Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

অ্যাডিলেড ওভালের মায়াবী দিনে ক্রিকেটে অমরত্ব পেয়ে গেল ৬৩ ক্রমিক সংখ্যা

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ক’দিন ধরে কাগজে বিজ্ঞাপন দিচ্ছিল, ফিল হিউজের সঙ্গে জীবন কাটাতে চলুন অ্যাডিলেড মাঠে! ফিল হিউজ তো আর বেঁচে নেই। তাঁর সঙ্গে জীবন কাটাতে যাওয়া, মানে প্রায় জয়ের কবিতার ঢঙে বলা, পাগলি তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবন কাটাব/ পাগলি তোমার সঙ্গে মাংস-রুটি কাটাব জীবন। ফিলিপ হিউজ আর গদ্যের বাস্তববাদী ভাষা হতে পারেন না। তাঁকে নিয়ে বাঁচা একমাত্র কবিতার আশ্রয়েই সম্ভব! আর মঙ্গলবারের অ্যাডিলেড ওভাল অবিমিশ্র ক্রিকেট কবিতার দিন ছিল!

হিউজ-স্মরণে। টেস্ট শুরুর আগে সেই ৬৩ সেকেন্ড। ছবি: এএফপি

হিউজ-স্মরণে। টেস্ট শুরুর আগে সেই ৬৩ সেকেন্ড। ছবি: এএফপি

গৌতম ভট্টাচার্য
অ্যাডিলেড শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৫৬
Share: Save:

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া ক’দিন ধরে কাগজে বিজ্ঞাপন দিচ্ছিল, ফিল হিউজের সঙ্গে জীবন কাটাতে চলুন অ্যাডিলেড মাঠে!

ফিল হিউজ তো আর বেঁচে নেই। তাঁর সঙ্গে জীবন কাটাতে যাওয়া, মানে প্রায় জয়ের কবিতার ঢঙে বলা, পাগলি তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবন কাটাব/ পাগলি তোমার সঙ্গে মাংস-রুটি কাটাব জীবন। ফিলিপ হিউজ আর গদ্যের বাস্তববাদী ভাষা হতে পারেন না। তাঁকে নিয়ে বাঁচা একমাত্র কবিতার আশ্রয়েই সম্ভব!

আর মঙ্গলবারের অ্যাডিলেড ওভাল অবিমিশ্র ক্রিকেট কবিতার দিন ছিল! সময় সময় মনে হচ্ছিল, চোখের সামনে যা ঘটতে দেখছি, বাস্তব? এ তো এত দিনকার সনাতনী ক্রিকেট দৃশ্যকেই ভেঙেচুরে ভিন্নগ্রহের ক্রিকেট উপত্যকায় নিয়ে চলেছে।

শুকনো গদ্য জানাচ্ছে, অ্যাডিলেড মাঠে আজ পর্যন্ত ভারত-অস্ট্রেলিয়া প্রথম দিনের খেলা দেখতে এত লোক আসেননি, মঙ্গলবার যা ছিল! চিরাচরিত বক্স অফিসের হ্যামলিনকে এ বার সঙ্গে আনেনি ভারত। অস্ট্রেলিয়ার মাঠে বাইশ বছর বাদে ছোট মরাঠি ছায়াটা গার্ড নেবে না। কিন্তু তাতে কী? কবিতা আবার কবে যুক্তির তোয়াক্কা করেছে? তার কাজ নির্ভার ভেসে বেড়ানো। যে যা মানে করতে চায় করুক! আর এমনিতেও মঙ্গলবার এমন একটা উপলক্ষ্য যে ভাবীকালকে বলা যাবে, আমিও সে দিন ওখানে ছিলাম। চোখের জলে গ্যালারি ভাসিয়েছিলাম।

কয়েক হাজার মাইল দূরে মুম্বইয়ে থেকেও তিনি, সচিন তেন্ডুলকর, অ্যাডিলেড-ভাবনায় ফিরে এলেন বারবার। সেটা ব্যাটিং নয়, ব্যাটিং গর্বের সীমান্ত ছুঁয়ে তাঁর ওই মায়াবী প্রতিক্রিয়ার জন্য! ব্রিস্টলে উনিশশো নিরানব্বইয়ের বিকেল থেকে যা তিনি পেটেন্ট করে নিয়েছিলেন। সেঞ্চুরির পর আকাশে মুখ তুলে মেঘের মধ্যে নিজের বাবাকে খোঁজা। ক্রিকেটমাঠের চির লড়াকু অস্ট্রেলীয়রা মঙ্গলবারের অ্যাডিলেড থেকে একই শরীরী ভাষা বেছে নিল।

তফাতের মধ্যে পঞ্চাশ নয়। সেঞ্চুরিও ততটা নয়। তাদের ম্যাজিক সংখ্যাটা হল ৬৩। জীবনের শেষ ইনিংসে ফিল হিউজ ৬৩ নট আউট থেকে গিয়েছিলেন। সেই থেকে ৬৩ ক্রমিক সংখ্যাটা বাড়তি মমত্বের দাবি নিয়ে এ দিন ক্রিকেটে উঠে এল! মাঠের বাইরে হিউজের অঘোষিত মেমোরিয়ালে যে এ দিন সকাল থেকে আরও ফুল উপচে পড়বে। অত মোটা আর বাঁধানো ভিজিটার্স বুকটা মন্তব্যে-মন্তব্যে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম করবে। জানা কথা। অস্ট্রেলীয় প্লেয়াররা মাঠের ধারে তাঁদের ব্যাটগুলো সব ঝুলিয়ে রেখে তার ওপর ব্যাগি গ্রিন চাপা দিয়ে শেষ গার্ড অব অনার দেবেন, সেটাও আন্দাজের সরণিতে সীমাবদ্ধ ছিল।

কিন্তু যেই দুটো টিমের সারিবদ্ধ পাশে দাঁড়ানো অবস্থায় হিউজ ভিডিও আর সঙ্গে রিচি বেনোর ধারাভাষ্য শুরু হয়ে গেল, দৃশ্যপট ছড়িয়ে গেল সীমা থেকে অসীমে। যেন শ্রাদ্ধে অন্তিম মন্ত্রোচ্চারণ করছেন এমন ক্রিকেট রাজপুরোহিতের ভঙ্গি বেনোর কণ্ঠস্বরে ফিলিপ হিউজ ফর এভার! রেস্ট ইন পিস, সন। এই জায়গাটা গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো এবং বিশ্ব ক্রিকেটে একমাত্র বেনোকেই মানায় হে পুত্র, শান্তিতে বিশ্রাম নাও!

গ্যালারিতে দেখলাম অনেকে কাঁদতে শুরু করেছেন। সেই চোখের জল গড়াতে না গড়াতেই ঘোষকের আমন্ত্রণে গোটা স্টেডিয়াম জুড়ে শুরু হল ৬৩ সেকেন্ডের হাততালি। চিরকাল সবাই জেনে এসেছে, মৌন পালনই মৃতের আত্মার প্রতি সেরা শ্রদ্ধার্ঘ্য। পৃথিবীর কোনও স্পোর্ট কখনও হাততালি দিয়ে কাউকে অঘোষিত গান স্যালুট দেয়নি। অথচ কী মায়াবী সেই ৬৩ সেকেন্ডের ‘তোপধ্বনি’! ভারতে তখন ভোর সওয়া পাঁচটা। লোকে মর্নিং ওয়াকেও বেরোয়নি। আর এখানে লাইনে পরপর দাঁড়ানো দুটো টিম, গোটা মাঠের দর্শক, টিম ম্যানেজার-কোচ, চ্যানেল নাইন ভাষ্যকার, স্টার টিভির কমেন্টেটর, গোটা প্রেসবক্স অনবরত হাততালি দিয়ে চলেছে। সেটা থামানো হবে ৬৩ সেকেন্ড পরে।

ক্রিকেট ইতিহাসে কোনও বিশাল অধ্যায়ের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সিডনি বা মেলবোর্নের মতো কৌলীন্য নেই এ মাঠের! বডিলাইন সিরিজে বার্ট ওল্ডফিল্ডের ভয়ঙ্কর চোট পাওয়া বাদ দিলে অ্যাডিলেড ওভাল স্বীকৃত একমাত্র বল বাই বল ধারাভাষ্যের আদিম জনক হিসেবে। ১৯২৫ সালে এ মাঠ থেকেই ক্রিকেটের প্রথম ধারাভাষ্যের সূচনা।

ঊননব্বই বছর পর সূচনা হল ক্রিকেটে নতুন ক্রমিক সংখ্যারও। ৬৩। প্রয়াত ক্রিকেটারকে বিশ্বের বিভিন্ন মাঠ এখন এই সংখ্যা দিয়েই হয়তো আবেগ ভরা স্মরণ করবে। ডেভিড ওয়ার্নার হাফসেঞ্চুরি করেই আকাশের দিকে ব্যাট তুলে বন্ধুকে স্মরণ করবেন বোঝা গেল। তেন্ডুলকরের ব্রিস্টল ফিরে এল মেঘেদের মাঝে। কিন্তু ৬৩ করার পর ফের ব্যাট তুললেন প্রিয় বন্ধু স্মরণে। এ বার আরও জোর হাততালি।

মাইকেল ক্লার্ক নামলেন এমন অভিনন্দনের মধ্যে, যেন স্টিভ ওয় শেষ ইনিংস খেলার জন্য এসসিজি মাঠে পা দিলেন। মাত্র ক’দিন আগেও ক্যাপ্টেনের চাকরি থাকছিল না, তাঁর এমন ছিন্নমস্তা অবস্থা ছিল। কিন্তু ফিল হিউজ মৃত্যু পরবর্তী ক্রমাঙ্কে নিজেকে বৃহত্তর অধিনায়ক হিসেবে তুলে ধরা আর ম্যাক্সভিলের বারবার কান্নাভেজা সাড়ে পাঁচ মিনিটের বক্তৃতাটা ক্লার্ককে নিজের দেশে অসামান্য শ্রদ্ধার বেদীতে বসিয়েছে। বলা হচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের ওবামা-বক্তৃতা। ওবামার তবু প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে লিঙ্কন স্পিচ পাওয়া যাবে। বা ওয়াশিংটনের। অস্ট্রেলিয়া বলছে, হিউজের অন্ত্যেষ্টিতে দেওয়া ক্লার্কতুল্য বক্তৃতা আজ অবধি অস্ট্রেলিয়ার কোনও ক্রীড়াবিদ কোনও শতাব্দীতে কখনও দেয়নি। বলছে, ক্লার্ককে দেখে রাজনীতিবিদদের শিক্ষা নেওয়া উচিত, কী ভাবে জনজীবনে নিজেকে ক্যারি করতে হয়।

ক্লার্ক-বিরোধীরা বলে চলেছেন, সেটা ঠিক। রাজনীতিবিদদের ওকে দেখে শেখাই উচিত। নিজের অসহনীয় পরিস্থিতি কী ভাবে শোকের মধ্যে ঘুরিয়ে নিল। কিন্তু সে সব অন্য দিনের কথা। আজ প্রকাশ্যে কারও বলার হিম্মত নেই। ও দিকে হিউজ রূপকথার ধারক তিনি ক্লার্ক আর বাহক ওয়ার্নার, দু’জনেই একসঙ্গে ক্রিজে। পার্টনারশিপে প্রচুর রান তুলছেন, অ্যাডিলেডের ত্রয়োদশ ব্যক্তি-সহ টিম অস্ট্রেলিয়ায় এঁরাই ছিলেন অবিচ্ছেদ্য ত্রিভুজ। ওয়ার্নার ৬৩ করে যেমন ব্যাট তুললেন, তেমনই ক্লার্ক ব্যাট ওঠালেন ৩৭ করে। মানে ১০০ থেকে আর ৬৩ রান দূরে। খেলার পর অজি সাংবাদিকরাও গবেষণা করে যাচ্ছিলেন, পুরো অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট গ্রীষ্ম জুড়েই কি এটা চলবে? ৫০ ছেড়ে লোকে ৬৩-র উপাসনা করবে? অনেকে বললেন, ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া শতবার্ষিকী টেস্টে যেমন হুবহু একশো বছর আগের রেজাল্টটাই ঘটেছিল, তেমনই অস্ট্রেলিয়া যদি টেস্ট ম্যাচটা ইনিংস ও ৬৩ রানে জেতে?

কেউ কেউ আর এক পা এগিয়ে ভাবছেন, উইকিপিডিয়া কি ক্রিকেটের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ৬৩-কে শিগগির স্বীকৃতি দেবে? আইসিসি যেমন মৃতকে ত্রয়োদশ ব্যক্তি হিসেবে মেনে নিয়েছে, তেমনই ৬৩-ও আনুষ্ঠানিক ভাবে সিদ্ধ হয়ে যাবে? রাতে খেলার পর অ্যাডিলেড মাঠের বিখ্যাত সাউথ গেটের বাইরে দেখলাম, বিশাল বিশাল বিলবোর্ডে সেঞ্চুরির পরে ওয়ার্নার লাফ দিয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছেন, সেই ছবিটা জ্বলজ্বল করে শোভা পাচ্ছে। তার নীচে ছোট করে লেখা ৬৩। এই সংখ্যাটা কি তা হলে সত্যিই নিপাতনে সিদ্ধ হয়ে যাবে?

সেঞ্চুরি করে মেঘের দেশে বন্ধুকে খুঁজলেন ওয়ার্নার। ছবি: গেটি ইমেজেস

কারও কাছে উত্তর নেই। সচিনের বিশ্বকাপে সেই ব্রিস্টল ম্যাচটা মাঠে বসে দেখে মনে হয়েছিল, শেক্সপিয়রের মধ্যগ্রীষ্মের রূপকথা। রোম টেনে বুঝতে হয় যে সত্যি চোখের সামনে ঘটছে। ওয়ার্নারের অ্যাডিলেডকেও তেমনই মনে হল। ১৪৫ করে যখন তিনি ড্রেসিংরুমে ফিরে যাচ্ছেন, আবার মেঘের দিকে ব্যাট তুললেন। কিন্তু তাঁর সম্ভাব্য ম্যাচ জেতানো সেঞ্চুরিতেও ৬৩-র মাহাত্ম্য যে বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ হয়নি, বোঝা গেল এর পর স্টিভ স্মিথ ৬৩ করার পর। আরও জোর হাততালি।

ভারত ম্যাচ বাঁচাতে পারবে কি না এমন সরল প্রশ্নের চেয়েও বেশি করে জল্পনা চলছে, ভারতীয় ব্যাটসম্যান ৬৩ করলে সে-ও কি সমান অভিনন্দন পাবে? অজি প্রেসবক্স বলছে, পেতেও পারে।

৬৩ সংখ্যাটা ক্রিকেটের রাজদরবারে ঢুকেই পড়ল মনে হচ্ছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE