Advertisement
০৫ মে ২০২৪

বীরভূমের বিজেপি সভাপতি দুধকুমারের ইস্তফা

দুই মণ্ডলের ‘লড়াই’ জমে ওঠার আগেই ময়দান থেকে ছিটকে গেলেন এক জন! লোকসভা ভোটে দু’জনের লড়াইয়ে জিতেছিলেন অনুব্রত ওরফে কেষ্ট মণ্ডল। আর পুরভোটের লড়াই ঠিকমতো শুরু হওয়ার আগেই রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ জানিয়ে বীরভূম জেলা বিজেপির সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বসলেন দুধকুমার মণ্ডল! যে ঘটনার পরে আসন্ন পুরভোটে জেলায় আর বিজেপি নয়, সিপিএমকেই তাঁদের মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে ঘোষণা করলেন জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত।

পদত্যাগপত্রে সই দুধকুমারের। অনির্বাণ সেনের তোলা ছবি।

পদত্যাগপত্রে সই দুধকুমারের। অনির্বাণ সেনের তোলা ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৫ ০৪:১৪
Share: Save:

দুই মণ্ডলের ‘লড়াই’ জমে ওঠার আগেই ময়দান থেকে ছিটকে গেলেন এক জন!

লোকসভা ভোটে দু’জনের লড়াইয়ে জিতেছিলেন অনুব্রত ওরফে কেষ্ট মণ্ডল। আর পুরভোটের লড়াই ঠিকমতো শুরু হওয়ার আগেই রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তীব্র অসন্তোষ জানিয়ে বীরভূম জেলা বিজেপির সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বসলেন দুধকুমার মণ্ডল! যে ঘটনার পরে আসন্ন পুরভোটে জেলায় আর বিজেপি নয়, সিপিএমকেই তাঁদের মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে ঘোষণা করলেন জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত।

রবিবার বিকেল ৫টা নাগাদ রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বকে ফ্যাক্সে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন বীরভূমের ওই দাপুটে নেতা। তার কয়েক ঘণ্টা আগেই সিউড়িতে দলীয় কার্যালয়ে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করতে আসা বিজেপির জেলা পর্যবেক্ষক রামকৃষ্ণ পালকে ঘিরে তুমুল বিক্ষোভ দেখিয়েছেন দলের কর্মী-সমর্থকরা। পার্টি অফিসে ভাঙচুরও চালিয়েছেন টিকিট-প্রত্যাশীরা। এর পরই দুধকুমারের পদত্যাগ নানা জল্পনা উস্কে দিয়েছে দলে। আনন্দবাজারকে দুধকুমার বলেছেন, “আমি সঙ্ঘের সুস্থ সংস্কৃতি ও স্বচ্ছ ভাবনার লোক। দলের এই নোংরা রাজনীতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। তাই ইস্তফা দিয়েছি।” এর পরেই দলীয় শীর্ষ নেতৃত্বকে বিঁধে তাঁর অভিযোগ, “দলে গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব রয়েছে। বেশ কিছু নেতার সহযোগিতাও পাচ্ছিলাম না। হয়তো এতে শীর্ষ নেতৃত্বেরও ইন্ধন ছিল। তাই শীর্ষ নেতৃত্বকে বলেও সুরাহা হয়নি।”

দুধকুমারের ইস্তফা আদৌ গৃহীত হয়েছে কি না, রবিবার রাত পর্যন্ত তা স্পষ্ট হয়নি। এ দিন সন্ধেয় দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ কলকাতায় বলেন, “আমার কাছে পদত্যাগপত্র আসেনি। এলে বিবেচনা করব।” তবে এই ইস্তফা ঘিরে দলে স্পষ্ট দু’টি মত উঠে আসছে। দুধকুমারের অনুগামীরা বলছেন, পুরভোটের আগে জেলা সভাপতির ইস্তফা বীরভূমে দলের পক্ষে ‘বড় ধাক্কা’। জোর গলায় সে কথা অস্বীকার করতে পারছেন না তাঁর বিরোধীরাও। বিশেষ করে যেখানে অনুব্রতর সঙ্গে সমানে-সমানে টক্কর দিয়ে দুধকুমারই বীরভূমে বিজেপিকে শক্ত ভিতে দাঁড় করিয়েছেন। মাটি কামড়ে দুধকুমারের লড়াই থেকেই দলে কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন ‘সিপিএমের (পতনের পিছনে) যদি নন্দীগ্রাম, তৃণমূলের তবে পাড়ুই’। এমন এক নেতা সরে গেলে সেই শূন্যস্থান পূরণ করবে কে, প্রশ্ন তুলছেন দুধকুমারের অনুগামীরা।

বিজেপি রাজ্য নেতৃত্বের একটি অংশে আবার উল্টো সুরও রয়েছে। তাঁদের বক্তব্য, অনুব্রতর কায়দায় রাজনীতি করতে গিয়ে বারবার উস্কানিমূলক কথা বলে দলকে কম বিড়ম্বনায় ফেলেননি দুধকুমার। বিরোধীদের একাধিক বার প্রকাশ্যে হুমকিও দিয়েছেন তিনি। বিশেষ করে কয়েক মাস আগে রামপুরহাটে প্রকাশ্য সভায় বিরোধীদের (তৃণমূল কর্মী) ‘হাত কেটে নেওয়া’র হুমকি দিয়ে তিনি আরও বিরাগভাজন হন রাজ্য নেতৃত্বের। এমনকী, সঙ্ঘও তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট বলে দলের একটি সূত্রের খবর। এই অবস্থায় বীরভূমে আরও শক্ত হাতে হাল ধরার জন্য নতুন কোনও মুখকে সামনে নিয়ে আসা দরকার বলেই মনে করছেন বিজেপির এই নেতারা।

দুধকুমারের ইতিবাচক দিকগুলির কথা অস্বীকার করছেন না তাঁর বিরোধীরাও। রাজ্য বিজেপির এক নেতা যেমন বললেন, “দলের প্রতি দুধকুমারের নিষ্ঠা ও সংগঠন বিস্তারে তাঁর পরিশ্রম অনস্বীকার্য। বীরভূমে বা গোটা রাজ্যে যখন বিজেপির কোনও জমিই ছিল না, সেই সময়ও তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাহসের সঙ্গে দল করেছেন। তাঁর একরোখা মেজাজই তাঁর সম্পদ। এমন চরিত্রের মানুষকে হারানো উচিত হবে না দলের।”

সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে দুধকুমারের সম্পর্ক দু’দশকেরও বেশি। ১৯৮৪-এ তাঁকে আরএসএসের প্রচারক হিসেবে কাটোয়া মহকুমার দায়িত্ব দেওয়া হয়। বাম রাজত্বেও ময়ূরেশ্বরে বিজেপিকে দাঁড় করানোর পিছনে তাঁর একক কৃতিত্বের কথা মানছে রাজনৈতিক মহল। ২০১১-র বিধানসভা ভোটে তিনি প্রার্থীও হন। বিপুল ভোটে হারলেও পরের বছর সেপ্টেম্বরে দাপুটে দুধকুমারকেই জেলা সভাপতি পদে আনে বিজেপি। লোকসভায় ভোট বাড়ানোর পরে তাঁর হাতেই ছিল জেলা ‘দখলের’ ভার। পাঁচ বছরে যে অনুব্রতকে বীরভূমে কখনও চ্যালেঞ্জ করার সাহস দেখায়নি তাঁর কোনও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সেই অপ্রতিরোধ্য কেষ্ট-বাহিনীর সঙ্গে সমানে টক্কর দিয়ে দুধকুমারই হয়ে উঠছিলেন বীরভূম-রাজনীতির পাল্টা মুখ। যে পাড়ুইকে কেন্দ্র করে রাজ্য রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হওয়ার চেষ্টা শুরু বিজেপির, সেখানে দলের উত্থানের মূল কাণ্ডারী কিন্তু দুধকুমারই! সদাই শেখ, নিমাই দাসের মতো এক সময়ের অনুব্রত-ঘনিষ্ঠদের দলে টেনে এলাকায় বিজেপিকে শক্ত ভিতে দাঁড় করানোর কৃতিত্বও তাঁরই।

দুধকুমারের হঠাৎ ইস্তফায় শাসকদল খুশি। এ দিন জেলার প্রার্থী তালিকা ঘোষণার সময় অনুব্রতর মন্তব্য থেকেই তা স্পষ্ট। দুধকুমার সরে যাওয়ায় তাঁদের সুবিধা হল কি না, এর জবাবে জেলা তৃণমূল সভাপতি বলেন, “বিজেপি কিছু নয়, সিপিএমই আমাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী!” দুধকুমার চাইলে তাঁকে কি দলে নেবেন? সরাসরি না বলেননি অনুব্রত। বলেছেন, “দলে এ ব্যাপারে কমিটি আছে। সেখানে আলোচনার পরেই যা জানানোর জানাব।”

কিন্তু দুধকুমারের মতো লড়াকু নেতা হঠাৎ হাল ছাড়লেন কেন?

পদত্যাগপত্রে তাঁর অভিযোগ, বিজেপি করার জন্য বোলপুর মহকুমার নানা এলাকার বহু পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকে গ্রামছাড়া হয়েছেন। রাজনৈতিক হিংসায় খুনও হতে হয়েছে তাঁদের কর্মীদের। একাধিক মিথ্যা মামলায় কর্মী-সমর্থককে জেলে থাকতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে দলের একাংশের বিরুদ্ধে দুধকুমারের ক্ষোভ, “এ ব্যাপারে আন্দোলনের ও অন্য কোনও ভাবে বাঁচার পথ দেখানোর ক্ষেত্রে আপনাদের আগ্রহ দেখিনি। আক্রান্ত পরিবারের পাশে থেকে দলকে যখন আরও মজবুত ও শক্তিশালী করার প্রক্রিয়ায় থাকতে চেয়েছি, তখন বাধা ও অসহযোগিতা পেয়েছি!” তাঁর দাবি, “জেলা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরে নানা প্রতিকূল অবস্থায় লড়ে দলকে একটি বিশেষ জায়গায় নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলাম। এখন দলীয় নেতৃত্বের বিশ্বাস, আমার হাতে দল আর মজবুত হতে পারছে না। তাই দলের স্বার্থে পদ ছাড়ছি।”

ইস্তফার খবর ছড়াতেই প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় জেলা বিজেপিতে। রামপুরহাট, ময়ূরেশ্বর, পাড়ুই, বোলপুরে দলের বিভিন্ন কমিটি থেকে ইস্তফা দিতে থাকেন তাঁর অনুগামীরা। দলের জেলা সম্পাদমণ্ডলীর সদস্য উজ্জ্বল মজুমদার বলেন, “আমাদের জেলা সভাপতির সঙ্গে অবিচার হয়েছে। সংখ্যালঘুদেরও বিজেপির ছাতায় আনতে পেরেছিলেন উনি। সেই কর্মীরাও আজ ক্ষুব্ধ।”

দুধকুমার-শিবিরের আরও দাবি, ইদানীং বিভিন্ন কর্মসূচি থেকে তাঁকে ব্রাত্য রাখা হচ্ছিল। আসন্ন পুরভোটেও তাঁর মতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তা নিয়েই দলের সঙ্গে সংঘাত হয়েছিল দুধকুমারের। তাঁর ঘনিষ্ঠ এক অনুগামী বলছেন, “দুধদা শনিবারই কলকাতায় গিয়ে নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করে ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, রাহুল সিংহের অনুরোধে দাদা নিজেকে থামান। তাই, এ দিন তাঁর পদত্যাগের খবর পেয়ে আমরা চমকে যাই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE