Advertisement
১০ জুন ২০২৪
দাবা-লড়াইয়ে বসেও মন দেশের আসল যুদ্ধে

ইউক্রেনের সম্পদ লুঠতে চায় রাশিয়া

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাঁধল না তো? পরিস্থিতি কি হাতের বাইরে চলে গেল? দুশ্চিন্তাগুলো কিছুতেই যাচ্ছে না সের্গেই ফেডেরচুকের। দেশ থেকে প্রায় ছ’হাজার কিলোমিটার দূরে বসে প্রতি মুহূর্তে ইউক্রেনের দাবাড়ুকে খোঁজ নিতে হচ্ছে ফোনে কিংবা ইন্টারনেটে। পেশাদার কেরিয়ারে এ রকম সমস্যায় আগে পড়েননি। চৌষট্টি খোপের যুদ্ধে নামার পরেও দেশে আসল যুদ্ধের সম্ভাবনার কারণে পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তা কিছুতেই মন থেকে সরিয়ে ফেলতে পারছেন না আলেখিন চেস ক্লাবে প্রথম বার গ্র্যান্ডমাস্টার টুর্নামেন্ট খেলতে আসা ফেডেরচুক।

ইউক্রেনের গ্র্যান্ডমাস্টার সের্গেই ফেডেরচুক। এখন কলকাতায়।

ইউক্রেনের গ্র্যান্ডমাস্টার সের্গেই ফেডেরচুক। এখন কলকাতায়।

শমীক সরকার
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৪ ০৩:৪৩
Share: Save:

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাঁধল না তো? পরিস্থিতি কি হাতের বাইরে চলে গেল? দুশ্চিন্তাগুলো কিছুতেই যাচ্ছে না সের্গেই ফেডেরচুকের। দেশ থেকে প্রায় ছ’হাজার কিলোমিটার দূরে বসে প্রতি মুহূর্তে ইউক্রেনের দাবাড়ুকে খোঁজ নিতে হচ্ছে ফোনে কিংবা ইন্টারনেটে।

পেশাদার কেরিয়ারে এ রকম সমস্যায় আগে পড়েননি। চৌষট্টি খোপের যুদ্ধে নামার পরেও দেশে আসল যুদ্ধের সম্ভাবনার কারণে পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তা কিছুতেই মন থেকে সরিয়ে ফেলতে পারছেন না আলেখিন চেস ক্লাবে প্রথম বার গ্র্যান্ডমাস্টার টুর্নামেন্ট খেলতে আসা ফেডেরচুক। “সত্যিই ভীষণ চিন্তায় আছি। আমার বাবা-মা, বোন থাকে ভিনিটসায়। পশ্চিম ইউক্রেনে আমাদের শহরটা রাজধানী কিয়েভের কাছেই। প্রতিদিন ফোন করছি। সবার খোঁজ নিচ্ছি। ইন্টারনেটে খবর দেখি। কলকাতায় বসে প্রার্থনা করে চলেছি, পরিস্থিতি খারাপ দিকে না যায়।”

গত মাসে প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের গণ-বিক্ষোভের পর থেকেই ইউক্রেনের দিকে নজর গোটা বিশ্বের। ফেডেরচুক-ও ব্যতিক্রম নন। ইয়ানুকোভিচ জোর করে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেও পারেননি। পুলিশ আর বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে হতাহত প্রচুর। বিরাট ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ায় পালিয়ে গিয়েছেন। আর্সেনি ইয়াতসেনয়ুকের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে অস্থায়ী সরকার। কিন্তু পরিস্থিতি আদৌ শান্ত হয়নি। রাশিয়াও স্বীকৃতি দেয়নি নতুন সরকারকে। উল্টে ইউক্রেনের দখলে থাকা ক্রাইমিয়ায় সেনা নামিয়ে দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। যা নিয়ে এখনও দু’দেশে চাপা উত্তেজনা। পরিস্থিতি যে কোনও দিন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে পারে। “আসলে রাশিয়া চায় ইউক্রেন আর আশপাশের দেশগুলোকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে। তাই ওদের এই দাদাগিরি। ইয়ানুকোভিচের দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ হয়েই মানুষ প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু ইয়ানুকোভিচ সরার পরেও পরিস্থিতি বদলায়নি। যে অস্থায়ী সরকার এখন দেশ চালাচ্ছে তাঁরাও দুর্নীতিগ্রস্ত,” বুধ-সন্ধ্যায় গোর্কি সদনে বলছিলেন ফেডেরচুক।

সেখানে সেনা ঢুকিয়ে দেওয়ার পরে ক্রাইমিয়ার সাধারণ মানুষ রাশিয়াকে সমর্থন করছে বলে প্রচার হলেও তা মানতে চান না তেত্রিশ বছরের দাবাড়ু। “ক্রাইমিয়ায় কিছু মানুষ রাশিয়াকে সমর্থন করছে ঠিকই। কিন্তু বেশির ভাগই ওদের বিরুদ্ধে। রাশিয়া ক্রাইমিয়ার দখল চায়। তার পর ইউক্রেনের,” বলে দেন তিনি। আমেরিকা, ইউরোপের শক্তিশালী রাষ্ট্রের জোট ইতিমধ্যেই ক্রাইমিয়ায় সেনা নামানোর জন্য রাশিয়াকে জি-এইট রাষ্ট্রজোট থেকে সাসপেন্ড করেছে। “রাশিয়া আমাদের সাহায্য করছে বলে প্রচার করে। কিন্তু সেটা ঠিক নয়। ওরা আসলে চায় ইউক্রেনের প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠতে। বিদুৎ, জল আর খাদ্যের ভাণ্ডার রয়েছে ইউক্রেনে। সেটা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনাই লক্ষ্য ওদের,” বলেন ফেডেরচুক।

দেশের অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে ইউক্রেনের খেলোয়াড়রা মুখ খোলা শুরু করে দিয়েছেন। ক’দিন আগেই ইউক্রেনের হেভিওয়েট বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভ্লাদিমির ক্লিশকো বলেছেন, ‘‘এ ভাবে রাশিয়া অন্য দেশে জোর করে প্রভাব খাটাতে পারে না। এটা ইউক্রেনের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। আমরা কী ভাবে চলব সেটা রাশিয়া ঠিক করে দিতে পারে না।” ফেডেরচুক সমর্থন করছেন ক্লিশকোকে। “রাশিয়া যদি সত্যিই আমাদের সাহায্য করতে চায় তা হলে সেনা না ঢুকিয়েও করা যেতে পারে। ওরা আমাদের দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারের জায়গায় স্বচ্ছ প্রশাসন গঠনে সাহায্য করতে পারত।”

আট বছর ধরে প্যারিসে থাকলেও দেশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে প্রাক্তন অনূর্ধ্ব-১৪ ইউরোপ চ্যাম্পিয়নের। ইউক্রেনের আন্দোলনের ঠিক আগেই তিনি প্যারিসে ফিরে আসেন। তাই পৃথিবীর যে প্রান্তেই টুর্নামেন্ট খেলুন না কেন চিন্তা লেগেই রয়েছে। “রাশিয়াকে ইউক্রেনের অধিকাংশ মানুষই সমর্থন করে না। আমাদের তো আশঙ্কা রাশিয়া ইউক্রেন দখল করে নিলে জিনিসপত্রের দাম হু-হু করে বেড়ে যাবে। কে-ই বা সেটা চায় বলুন,” বলেন ফেডেরচুক।

ভ্লাদিমির পুতিনের সেনা যাই করুক না কেন তা বলে রাশিয়ান বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়নি ফেডেরচুকদের। কলকাতা গ্র্যান্ডমাস্টার টুর্নামেন্টে রাশিয়ার দাবাড়ু লান্ডা কনস্ট্যানটিন খেলছেন। প্রত্যেক দিনই ম্যাচের পর দুই বন্ধুর আড্ডায় ছেদ পড়েনি। বরং এ দিন ফিলিপিন্সের এক দাবাড়ুর কাছে কন্যস্ট্যানটিনের হারের পর বন্ধুর কাছেই হতাশা জানিয়ে যান। ফেডেরচুক কিছুক্ষণ তাঁর সঙ্গে কথা বলার পর বললেন, “কনস্ট্যানটিন হেরে গিয়ে কিছুটা হতাশ। সেটাই বলে গেল। ও আমার মতো প্যারিসেই থাকে।” তার পরেই কিছুটা উত্তেজিত, “আমরা এখনও আশা করছি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। যুদ্ধ হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে না। মাসখানেক তো হল। পরিস্থিতিটা ঠিক পাল্টাবে দেখে নেবেন।” বোঝা গেল এই ফেডেরচুক দাবাড়ুর থেকেও বেশি কারও ভাই, কারও সন্তান। যিনি দাবার যুদ্ধের মধ্যেও দেশে শান্তি ফিরে আসার আশায়। ‘শত্রু’ দেশের দাবাড়ুর সঙ্গেও মিত্রতা বজায় রাখতে যাঁর এতটুকু আপত্তি নেই। তাই তো কথা শেষ হতেই কনস্ট্যানটিনের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠতে দেরি হল না।

যেন বুঝিয়ে দিলেন, পুতিনরা যতই চেষ্টা করুক না কেন ইউক্রেনের মানুষ চলবে স্বমেজাজে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

chess
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE