Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নেট-তরজার ফোড়নে আরও স্বাদু বিশ্বকাপ-দর্শন

শুরুটা হয়েছিল, বলে-বুটে ঠোকাঠুকির আগেই! মাঝরাত্তিরে ব্রাজিল নামার ঢের আগেই ‘হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা’ বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় তক্তা গরম করে চলছিল হলুদ-সবুজ টিমের বঙ্গ-ব্রিগেড। বাহরিন থেকে বারুইপুর, কিংবা বেঙ্গালুরু থেকে ব্রাসেল্সে ছড়িয়ে থাকা বাঙালির ঘরে-ঘরে এখন গাদাগুচ্ছের অনাবাসী ব্রাজিলীয়। আর্জেন্তিনা, জার্মানি, ইংল্যান্ডের বঙ্গজ ভক্তদের সঙ্গে তাঁদের শুম্ভ-নিশুম্ভের সম্পর্ক! এরিনা কোরিন্থিয়ান্সে ব্রাজিল ম্যাচের কিক-অফের বাঁশি বাজার ঠিক আগে মোক্ষম চিমটি দিলেন কলকাতার এক আর্জেন্তিনা সমর্থক।

ঋজু বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৪ ০৩:৫৮
Share: Save:

শুরুটা হয়েছিল, বলে-বুটে ঠোকাঠুকির আগেই! মাঝরাত্তিরে ব্রাজিল নামার ঢের আগেই ‘হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা’ বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় তক্তা গরম করে চলছিল হলুদ-সবুজ টিমের বঙ্গ-ব্রিগেড।

বাহরিন থেকে বারুইপুর, কিংবা বেঙ্গালুরু থেকে ব্রাসেল্সে ছড়িয়ে থাকা বাঙালির ঘরে-ঘরে এখন গাদাগুচ্ছের অনাবাসী ব্রাজিলীয়। আর্জেন্তিনা, জার্মানি, ইংল্যান্ডের বঙ্গজ ভক্তদের সঙ্গে তাঁদের শুম্ভ-নিশুম্ভের সম্পর্ক! এরিনা কোরিন্থিয়ান্সে ব্রাজিল ম্যাচের কিক-অফের বাঁশি বাজার ঠিক আগে মোক্ষম চিমটি দিলেন কলকাতার এক আর্জেন্তিনা সমর্থক। ফেসবুকে গলা ফুলিয়ে তাঁর ঘোষণা, ‘চলো মেক্সিকো: আজ ব্রাজিলাসুর বধ’। শুনেই সাইবার-দেওয়ালে পেলের দেশের বাঙালি ভক্তেরা রে-রে করে উঠলেন! আর্জেন্তিনার চোখের মণি মেসিকে ঠেস দিয়ে তাঁদের ফোড়ন, ‘যা যা, তোদের মাসিমণিকে সামলা!’

পেলের পাড়ায় ব্রাজুকা যত গড়াচ্ছে, উত্তেজনা-উল্লাস বা হতাশা-ক্ষোভ উগরে দিতে বিশ্বকাপ-পাগলদের আঙুল স্মার্টফোন-আইপ্যাডের টাচ-স্ক্রিন কিংবা ল্যাপটপের মাউস খুঁজে নিচ্ছে! এই ২০১৪-য় এটাই দস্তুর! বিশ্বকাপ, আইপিএল কি লোকসভা ভোট যে কোনও জাতীয়-আন্তর্জাতিক মেগা ইভেন্টের উত্তাপ সোশ্যাল মিডিয়ায় এক সঙ্গে ভাগ করাটা আগেই শুরু হয়েছে। স্মার্টফোনের দৌলতে প্রযুক্তি এখন ঝরঝরে। আবেগের পারদও তাই চড়ছে। রামখটাখট ঘ্যাঁচাং ঘ্যাঁচে কথার পিঠে কথার প্যাঁচ কাটতে সমান্তরাল এক যুদ্ধও তাই নেট-পাড়ায় জমজমাট।

উদ্বোধনী ম্যাচের আগে টিভি-র পর্দায় লাস্যময়ী জেনিফার লোপেজকে দেখেই হাতে-গরম আপডেট শুরু, ‘ধুর, ধুর গত বারের শাকিরার পাশে কোথায় লাগে জে-লো!’ তারপর থেকে একটানা প্রতি রাতেই তর্কে-আড্ডায় সাইবার-মহল্লা নরক গুলজার। আর তা দেখতে দেখতেই কারও কারও আড়াই যুগ আগের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ’৮৬-র ব্রাজিল-ফ্রান্স ফুটবল যুদ্ধ বা ’৮২-র ফ্রান্স-পশ্চিম জার্মানি টক্করের সময়েও পাড়ার অমুক বাড়িতে তেমনটা হতো বই কী! তখন বাংলাদেশ টিভি মারফত বিশ্বকাপের খেলা দেখতে হতো কলকাতায়। ছাদের অ্যান্টেনায় বুস্টার বসিয়ে ম্যাচের ছবি ফুটিয়ে তোলার যুদ্ধটা চলত সেই ভরদুপুর থেকেই। শেষমেশ হয়তো দেখা গেল, খেলা শুরুর ঢের পরে টিভি পর্দার ঝিরঝির ভেদ করে ড্রিবলরত মারাদোনা বা জিকো ভেসে উঠছেন।

সঙ্গে-সঙ্গেই ঘরময় হাততালি। তখন ক’টা বাড়িতেই বা টিভি! পাড়ার কোনও একটা বাড়ির ঘাঁটিতেই খেলার সঙ্গে ফাউ-প্রাপ্তি, সমর্থকদের পা-টানাটানি, ছদ্ম ঘুষোঘুষি। এ কালের সোশ্যাল মিডিয়ার হইহই দেখে অনেক বছর বাদে পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে গুয়াহাটির ব্যাঙ্ক কর্তা দেবীপ্রসাদ সিংহের। ছেলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়ার পরে সাধারণত একা-একাই খেলা দেখেন। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার সরস বিশ্বকাপ-চর্চার সৌজন্যে এক মুহূর্ত নিজেকে একা মনে হয় না। বলছেন, “ব্রাজিল-আর্জেন্তিনার সঙ্কট, বা স্পেনের বিপর্যয়ের পরে ফেসবুকের হাসি-ঠাট্টায় নিজের অজান্তেই ফিক করে হেসে ফেলতে হয়। অনেক সময়ে নিজেও যোগ না দিয়ে পারা যায় না!” সকালে অফিস তো কী? হল্যান্ডের কাছে স্পেন গোহারা হওয়ার সাক্ষী থেকে তাই তিনি রাত সাড়ে তিনটেয়ও না-লিখে পারেননি, ‘স্পেনকে এমন বেইজ্জত হতে কোনওদিন দেখিনি!’

রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরেও সে ধন আছে কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি সাইবার মহল্লায়। তাই আমবাঙালির আবেগের সঙ্গে এক পাতে অবস্থান দেশ-বিদেশের সেলেবদের। জার্মানির মুলারকে পর্তুগালের পেপে-র ঝুঁকে পড়ে ঢুঁসো এবং লাল কার্ডপ্রাপ্তি চাক্ষুষ করে সঙ্গীতকার কবীর সুমনের উপলব্ধি: ‘পেপে বোধহয় জাতিস্মর! গত জন্মে কি গরু ছিলেন?’

বাঙালির ঘরোয়া রাজনীতি কিংবা ঘটি-বাঙাল তরজার ছায়াই বা বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ে কী করে! স্পেনের পাঁচ গোলে হারের পরে বাংলার বামেদের ঠুকে একজন লিখেছেন, ‘স্পেনেও এ বার নেতৃত্ব বদলের দাবি উঠবে।’ গত বারের চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে নিয়ে আর একটি পোস্ট, ‘দিদি কি খেলাটা দেখেছেন? ২০১৬ সালেও এমন উড়ে যেতে হবে না তো?’ পাঁচ গোল খাওয়া লাল-হলুদ জার্সিধারী স্পেন না চার গোল হজমকারী মেরুন-সবুজ জার্সির পর্তুগাল কে বেশি হতভাগ্য তা নিয়েও বাঙালির বিশ্লেষণ চলছে। নিজে সোশ্যাল মিডিয়ায় না-থাকলেও বিশ্বকাপ ফুটবল এবং ফেসবুক-রসিকতা দু’টোই উপভোগ করেন লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। তাঁর মতে, “এর মধ্যে এক ধরনের সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটে।”

আর্জেন্তিনাকে ঠেস দিয়ে ব্রাজিলের হয়ে একটি সংলাপ বিশ্বকাপের বাজারে ফেসবুকে দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে। তিন দশক আগে মারাদোনার ‘ভগবানের হাতে’র তত্ত্ব মনে পড়িয়ে সেই পোস্ট: ‘আমরা ব্রাজিল! হাত দিয়ে গোল করি না!’ ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে আত্মঘাতী গোলে ব্রাজিল পিছিয়ে পড়তেই আর্জেন্তিনা ফ্যান অনির্বাণের বদলা: ‘আমরা আর্জেন্তিনা। নিজেদের জালে বল ঢোকাই না।’ পরে খেলার রং বদলাতে কিন্তু ঝটপট ফেসবুকের প্রোফাইল-ছবি পাল্টে ফেলেছেন মাঝচল্লিশের ফুটবল-পাগল পুরুষ-মহিলারাও। সেখানে তখন হলুদ-সবুজ জার্সিতে টুকটুকে ব্রাজিল-তারকা অস্কার। নেইমার-অস্কারদের সঙ্গে যুদ্ধে অপরাজেয় মেক্সিকান গোলরক্ষক ওচোয়াকে দেখে ভোররাত্তিরে চিত্রপরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের টিপ্পনী: ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে!’ তার একটু বাদেই কৌতুক-শিল্পী মীরও লিখছেন, ‘ঠাকুর রক্ষে কর বললে, তিনিও বোধহয় ওচোয়ার কাছে যেতে বলবেন! ওচোয়া আরও ভাল রক্ষক!’

তবে কিছু ‘বিশুদ্ধ’ ফুটবলপ্রেমীও রয়েছেন। নিজে ফেসবুক করলেও খেলার সময়ে অন্য কিছুতে মন দেওয়ার পক্ষপাতী নন বিশ্বকাপ-পাগল চেতলার বাসিন্দা চন্দন দাস। তাঁর বক্তব্য, “খেলা দেখাটার বারোটা বাজছে। সারাক্ষণ স্মার্টফোনে মন থাকলে কি আর খেলা দেখা হয়!” যদিও সোশ্যাল মিডিয়ার এই ফুটবল-তরজার মধ্যেও গড়ে উঠছে অন্য ধাঁচের এক সামাজিক পরিসর। মনস্তত্ত্ববিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় এর একটা সদর্থক দিক দেখছেন। বলছেন, “একটা খেলাকে ঘিরে ঝগড়া-আড্ডা, মেলামেশায় অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি বা ভাবনার কাঠামো গড়ে উঠছে।”

জার্মানির মাইন্জ শহরের বাসিন্দা কলকাতা-কন্যা সুস্মিতা ধর লুকাসের কাছে খেলা দেখতে দেখতে ফেসবুকে বিশ্বকাপ-চর্চা বাস্তবিকই বাপের বাড়ির দেশের বন্ধুদের সঙ্গে একটা সেতুবন্ধন। জার্মানি নামার আগে সুস্মিতা তাঁর স্বামী উয়া লুকাসের একটা পুরনো ভিডিও-ছবি পোস্ট করেছেন। ৯০-এর লোথার ম্যাথাউসের জার্মানির বিশ্বজয়ের পরে তাঁর স্বামীর উল্লাস। সে ছবির সূত্র ধরেই খেলা দেখার ফাঁকে ভাঙা-ভাঙা বাংলা, ইংরেজি, জার্মানে সুস্মিতা, তাঁর স্বামী ও কলকাতার বন্ধুদের আড্ডা জমজমাট।

বিশ্বকাপের আবেদনটা তখন আর নিছক টাচলাইনের চৌহদ্দিতে আটকে থাকে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE