অনুরাগ সরকার এবং জাভেদ আখতার। কোরপান খুনে ধৃত উত্তরবঙ্গের এই দুই মেধাবী সন্তানকেই ফাঁসানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন তাঁদের বাড়ির লোক, আত্মীয়-স্বজন। উত্তর দিনাজপুরের চোপড়ার জাভেদ ও জলপাইগুড়ি শহরের অনুরাগ দু’জনেই নির্বিবাদী, মিতভাষী ও পরোপকারী বলেই পরিচিত এলাকায়। তাঁদের গ্রেফতারের খবরে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে ভেঙে পড়েছেন প্রতিবেশীরাও।
মেধাবী ও শান্ত স্বভাবের বলে এলাকার লোকেদের খুব আদরের ছেলে জাভেদ। এনআরএস মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র জাভেদ কারও সঙ্গে ঝগড়া করা তো দূরের কথা, সাধারণত মৃদুভাষী বলেই দাবি করেছেন এলাকার লোকজন। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, তার হস্টেলের ঘরটি ঘটনাস্থল থেকে কাছে হওয়ায় জাভেদকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে। চোপড়ার লক্ষ্মীপুর গ্রামপঞ্চায়েতের হিলাগাওর বাসিন্দা জাভেদের পরিবারের লোকেরা জানিয়েছেন, ২০০৮ সালে ইসলামপুরের একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল থেকে ৯৫ শতাংশ নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেন তিনি। তারপরই ভর্তি হন ব্যাঙডুবি বিএসএফ স্কুলে। সেখান থেকে ৭৮ শতাংশ নম্বর পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। তাঁর দাদারা অনেক কষ্টে লক্ষাধিক টাকা জোগাড় করে তাঁকে রাজস্থানের কোটায় একটি কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দেন। এরপরই জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ২৬৮ র্যাঙ্ক করে এনআরএস-এ ভর্তি হন জাভেদ। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০০১ সালে জাভেদের মা কারনিস ফাতেমা মারা যান। বাবা তাজিমুল হক। জাভেদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন তাঁর দাদারাই। সাত ভাই এর মধ্যে ছোট ছেলে জাভেদ। জাভেদের ছোট দাদা সামসুল আবেদিন বলেন, “ভাই এর সঙ্গে প্রতিদিনই ফোনে কথা হয়। প্রায়ই ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতাম। ওই ঘটনাতে ভাই জড়িত নয়। ওকে চক্রান্ত করে ফাঁসানো হয়েছে। আমাদের স্বপ্ন সমস্ত ভেঙে যেতে বসেছে। সরকারের উচিত বিষয়টি নিয়ে সঠিক তদন্ত করা, যাতে নির্দোষ ভাই শাস্তি না পায়।”
ইসলামপুরের এক বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল দ্য স্কলারের প্রাক্তন অধ্যক্ষ পাত্রসখা পাত্র বলেন, “জাভেদ স্কুলে পড়ার সময় আমি ওকে খুব ভাল ভাবেই চিনতাম। খুব শান্ত স্বভাবের ও মেধাবী ছাত্র ছিল সে। ওর মতো একজন ছাত্র গ্রেফতার হওয়াটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা।
গ্রেফতার হওয়ার দু’দিন আগেই কিছু একটা আন্দাজ করে বাড়িতে ফোন করেছিলেন এনআরএসের হস্টেলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র অনুরাগ। সেই ফোন পেয়ে রবিবার সকালেই কলকাতা রওনা হয়ে যান জলপাইগুড়ির বাবুপাড়ার বাসিন্দা অনুরাগের বাবা-মা। তাঁরা কলকাতায় থাকাকালীনই কোরপান হত্যা মামলায় অনুরাগকে পুলিশ গ্রেফতার করে। যা শুনে অবাক অনুরাগের স্কুলের শিক্ষকেরাও। অনুরাগ প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলেই পড়েছেন। তাঁর বাবা শুভাশিসবাবু পেশায় ঠিকাদার। বাড়িতেই তিনি একটি লজও চালান। মা অপর্ণাদেবী গৃহবধূ। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান অনুরাগ কিন্তু এলাকাতে ভাল ছেলে বলেই পরিচিত। বাবা-মা ছাড়া বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে তাঁকে বাইরে দেখা যেত না বলেই এলাকার বাসিন্দাদের দাবি। এলাকার সমবয়সীদের সঙ্গেও তাঁর খুব একটা ভাব ছিল না বলে জানা গিয়েছে। এমনকী বছর তিনেক আগে এনআরএসে ভর্তি হওয়ার পরে প্রথম কিছুদিন হস্টেলে থাকতেও তাঁর সমস্যা হচ্ছিল। সে সময়ে বাবা-মা কিছু দিন কলকাতায় বাড়ি ভাড়া নিয়েও ছিলেন বলে পড়শিদের কয়েকজন জানান। ঘরকুনো, মুখচোরা বলে পরিচিত ছেলে তারপরে হস্টেলে থেকে কী ভাবে বদলে গেলেন, সে রহস্যও খোঁজা দরকার বলে পড়শিদের দাবি।
খুনের ঘটনায় কী ভাবে জড়িয়ে পড়ল অনুরাগ?
প্রাথমিক ভাবে অনুরাগের পরিবারের ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, কোরপান শাহ খুনের মামলায় ধৃত প্রথম বর্ষের ছাত্র জসিমুদ্দিনের সঙ্গে অনুরাগের ঘনিষ্ঠতা ছিল। পড়াশোনায় ভাল বলে জসিমুদ্দিন মাঝেমধ্যেই অনুরাগের ঘরে পড়া বুঝতে আসত। ঘটনার দিন জসিমুদ্দিনের মোবাইল চুরির অভিযোগ ওঠে। সে কারণে ঘনিষ্ঠতার সূত্রেই অনুরাগের নামও জড়িয়ে পড়তে পারে বলে তাঁদের দাবি।
কোরপান খুনে ধৃত চার অভিযুক্ত হবু চিকিত্সককে এ দিন আগামী ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত পুলিশি হেপাজতের নির্দেশ দিল আদালত। মঙ্গলবার চার অভিযুক্ত জাভেদ আখতার, অনুরাগ সরকার, ইউসুফ জামাল ও অরিজিত্ মণ্ডলকে শিয়ালদহ আদালতের অতিরিক্ত মুখ্য বিচার বিভাগীয় বিচারক অর্পিতা ঘোষের এজলাসে হাজির করানো হয়েছিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy