৩, রাবাদা ১৭-৮-৩০-১, হার্মার ২৭.২-২-৭৮-৪, এলগার ৪-০-৭-১, তাহির ১২.৫-১-৪১-১, দুমিনি ১-০-৬-০।

দক্ষিণ আফ্রিকা প্রথম ইনিংস: এলগার ন.আ. ৭, ফান জিল ক রাহানে বো অশ্বিন ০, তাহির বো জাডেজা ৪, আমলা ন.আ. ০, অতিরিক্ত ০, মোট ১১-২। পতন: ৪, ৯। বোলিং: ইশান্ত ২-১-৪-০, অশ্বিন ৪-২-৫-১, জাডেজা ৩-১-২-১।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE