Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

মিয়াঁদাদদের ক্রিকেট-কাশ্মীর এখন মহেঞ্জোদাড়ো

স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই জানা গেল পেশায় আইটি কর্মী। আদতে মুম্বইয়ের লোক। এখন কর্মসূত্রে পাকাপাকি সিডনিতে। ডন ব্র্যাডম্যানের নাতনি ভারত-পাক ম্যাচ দেখার জন্য আজ তাঁর ঠাকুরদার নামাঙ্কিত প্যাভিলিয়নে বসতে পারেন, এই আন্দাজে বিস্তর ব্যর্থ খোঁজাখুঁজির শেষে তরুণ ভারতীয় দম্পতিকে ওখানেই আবিষ্কার করলাম। হাতে একটা বিরাট কার্ডবোর্ডের বাক্স নিয়ে তাঁরা ড্রেসিংরুমের খোলা জানলার সামনে বসা রবি শাস্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন।

গৌতম ভট্টাচার্য
অ্যাডিলেড শেষ আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৪
Share: Save:

স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই জানা গেল পেশায় আইটি কর্মী। আদতে মুম্বইয়ের লোক। এখন কর্মসূত্রে পাকাপাকি সিডনিতে।

ডন ব্র্যাডম্যানের নাতনি ভারত-পাক ম্যাচ দেখার জন্য আজ তাঁর ঠাকুরদার নামাঙ্কিত প্যাভিলিয়নে বসতে পারেন, এই আন্দাজে বিস্তর ব্যর্থ খোঁজাখুঁজির শেষে তরুণ ভারতীয় দম্পতিকে ওখানেই আবিষ্কার করলাম। হাতে একটা বিরাট কার্ডবোর্ডের বাক্স নিয়ে তাঁরা ড্রেসিংরুমের খোলা জানলার সামনে বসা রবি শাস্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিলেন। কার্ডবোর্ডের ওপর এক কোণে লেখা সিডনি ৪ মার্চ ১৯৯২। অন্য দিকে, ইংল্যান্ড জুন ২০১৯। আর সবার ওপরে বিরাট করে লেখা ‘৭-০’।

ভারতীয় টিম ডিরেক্টর বোর্ডটার দিকে এক ঝলক তাকালেনও। দূরত্ব দশ-বারো গজের বেশি হবে না। অত বড় করে লেখা নজরে না পড়ার কথা নয়। যদি নজরে না পড়ে থাকে তার একমাত্র কারণ হবে, ম্যাচের টেনশন। ৭৬ রানে বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ জিতে ওঠা দূরে থাক, ভারত তো সবে তখন আফ্রিদিকে আউট করেছে। চার উইকেট ফেলা বাকি আর মিসবা তখনও ক্রিজে।

যেখানে তখনও ৬-০ হয়নি সেখানে পরের বিশ্বকাপ ধরে ৭-০ কেন? আর বাক্সের ওপর লেখাটা দেখে বোঝা যাচ্ছে আগেই তৈরি হয়েছে। মাঠে হুটহাট করে লেখা নয়। দম্পতি জানালেন, সকাল থেকেই তাঁদের বিশ্বাস ছিল এটাই হতে যাচ্ছে। আর ইংল্যান্ডে পরের বিশ্বকাপেও তাই ঘটবে। তাই তখনই লিখে ফেলেছিলেন আজকের মতো ভারত আবার সে দিন হারাবে পাকিস্তানকে! শুনে মনে পড়ে গেল, ভারত তিনশো করার পরেই এ দিন ফেসবুকে পোস্ট শুরু হয়ে যায় যে দিন রাহুল গাঁধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন, পাকিস্তান নিশ্চয়ই সে দিন ভারতকে বিশ্বকাপে হারাবে!

বিশ্বকাপে পাকিস্তান মানেই ওয়াঘা সীমান্তের এ প্রান্তে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের অনিবার্য ব্যাপারটা চলে আসে। এ বার ধোনিরা নিজেরাই অস্ট্রেলীয় মহাদেশে যে পরিমাণ হতমান অবস্থার মধ্যে কাটাচ্ছিলেন, সেখান থেকে আজকের আধ ডজন পাকিস্তান বিজয় তো প্রবাদটাকে আরওই জমাট বাঁধাল।

পাক-সংহারের অন্য বারের মডেলগুলো একই থাকে। পাকিস্তান টস হেরে রান তাড়া করতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে! কিন্তু সেই ব্যবধানগুলো ২৯ থেকে ৪৭ রানের মধ্যে ঘোরাফেরা করেছে। আজকের ব্যবধানটা সব চেয়ে বেশি। অন্যান্য বার ভারত-পাক কভারেজের দিন মানিকতলা বাজারের চেয়েও বেশি শব্দদূষণযুক্ত ক্রিকেট প্রেসবক্সও এক সময় টেনশনে চুপ হয়ে যায়। পেশাদারিত্বের খোলস ছেড়ে চাপের মুখে নিজ-নিজ দেশজ টেনশন প্রকাশ পেয়ে যায় যে, টিম জিতবে তো?

এ বার কিছুই হয়নি। বিরাট কোহলি, শিখর ধবন দুই দিল্লিওয়ালা খেলা ধরে নেওয়ার পর সব কিছু এমন একপেশে হয়ে যায় যে, হাসপাতাল থেকে সদ্য অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করে বেরোনো রোগীরও বাকি ম্যাচ দেখতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ধোনি সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতের বিশ্বকাপে টানা পাক-সীমান্ত জয় ব্যাখ্যায় বলছিলেন, “ওদের আগের সেই সোনার টিম আর নেই।”

তাই কি? আগের সোনার টিম যখন ছিল, তখনও তো ভারতকে হারাতে পারেনি। আর তাদের বিশ্বকাপে এই ভারত-বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ গুরুত্বপূর্ণ সব ক্যাচ ছাড়া। সিডনিতে কপিলের ক্যাচ পড়েছিল। ম্যাঞ্চেস্টারে আজহারের হাফ চান্স নেওয়া যায়নি। সেঞ্চুরিয়নে রজ্জাক যে আক্রমের কথা মতো এক হাত পেছনে দাঁড়াননি, সেই আফসোস বোলার আজ বারো বছর বাদেও করেন। বলেন যে, রজ্জাক তাঁর কথা মতো দাঁড়ালে তেন্ডুলকরের ৯৮ হয় না। আজও কোহলি ইনিংসের শুরুতে আফ্রিদিকে মাঠের বাইরে ফেলতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেট ও লং অনের মধ্যে ক্যাচ তোলেন। ক্যাচটা ধরা হয়নি। এর পর আবার যখন কোহলি সত্তরের কোঠায়, উমর আকমল সহজতম কট বিহাইন্ড মিস করলেন। বিশ্বকাপের বড় ম্যাচে এ সব হাফ চান্স না ধরলে বড় টিমকে হারানোর কথাই ভাবা উচিত নয়। মনে রাখা উচিত, তিরাশির ফাইনালে ভিভের ক্যাচটাও কিন্তু হাফ চান্সই ছিল!

রোববারের অস্ট্রেলিয়ান দৈনিকে ইয়ান চ্যাপেলের লেখা দেখছিলাম। যেখানে ভারতীয় মধ্যবিত্তের নিয়মিত বিদেশে ম্যাচ দেখতে আসা নিয়ে গ্রেগ চ্যাপেলের দাদা লিখেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যত সংখ্যক কোটিপতি আছে তার চেয়ে ভারতে কোটিপতির সংখ্যা বেশি। তা দুপুরে কোহলি-ধবন যখন ১৩৪ বলে ১২৯ রানের পার্টনারশিপের দিকে এগোচ্ছেন, অ্যাডিলেড ওভালের দৃশ্যাবলী দেখে মনে হচ্ছিল গোটা ভারতে বুঝি এত জাতীয় পতাকা নেই আজ অস্ট্রেলিয়ান মাঠে যা জড়ো হয়েছে!

ধবন-কোহলি যখন ক্রমাগত একে অপরকে জড়িয়ে ধরে সাহস জোগাচ্ছেন। একে অন্যের পঞ্চাশে উচ্ছ্বসিত। মনে পড়ছিল একচল্লিশ হাজার দর্শকের কারও কারও নিশ্চয়ই মনে পড়ছে ব্রিসবেনের সেই ঘটনার কথা। দু’মাসও হয়নি যখন টেস্ট ম্যাচের মধ্যে ব্যাট করতে যাওয়ার আগে নেটে হঠাৎ আহত হওয়ায় শুরুতে নামতে চাননি ধবন। সেটা বাকি টিমকে জানানো হয়নি ঠিক ভাবে। হঠাৎ করে তাড়াহুড়ো শুরু হয়ে যায়। টু ডাউন ব্যাটসম্যান কোহলিকে নামতে হয়েছিল তিন মিনিটের প্রস্তুতিতে। নেমেই তিনি আউট হয়ে যান। আর ড্রেসিংরুমে ফিরে উত্তেজিত তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েন ধবনের সঙ্গে। কেন তাঁকে সময় দেওয়া হয়নি? সুরেশ রায়না আরও এক জন ‘কলঙ্কিত’ ব্যাটসম্যান। রায়নার ৫৬ বলে চোখ ঝলসানো ৭৪ ছাড়া কিছুতেই ভারত তিনশো পেরোয় না। ক্রমাগত শর্ট বল করেও মহম্মদ ইরফান তাঁর পুল বন্ধ করতে পারেননি। কোহলি দারুণ সেঞ্চুরি করলেন। বিশ্বকাপে প্রথম ভারতীয় হিসেবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করার রেকর্ড গড়লেন। কিন্তু তাঁর ইনিংসকে জল আর সার দিয়েছেন রায়না-ধবন। রায়নারও তো এ বারের টেস্ট সিরিজে দু’ইনিংসে শূন্য করে বাদ যাওয়ার ট্র্যাজিক কাহিনি রয়েছে।

আসলে রায়না-ধবন-কোহলি ত্রয়ী তাঁদের সাম্প্রতিক শোষিত ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে ভেসে উঠেছেন ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় মহাসংঘর্ষে! ইন্ডিয়ান বোলিং নিয়ে এখন যতই ধন্য-ধন্য হোক। এই উইকেটে তিনশো রান তাড়া করার ব্যাটিং লাইন-আপ পাকিস্তানের নেই। বিপক্ষে তালতলা বা মিলন সমিতি বল করলেও না। শাহিদ আফ্রিদিকে দিয়ে ওপেন করালে যদি বা ভারতকে চমক দেওয়া যেত, ইউনিস খানকে দিয়ে সেই চাপ তৈরি সম্ভব নয়।

পাক বোলিংয়ের মানও কত নেমে গিয়েছে! মহম্মদ ইরফানের সাত ফুট ফ্রেমের ওপর এত ভরসা করেছিল পাকিস্তান। কার্যকারিতায় তাঁকে দেখাল এক ফুট। এবিসি রেডিওয় ধারাভাষ্য দেওয়ার সময় এ দিন জিওফ্রে বয়কট বলেই ফেললেন, “পাক বোলিং দেখলাম। কেউ কি আমাকে একটা ব্যাট জোগাড় করে দেবে?” ডেভিড লয়েড দ্রুত টুইট করলেন, ‘ওহে জিওফ্রে, ভারতেরটা দেখে নিয়ে লেখো।’ টুইটের ইঙ্গিত ছিল, ভারতের বোলিং আরও খোলতাই। অশ্বিন-জাডেজা কিন্তু পাকিস্তানের কুশ্রী ব্যাটিংয়ের মধ্যেও দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য এসএমএস রেখেছেন, পরের রোববার এমসিজির ড্রপ-ইন পিচ টার্ন করলে আমরা আছি! আর বয়কটও বোধহয় তাঁদের দেখার পর ধারাভাষ্যে নতুন কিছু যোগ করেননি।

কিন্তু এমন বর্ণোজ্জ্বল সমর্থক দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচের দিন এমসিজিতে আর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না! এটা পাকিস্তান ম্যাচের জন্যই বিশেষ ভাবে জড়ো হওয়া হাজার-হাজার ভারতীয় সমর্থক। যাঁরা আবির-পিচকিরি ছাড়াই ক্রিকেট-হোলির পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছিলেন চার দিকে। যাঁরা আরব্য উপন্যাসের মতো বিশ্বকাপ নিয়ে ঘুমন্ত অ্যাডিলেডকে কয়েক ঘণ্টার জন্য প্রাণবন্ত ভারতীয় উপনিবেশ বানিয়ে ছাড়লেন। অবিশ্বাস্য, চোখের সামনে একটা খানদানি অস্ট্রেলীয় শহরের দশ-বারো ঘণ্টার জন্য সর্বাত্মক ভারতীয়করণ!

অবশ্য ৬-০ তো আরওই অবিশ্বাস্য! নেটে পাকিস্তানি ক্রিকেটারের আর্তনাদ পড়ছিলাম রাতের দিকে। তার মধ্যে ভুল দল নির্বাচনে লাখ-লাখ ক্রিকেটপ্রেমীর সঙ্গে প্রতারণা করেছে পাক টিম ম্যানেজমেন্ট। লেখাটা চেতন শর্মা পড়লে তিন দশক বাদেও গভীর তৃপ্তি পেতেন। লেখকের নাম যে জাভেদ মিয়াঁদাদ।

মিয়াঁদাদের শেষ বলে ছক্কার মাধ্যমে পাকিস্তানের জিতে নেওয়া ক্রিকেট-কাশ্মীরকে ৬-০ যে তাঁর জীবিত অবস্থাতেই মহেঞ্জোদাড়ো করে দিয়েছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE