Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

‘এর পরে কারা? আমরা?’

কাঠবাঙাল (পিতৃভূমি বরিশাল, মায়ের যশোর) এবং ইস্টবেঙ্গল সমর্থক হওয়ার সুবাদে মোহনবাগানিদের সঙ্গে নিত্য ঝগড়ায় এ শোনা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে যে— ‘ও পারে পাঠিয়ে দে’।

এনআরসি-র প্রতিবাদে কলকাতায় অসম হাউসের সামনে কংগ্রেসের বিক্ষোভ।

এনআরসি-র প্রতিবাদে কলকাতায় অসম হাউসের সামনে কংগ্রেসের বিক্ষোভ।

ঈশানী দত্ত রায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০১৮ ০২:৪৩
Share: Save:

নিউজ রুমে সহকর্মী দিব্যেন্দু হাসতে হাসতেই এসে বলেছিলেন, ‘‘আমাদের তো আর থাকতে দেবে না।যাবেন কোথায়?’’

‘‘বাংলাদেশে চলে যাব, ওখানে বন্ধুরা আছে। খুশিই হবে।’’

দিব্যেন্দুর পিতৃভূমি খুলনা। খুলনা-নারায়ণগঞ্জ করতে করতে তাঁর পিতৃপরিবার ভারতে চলে আসেন দেশভাগের পরে।

হ্যাঁ। ‘এ দেশ’।

কারণ, কাঠবাঙাল (পিতৃভূমি বরিশাল, মায়ের যশোর) এবং ইস্টবেঙ্গল সমর্থক হওয়ার সুবাদে মোহনবাগানিদের সঙ্গে নিত্য ঝগড়ায় এ শোনা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে যে— ‘ও পারে পাঠিয়ে দে’।

বিষয়টা নেহাৎ ঠাট্টা মনে হয়নি কোনও দিন ব্যক্তিগত ভাবে। অসম-তালিকা প্রকাশের পরে আর ঠাট্টা মনে হলও না। কারণ, এক বৃদ্ধের সঙ্গে সংলাপ। আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত।

‘‘মাঝখানের ঘরে আলমারিতে নীচের তাকে আমার এডুকেশনাল সার্টিফিকেটের সঙ্গে রেজিস্টার্ড নাগরিকের কাগজপত্রও আছে। দেখে নিও।’’

‘‘কেন? কী করব?’’

‘‘নাহ! কোনও দিন যদি তোমাকে চ্যালেঞ্জ করে, এ দেশে থাকতে না দেয়, দেখাতে পারবে।’’

এত হতভম্ব হয়ে গেলাম, যে বলতেও পারলাম না, ‘কী সব যে বল!’

নাগরিক দিনপঞ্জির তালিকা এতটাই নাড়িয়ে দিয়েছে তাঁকে, যে মধ্যরাতেও বলছেন, ‘দেখে নিও কিন্তু সার্টিফিকেটটা।’

ছোট্ট, অমলিন সরকারি কাগজ। উপরে বড় করে লেখা— সার্টিফিকেট অব রেজিস্ট্রেশন। ১৫.১.৫০ তারিখে সই করেছেন এন চক্রবর্তী, (ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর/ডেপুটি কমিশনারের তরফে)। ভারতীয় সংবিধানের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ১৫ বছর ১১ মাস বয়সি এক কিশোরকে তিনি ভারতীয় নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি দিলেন। কারণ, ইস্ট বেঙ্গল সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ড, ঢাকার আওতায় ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেছিলেন পিতৃদেব। ভারতীয় সংবিধান চালু হওয়ার পরে ভারতীয় নাগরিকত্বের আবেদন করার বিজ্ঞাপন দেখে আবেদনপত্র জমা দিয়েছিলেন সূর্য সেন স্ট্রিটে, রেজিস্ট্রেশন অফিসে।

আরও পড়ুন: উদ্বাস্তু অতিথি আপ্যায়নে সাফাই হচ্ছে ঘরদোর

কাগজে কাগজ জড়ানো থাকে। পুরনো, ছিঁড়ে যাওয়া খাম থেকে তখন বেরোচ্ছে একের পর এক কাগজ, বাবাকে লিখে দেওয়া হেড মাস্টারমশাইয়ের সার্টিফিকেট, অস্থায়ী এবং স্থায়ী মার্কশিট, সার্টিফিকেট। আর সব কিছুর মধ্যে নাগরিকের রেজিস্ট্রেশনের কাগজ ধরে বসে থাকা আমার বাবার সঙ্গে দু’দিন আগে সংবাদ সংস্থার পাঠানো অসমের বৃদ্ধের ছবির তফাত ছিল না।

বাড়াবাড়ি? হবে হয়তো। বাঙালেরা তো চিরকালই বাড়াবাড়ি করে এসেছে।

গ্রাম গোয়ালভাওর। থানা হিজলা। জেলা বরিশাল (পূর্বতন নাম বাকরগঞ্জ)— পিতৃদেবের জন্মস্থান। দেশভাগের আগে কলকাতায় চলে এসেছিলেন তিন জেঠু। ঠাকুরদা কলকাতায় আসেন ১৯৪৮ সালে, (ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন জানার পরে তাঁর ইচ্ছা ছিল, পিতৃভূমিতে শেষ শ্বাস নেবেন, ফিরে আসবেন ভিটেয়। সেজ পুত্রকে পোস্টকার্ডে এই কথা লিখে আর পোস্ট করতে পারেননি)। একে একে অন্যেরা, ম্যাট্রিকুলেশন দিয়ে বাবাও চলে আসেন কলকাতায় কলেজে ভর্তি হতে। গ্রামে থেকে গিয়েছিলেন ঠাকুরমা, বাবার পিসিমা এবং আমার ছোট পিসি। স্থির হয়েছিল, তাঁদের নিয়ে আসা হবে ধীরে ধীরে। ১৯৫০ সালের প্রথমে বরিশালে অশান্তি হয়। পার্শ্ববর্তী থানা এলাকায় আগুন, হত্যাকাণ্ডের পরে বাড়ির পাট গুটিয়ে মা, পিসিমা এবং ছোট বোনকে কলকাতায় নিয়ে আসেন আমার কিশোর সেজ জেঠু।

হ্যাঁ, এদেশের লোকেরা যাকে পালিয়ে আসা বলে আর মোহনবাগান সমর্থকেরা বলেন, ‘তোরা তো প্রাণভয়ে দেশও ছাড়তে পারিস!’

হ্যাঁ, সেই বাঙাল আমরা। সেই আমার বাঙাল বাবা, যিনি আমাকে বলেন, তুমি ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক কেন, ও দেশে জন্মাওনি, জানোও না কিছু, তিনি কোন ধাক্কায় এত বিচলিত হলেন? কিন্তু সেই আমারও তো ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে গিয়ে গর্জন শুনে হাউহাউ করে কান্না পেয়েছিল। যেমনটা হয়েছিল ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’-এ ট্যাক্সির জানলায় মুখ লাগানো এক মানসিক ভারসাম্যহীনের মুখে ‘যশোর যাইবা? খুলনা যাইবা?’ শুনে। আমার মা-জেঠিমাদের বাড়ি সেখানে।

আমরা সেই বাঙাল, দেশভাগের পরে পালিয়ে আসা পরিবারের সেই বংশধরেরা, যাঁদের সারা জীবন ধরে শুনতে হয়েছে, বাঙালদের এত জমিজমা ছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের আয়তনের চেয়ে বেশি। সেই বাঙালেরা, যাঁদের ভিটের মাটি বর্তমান বাড়ির ভিতের তলায় মিশে রয়েছে। সেই আমাদেরও কোথাও মনে হচ্ছে, ‘এর পরে কি আমরা’?

হাস্যকর? হবে হয়তো। কিন্তু এটা তো ঠিক, দেশ ছেড়ে পালানোর খোঁটা কোনও দিনই নিছক ঠাট্টা বলে মনে হয়নি আমাদের। কারণ, ‘এদেশের’ মানুষ আমাদের ভারতের মানুষ বলে ভাবেইনি কোনওদিন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে লেখার পরে কমেন্টও এসেছে, ভাই আপনারা বাঙালেরা এদেশে এসে আমাদের চাকরি খেয়েছেন।

মুশকিলটা এখানেই। কে আমি, আমার দেশের মানুষ কে, তা নিজেদের মতো করেই ভেবে নিয়েছি, বিশ্বাস করেছি এবং প্রতিষ্ঠা করেছি নিজস্ব পরিসরে। আজ সেই চিন্তাই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে গিয়েছে।

ভারতে দাঁড়িয়ে এই হিন্দু-মুসলমান-খ্রিস্টান ভেদাভেদ করার ক্ষমতা তোমাকে কে দিয়েছে, তা আঙুল তুলে বলতে পারিনি বলেই এখন ভাবতে হচ্ছে, ‘এর পরে কারা? আমরা?’

১৫.১.৫০।

নাগরিক রেজিস্ট্রেশনের কাগজ হাতে নিয়ে থাকা বৃদ্ধ বা স্মার্টফোনে কাগজটার ছবি তুলে রাখা কন্যাও ভাবছে, এই তারিখটাই হয়তো বাঁচিয়ে দেবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Assam NRC Refugee
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE