Advertisement
০৫ মে ২০২৪

ইতিহাস আর পাকিস্তানের মধ্যে আজ দাঁড়িয়ে ভারতীয় বোলিং

শহর হিসেবে অ্যাডিলেড এত ছোট যে, কোনও ট্যাক্সি ড্রাইভারকে যদি বলা যায় যে, ভাই গোটা শহরটা একটু ঘুরিয়ে দেখাও তো। সে আড়াই ঘণ্টায় ‘ফুল কন্ডাক্টেড ট্যুর’ শেষ করে দেবে! অ্যাডিলেড শহরটা উত্তর থেকে দক্ষিণ ৫৮ কিলোমিটার, আর পুব থেকে পশ্চিমে মাত্র ১৭ কিলোমিটার! অ্যাডিলেড ওভাল মাঠটাও ঠিক তাই। পৃথিবীর বেশির ভাগ ক্রিকেট মাঠ যেখানে বর্গক্ষেত্র, সেখানে ব্র্যাডম্যানের পাড়ার মাঠ বরাবরই আয়তক্ষেত্র! লম্বায় অনেক বেশি। সাইড বাউন্ডারি খুব ছোট। প্রাক্-বিশ্বকাপ এগজিট পোলের দু’টো হিসেব শনিবার হুবহু মিলে গিয়েছে।

তাঁর ব্যাট কি কথা বলবে? অনুশীলনে মগ্ন ধোনি। ছবি: এএফপি

তাঁর ব্যাট কি কথা বলবে? অনুশীলনে মগ্ন ধোনি। ছবি: এএফপি

গৌতম ভট্টাচার্য
অ্যাডিলেড শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৩২
Share: Save:

শহর হিসেবে অ্যাডিলেড এত ছোট যে, কোনও ট্যাক্সি ড্রাইভারকে যদি বলা যায় যে, ভাই গোটা শহরটা একটু ঘুরিয়ে দেখাও তো। সে আড়াই ঘণ্টায় ‘ফুল কন্ডাক্টেড ট্যুর’ শেষ করে দেবে! অ্যাডিলেড শহরটা উত্তর থেকে দক্ষিণ ৫৮ কিলোমিটার, আর পুব থেকে পশ্চিমে মাত্র ১৭ কিলোমিটার!

অ্যাডিলেড ওভাল মাঠটাও ঠিক তাই। পৃথিবীর বেশির ভাগ ক্রিকেট মাঠ যেখানে বর্গক্ষেত্র, সেখানে ব্র্যাডম্যানের পাড়ার মাঠ বরাবরই আয়তক্ষেত্র! লম্বায় অনেক বেশি। সাইড বাউন্ডারি খুব ছোট। প্রাক্-বিশ্বকাপ এগজিট পোলের দু’টো হিসেব শনিবার হুবহু মিলে গিয়েছে। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডকে ফেভারিট দেখাচ্ছে। আর দু’টো দলই তিনশোর উপর রান তুলেছে।

অ্যাডিলেডের সাইড বাউন্ডারি পেয়ে তো ব্যাটসম্যানদের আরওই আহ্লাদে আটখানা হওয়া উচিত। ওটা অব্যর্থ ‘অপারেশন তিনশো’ সাইড বাউন্ডারি। যারা তার সুযোগ যত ভাল নিতে পারবে, তারা ততই দু’পয়েন্ট কুড়নোর লক্ষ্যে এগোবে!

পাকিস্তান যেমন! বরাবর বোলিং দর্পে সাম্রাজ্য জয় করেছে। অ্যাডিলেডে এসে ঠিক উল্টো! ব্যাটিং দর্পে জিততে চায়। তাই পরিকল্পনা নিচ্ছে ইউনিস খানকে দিয়ে ওপেন করানোর। এতে সোহেল মকসুদ এবং উমর আকমল দু’জনকে শুধু খেলানোই যাবে না, প্রথম বল থেকে ভারতীয় বোলিংয়ের উপর সাঁড়াশি চাপ রাখা যাবে।

ভারতও অবশ্যই বসে নেই। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি গত দু’দিন ধরে যেমন ব্যাটিং অনুশীলন করে যাচ্ছেন, তা সচিন না হলেও দ্রাবিড়ের সমতুল্য! সবার সেটা এমনই দৃষ্টি আকর্ষণ করছে যে, শনিবার রাতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে এক জন বলেও এলেন। বিশ্বকাপ এমন বিশালতম মঞ্চ যে, টিমের ভেতর দু’টো সমান্তরাল সুপার পাওয়ারকে এক করে দিয়েছে! ধোনি এ দিনও প্রকাশ্যে বারবার যাঁর মতামত নিলেন এবং নেটে নিজে ব্যাট করার সময় সামনে দাঁড় করিয়ে রাখলেন, তিনি রবি শাস্ত্রী! নতুন এই গাঁটছড়াতেই চমকের অবসান হয়ে যাবে, গ্যারান্টি কে দিল! বরং কে বলতে পারে, টুর্নামেন্টে হঠাত্‌ করে ধোনি ব্যাটিং অর্ডারে উঠে আসবেন না?

অন্য বার ভারত-পাক পূর্বাভাস করতে বললে বিশেষজ্ঞদের স্ট্যান্ডার্ড উত্তর থাকে— এই ম্যাচে বলা যায় না। নার্ভই সব। অস্ট্রেলীয় বিশ্বকাপে এক দিনের ‘উপমহাদেশীয় বিশ্বকাপ’ ব্যতিক্রম মনে হচ্ছে। রাহুল দ্রাবিড়ের পর শুক্রবার সৌরভও বললেন, “ইন্ডিয়া পরিষ্কার ফেভারিট।”

সইদ আজমল, উমর গুলদের না থাকাটা যদি তাত্‌পর্যপূর্ণ হয়, আসল কারণ হল ইতিহাসের দাঁড়িপাল্লা। যাকে সাম্প্রতিক বলে কমিয়ে দেখারও কোনও সুযোগ নেই!

লম্বা একটা সময়— গত ২৬২ মাস ধরেই তো বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সার্বভৌম কর্তৃত্ব! ১৯৯২-এর ৪ মার্চ সেই যে আজহারের ভারত সিডনিতে জিতেছিল, তার পরের তেইশ বছরে দেশে বাবরি মসজিদ ধ্বংস থেকে হর্ষদ মেটার সুটকেস-বিতর্ক, বিজেপির কেন্দ্রে উত্থান থেকে পতন এবং ফের উত্থান, সনিয়া গাঁধীর রাজনীতিতে যোগ দেওয়া থেকে ভয়ঙ্কর উগ্রপন্থী হিসেবে দাউদ ইব্রাহিমের উঠে আসা এবং বাড়বাড়ন্ত, অমর্ত্য সেনের নোবেল জয়, বলিউডে তিন খানের উত্থান, ২৬/১১, ইন্টারনেট— কত কিছু ঘটে গিয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান কিছুতেই বিশ্বকাপে ভারতকে কব্জা করতে পারেনি। তাই রোববার অ্যাডিলেডে প্রথম বল হওয়ার আগে পর্যন্ত তাদের ক্রিকেটে কালা দিবস!

ঠিক যেমন ভারতীয় ক্রিকেটের কালা দিবস ছিল ১৮ এপ্রিল ১৯৮৬! সে দিন শারজায় জাভেদ মিয়াঁদাদের শেষ বল ছক্কায় ভারত অপ্রত্যাশিত ভাবে হারে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। আর তার পর এটা দস্তুরই হয়ে গিয়েছিল যে, যেখানে ভারত সামনে পাকিস্তানকে দেখবে, সেখানেই হারবে! টিমে গাওস্কর-কপিলের মিলিত উপস্থিতিও পরের ক’বছর ভারতকে বাঁচাতে পারেনি। যখন যেখানে দেখা হয়েছে, ভারতকে তুবড়ে দিয়ে পাকিস্তান জিতেছে! সাতাশির বিশ্বকাপে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, গ্রুপে দ্বিতীয় হয়ে সেমিফাইনাল খেলার জন্য লাহৌর যেতে হতে পারে ভারতকে। শুধু এই ভাবনাতেই টিমে এমন ডিপ্রেশন তৈরি হয়ে যায় যে, গাওস্কর তীব্র ব্যঙ্গের সঙ্গে বলেছিলেন, “এখনও তো লাহৌরের টিকিটই হয়নি! এরা ভয়ে অর্ধেক হয়ে গেল!”

পাকিস্তানের সেই একচেটিয়া প্রভুত্ব নিয়ে কথা বলতে গেলে বর্তমান পাক কোচ ওয়াকার ইউনিস যোগ করেন, “অবাক লাগে, এতগুলো ম্যাচ তখন আমরা জিতেছিলাম। কিন্তু ভারতীয় টিভি চ্যানেল খুললে শুধু আমাদের হেরে যাওয়া ম্যাচগুলোই দেখায়! আচ্ছা, এই ম্যাচগুলো কি তা হলে আমরা চাঁদে জিতেছিলাম?”

তখন কে জানত, বিশ্বকাপে এমন এক দিন আসবে, যখন ভারতের বাজার দেখাবে একচেটিয়া! যখন ভারতকে খেলার নামে উল্টে পাকিস্তানের শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বইবে! এমনিতে অ্যাডিলেড ম্যাচ এমন সময়ে হচ্ছে, যখন দু’দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কে গম্ভীর কোনও টানাপড়েন নেই। যখন নরেন্দ্র মোদী ফোন করে নওয়াজ শরিফকে বলতে পারেন যে, আফ্রিদির ছক্কাগুলো দারুণ

ছিল! বা নওয়াজ টুইট করতে পারেন, কোহলি তুমি সত্যিই বড় ব্যাটসম্যান!

দু’দলের সমর্থকদের মধ্যেও সম্প্রীতির বাতাবরণ। প্রচুর ভারত-পাক সমর্থক এ দিন প্র্যাকটিসের সময় ওভালে ঢুকে পড়েন। তাঁদের মধ্যে পাক সমর্থকেরা আরও বেশি করে সুন্দরী মহিলা দেখলেই ছুটে যাচ্ছিলেন, ইনি কি অনুষ্কা? ভ্যালেন্টাইনস ডে-র দিন অনুষ্কা অস্ট্রেলিয়া উড়ে এসেছেন, এ রকম একটা খবর ছড়িয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখানে আগত অনাবাসী পাকিস্তানিদের দেখে বোঝা যাচ্ছে, তাঁরা দেশগত বিদ্বেষ নয়, সবার আগে একটা ভাল ম্যাচ দেখতে চান। সেই দাঁত-নখ বার করা জিঘাংসাটা কিন্তু এ বার দেখছি না। যা বারবারই দু’দেশের খারাপ সম্পর্কের সময় ক্রিকেট মাঠে বেরিয়ে আসে। অ্যাডিলেড আকাশে সেই অসুস্থ মেঘগুলো নেই।

হিংসের মেঘ নেই। চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা-হারার ব্যাপার নেই। দুর্দান্ত ক্রিকেটীয় স্কিলের দেখা নেই তেন্ডুলকর-আজমলরা না থাকায়! ইতিহাসই তাই রোববারের প্রধান এবং একমাত্র থিম!


সাংবাদিক সম্মেলনে ধোনি। অ্যাডিলেড। শনিবার। ছবি: গৌতম ভট্টাচার্য

আর সেটা ঘাঁটতে বসে মনে হচ্ছে ঐতিহাসিক ভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার একটা বড় কারণ সচিন তেন্ডুলকর! ঠিক যেমন অস্ট্রেলেশিয়া কাপ-উত্তর পাঁচ বছর স্থায়ী পাক সাম্রাজ্য স্থাপনের হোতা ছিলেন ইমরান-মিয়াঁদাদ! তেন্ডুলকরের একক প্রভাব অবশ্য তাঁদের চেয়েও বেশি। ৫-০-র তিনটেয় তিনি ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’! আর নিরানব্বইয়ের ম্যাঞ্চেস্টারে ওপেন করে পঞ্চাশের কাছাকাছি খুব জরুরি একটা ইনিংস খেলেছিলেন।

সচিনের যথেষ্ট উপস্থিতি নেই একমাত্র ছিয়ানব্বইয়ের বেঙ্গালুরুতে। ওটা ভারত জিতেছিল ম্যাচের প্রথম বল পড়ার আগেই! যখন পাকিস্তান অধিনায়ক ওয়াসিম আক্রম চোটের জন্য সরে দাঁড়ান। ম্যাচটা ভারত জেতার পর দিন দশেক ধরে নাগাড়ে তোড় হয়েছিল লাহৌরে, আক্রমের মডেলটাউনের বাড়ি। তাঁকে পালিয়ে থাকতে হয়েছিল করাচির শ্বশুরবাড়িতে।

ভারত-পাক ম্যাচ বলতে কী বোঝায়, জিজ্ঞেস করায় সে দিনও ফক্স স্পোর্টসে আক্রম বললেন, “ভারত-পাক ম্যাচ হল উনিশ বছর বাদে আজও লোকের সমানে জিজ্ঞেস করে যাওয়া, তোমার বেঙ্গালুরুর চোটটা কি সত্যিই না খেলার মতো ছিল?”

০-৫-এ সচিনের পরাক্রম এবং আক্রমের নাম তুলে নেওয়া ছাড়া আরও একটা বৈশিষ্ট্য হল, এর মধ্যে চার বার পাকিস্তান পরে ব্যাট করে মুখ থুবড়ে পড়েছে। ধরেই নেওয়া যায়, টস জিতলে মিসবা কী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন! ধোনি আবার সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, পিচ তাঁর একটু স্যাঁতস্যাঁতে লেগেছে। শুনে অবাক লাগল। আগের বিশ্বকাপে ভারত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, পিচ নিয়ে বাড়তি ভাববেই না। টিম মিটিংয়ে ঠিক করে, ‘যাহ্‌, আমরা ম্যাচের আগের দিন উইকেটই দেখব না’! দু’টো টিম যখন এক সারফেসে খেলবে, ব্যাপারটাকে এত পাত্তা দিয়ে কী লাভ?

এ বার ভারত কি সেই ছক থেকে সরে গেল যে, ধোনি আগের দিন পিচ দেখতে গেলেন? নাকি মিসবাকে বিভ্রান্ত করার কৌশল যে, আগে ব্যাট করলে পিচ স্যাঁতস্যাঁতে পাবে?

ভারত-পাক ম্যাচ মানেই আসলে ইতিহাসের চক্রব্যূহ! সে যে টিমই জিতুক!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

world cup 2015 gautam bhattacharya india bowling
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE