Advertisement
১১ মে ২০২৪

পাচারের পরে বেঁচে ফিরে আজ ওঁরা লড়াকু ‘লিডার’

কলকাতা থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে উত্তর ২৪ পরগনার মছলন্দপুর। সেখান থেকে আরও প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত গ্রাম গোকুলপুর।

স্কুলপড়ুয়াদের এই সব পোশাক তৈরি করেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন পাচার-কন্যেরা। নিজস্ব চিত্র

স্কুলপড়ুয়াদের এই সব পোশাক তৈরি করেই ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন পাচার-কন্যেরা। নিজস্ব চিত্র

দীক্ষা ভুঁইয়া
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:৪৫
Share: Save:

কলকাতা থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে উত্তর ২৪ পরগনার মছলন্দপুর। সেখান থেকে আরও প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের প্রত্যন্ত গ্রাম গোকুলপুর। সেখানেই একচালা ঘরে সালোয়ার-কামিজ পরে বসে সতেরো-উনিশের জনা কুড়ি মেয়ে। কারও কারও মাথায় ওড়না টানা। নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে কেউ হেসে উঠছেন, কেউ বা সঙ্গিনীর পিছনে লাগছেন মজা করে। কয়েক বছর আগে ওঁদের জীবন আটকে গিয়েছিল অন্ধকূপে। ওঁদের সকলেই শিকার হয়েছিলেন পাচার চক্রের।

যদিও নিজেদের ‘পাচার ভিকটিম’ বলতে রাজি নন ওঁরা। তাই যখন জিজ্ঞাসা করা হল, পাচারের পরে কবে তাঁদের উদ্ধার করা হয়েছে, ফিরোজা, পারিজাত, জেসমিন, রেবেকা, শরিফা, রশিদা (সবই ছদ্মনাম) ঝাঁঝালো গলায় উত্তর দিয়েছেন, ‘‘আমরা কেউ ‘ভিকটিম’ নই। আমরা ‘লিডার’!’’

সেই লিডার হয়ে ওঠার লড়াইটা যে খুব কঠিন ছিল, সেটা ধরা পড়েছে ওঁদের কথায়। ওঁদের কেউ ফিরে এসেছেন দু’বছর আগে, কাউকে সাত-আট বছর আগে উদ্ধার করা হয়েছে। কিন্তু ফিরে আসার পরে শুরু হয়েছিল অন্য লড়াই। সেই লড়াই পরিবারের অবজ্ঞার সঙ্গে, মেনে না-নেওয়ার মানসিকতার সঙ্গে, সর্বোপরি লোকলজ্জার সঙ্গে। কিন্তু দমে যাননি জেসমিন, সরিফা, রশিদা, রেবেকারা। নিরাপত্তাহীন, অসহায় অবস্থায় কায়ক্লেশে কয়েক বছর কাটানোর পরে তাঁরাই ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। মানব পাচার রোধের কাজে যুক্ত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থায় নাম লিখিয়ে নতুন লড়াইয়ে জিতছেন তাঁরা। সরকারি অফিসে ঘুরে ঘুরে দরপত্র দাখিল করে রীতিমতো বরাত নিয়ে তৈরি করে চলেছেন স্থানীয় স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পোশাক।

কেমন করে সম্ভব হল এই জয়?

ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মইদুল ইসলাম জানাচ্ছেন, উদ্ধারের পরে বাড়িতে আসার পরে কাউন্সেলিং করিয়ে মেয়েদের ‘ট্রমা’ বা আতঙ্কের ঘোর কাটাতে অনেকটা সময় লেগেছিল। তার পরে এক সময় ওঁরাই এলাকায় ঘুরে ঘুরে সচেতনতার প্রচার শুরু করেন। কিন্তু শুধু প্রচারে পেট ভরে না, মেলে না সম্মানও। তাই সংস্থাই ওঁদের নিয়ে যায় স্বরূপনগর ব্লকের উইমেন ডেভেলপমেন্ট অফিসার (ডব্লিউডিও)-এর কাছে। সেখান থেকে বিডিও বিপ্লব বিশ্বাসের কাছে দরবার। আর ফিরে তাকাতে হয়নি। বিডিও নিজেই ওঁদের জন্য সেলাইয়ের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেন। তিন মাসের সেই প্রশিক্ষণ নিয়ে ওঁরা তৈরি করছেন সায়া, কুর্তি, সালোয়ার, ব্লাউজ, ছেলেদের শার্ট-প্যান্টও। তৈরি করেছেন স্বনির্ভর গোষ্ঠী ‘উত্থান’। সেই গোষ্ঠীর নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে ঋণ নিয়ে চলছে কাজ। স্থানীয় ব্লকের স্কুলে স্কুলে গিয়ে নিজেদের সেলাইয়ের কাজ দেখিয়ে বরাত পেয়ে দু’টি স্কুলে পড়ুয়াদের পোশাক সরবরাহ করছেন তাঁরা।

আরও কাজ দরকার। রেবেকারা বলছেন, ‘‘আমরা স্কুলে স্কুলে জামা-প্যান্ট নিয়ে যাব। আশা করছি, আরও স্কুল থেকে কাজ পাব।’’ পারিজাত জানান, সরকার যদি মেশিন দেয়, সুবিধে হয়। বিডিও বিপ্লববাবু জানান, বিভিন্ন সরকারি স্কুলের সঙ্গেও ওঁদের যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। ‘‘ওঁদের জন্য আমরা ব্লক থেকে দোকান খুলে দেওয়ার চেষ্টা করছি, যাতে পোশাক-শাড়ি বিক্রি করে ওঁরা আরও আত্মনির্ভর হতে পারেন,’’ বলেন বিপ্লববাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Human Trafficking Girl
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE